অলিয়ে কামিল হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.)

34

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

ইলমে শরীয়ত ও ইলমে তরীকতের সমন্বয়ে যে জ্ঞান তা হচ্ছে ইলমে মারেফাত বা তাসাউফ তত্ত্ব। আর মারেফাতের জ্ঞানই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। তাসাউফ জগতের বিজ্ঞানীদের নামই সুফী।
বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আল্লামা ঈমাম গায্যালী (রহ.) জ্ঞানের অতল সমুদ্রে ডুব দেওয়ার পরও অতৃপ্ত ছিলেন। ইসলামের প্রকৃত রহস্যের সন্ধান সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমি কালমশাস্ত্র বিশারদদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের নিকট প্রকৃত সত্য আছে কি ? তারা আমাকে বিভিন্ন দলিল পেশ করল। আমি বল্লাম এই সবতো আমি জানি। কিন্তু আমি নিগুঢ়সত্যে পৌঁছতে পারিনি। দার্শনিকদের নিকট গেলাম, তারাও সত্যের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হলো। সমকালীন গোপন মতবাদ বিশ্বাসীদের নিকট গেলাম তারাও সত্য দেখাতে সক্ষম হলো না। পরিশেষে আমি সুফীদের নিকট নিগুঢ় সত্য জানতে চাইলাম, তাঁরা আমাকে দেখালো সত্যের পথ। আমি সে পথে চলতে শুরু করলাম। কামিয়ার হলাম।
হযরত শাহ সুফী শেখ সৈয়দ শাহজাহান শাহ (রহ.) ছিলেন সুফী জগতের বিখ্যাত সাধক। তিনি ইয়েমেন দেশে জন্ম হলেও আরবের বহু দেশে ভ্রমণ করে বাংলাদেশে আগমন করেন পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে। আত্মীয়-পরিবার নয় মানবতার সেবা ছিল তাঁর প্রধান কাজ।
তিনি ছিলেন এক পরিশুদ্ধ মানুষ। মানব শরীরের অঙ্গসমূহ অন্তরের অধীন। তাই অন্তরের কালিমা দূর করতে নকে শুদ্ধ ও সজ্জিত করে তুলতে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ‘নিশ্চয় মানব দেহের মধ্যে এমন এক টুকরো মাংসপিÐ রয়েছে যা সংশোধিত হলে সমস্ত দেহ সংশোধিত হবে। আর তা বিনষ্ট হলে সমূহ অঙ্গ বিনষ্ট হয়ে যাবে। সাবধান সেই টুকরো হলো কলব বা অন্তর করণ। শাহজাহান শাহ (রহ.) ছিলেন কলব পরিশুদ্ধ এক ব্যক্তিত্ব। তিনি মাথার জ্ঞান নয় ছিলেন সীনার জ্ঞানের অধিকারী। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট পেলে শিক্ষিত হলে সীনার জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায় না। নায়েবে রাসুল তারাই যারা সীনার জ্ঞানের অধিকারী। নায়েবে রাসুলের সনদ কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না। সেটা অর্জিত হয় আধ্যাত্মিক সাধনায়। সারা জীবন শরীয়তের অনুসরণ করে হযরত শাহজাহান শাহ (র.) তরীকতের দরজায় গিয়ে পৌঁছেন এবং অর্জন করেন নায়েবে রাসুল (দ.) এর মর্যাদা। শরীয়ত হলো দুধ তরিকত হলো মাখন। দুধের চেয়েও মাখনের দাম বেশি কিন্তু দুধ ছাড়া তো মাখন হয় না। অনুরূপ শরীয়ত ছাড়া তরীকতে দরজায় পৌঁছতে পারে না। তাই শাহজাহান শাহ (রহ.) শরীয়তের পথ পেরিয়ে তরিকতে পৌঁছেছিলেন।
কামিল পীর মোরশেদ আল্লাহর অলিগণ মানুষের মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন। তাহলে প্রশ্ন মানুষ কী বন্দী ? কিসে বন্দী ? বৈষয়িক জগতের লোভ, মোহ, মায়া, কামনা, বাসনায় বন্দী। এ বন্দী দশা হলে মুক্তির জন্যই আত্মসমর্পণ। মুসলমান অর্থ-আত্মসমর্পণকারী। আত্মাকে সমর্পণ করতে হয় আল্লাহ পাকের কাছে। আল্লাহ কোথায় আছেন ? হাদিস পাক হলে জানতে পারি আসমান জমিনে আল্লাহর কোথাও সংকুলান হয় না, মোমেনের অন্তর ব্যতীত। “কলবুল মোমেনে আরশাল্লাহ” অর্থাৎ মোমেনের কলব আল্লাহর আরশ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘অফি আন ফুসিকুম আফালা তুবসিরুল” অর্থ : তোমাদের অন্তর সমূহেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না ? কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পংক্তিঃ “ মসজিদ এই, মন্দির এই গীর্জা এই হৃদয় / এই খানে বসে ঈসা মুসা পেয়েছেন সত্যের পরিচয়”। তিনি বলেছেন, “মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন কাবা মন্দির নাই”/ আল্লাহর কামিল অলিদের অবস্থান ও মর্যাদা আরো উচ্চস্থরে বলেই তাদের নিকট খোদা পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, “কুনু মায়াস সাদিকীন” যারা আমার অভিমুখী হয়েছে তাদের সঙ্গী হও।
আল্লাহর অলিদের দর্শন হলো আচার ধর্মের চেয়ে নৈতিক ধর্ম বড়। আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জন ব্যতীত নাম ও আচার পরিবর্তন করার মাধ্যমে কোন কল্যাণ হতে পারে না।
চট্টগ্রামকে বলা হয় ‘মদিনাতুল অলি’ অলিদের শহর, হযরত শাহ সুফী শাহজাহান শাহ (রহ.)’র মত শত আল্লাহর অলি চট্টগ্রামের পবিত্র মাটিতে শুয়ে আছেন। তাঁরা এখানে আগমন করেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। তাঁদের কাছে ধন সম্পদ পরিবার পরিজনের গুরুত্ব ছিলনা। সংঘাতের বিপরীতে শান্তির বাণী প্রচাওে তারা ব্রত ছিলেন। অমুসলিমদের তাঁরা ঘৃণা করে, যুদ্ধ করে নয়, ভালোবাসার হতে প্রসারিত করেই পবিত্র ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে এসেছেন। আমাদের দেশের তিনদিকে ভারত। একদিকে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশ আক্রান্ত, হলে আমাদের যাওয়ার পার্শ্ববর্তী কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই। আল্লাহ অলিরাই আমাদের রক্ষা করবে।
ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘ইসলাম তরবারীর দ্বারা প্রতিষ্ঠা হয়নি, আদর্শের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’। সেই আদর্শের ধারক বাহক আল্লাহর অলিগণই।
আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ডা. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন “মালয়েশিয়া যে দুইজন আল্লাহর কামিল অলি ইসলামের বাণী নিয়ে আগমন করেছেন তাদের চরিত্র ও আদর্শ দেখে সকলেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আজকের জঙ্গীবাদী-সন্ত্রাসীরা যদি ইসলামের বাণী নিয়ে আসতেন তাহলে কেউই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতো না ”। সর্ববৃহৎ মুসলিম (জনসংখ্যায়) রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ায় তরবারীর দ্বারা ইসলাম প্রচারিত হয়নি আল্লাহর কামিল অলিগণই প্রচার করেছেন। ক্রসেড যুদ্ধের পূর্বে ৮০০ বছর রাজত্বে মুসলমানরা তরবারী উঁচু করেননি। পরে খৃস্টানরা আযান দিতেও যখন দেয়নি তরবারী উঁচু করতে বাধ্য হয়েছে। আফ্রিকার পূর্ব উপক’লে যুদ্ধ-তরবারী নয় আউলিয়াগণই ইসলাম প্রচার করেছেন। ভারতে ৪টি প্রধান ধর্ম ছিল। ৪ কোটি মানুষ বসবাস করতো। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) ১ কোটির কাছাকাছি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করান। তিনি যুদ্ধ করে নয় প্রেম দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছিল। যুদ্ধ ও বাধ্য করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করালে আজ সকল হিন্দু তাঁর ভক্ত থাকতো না, কারণ তাঁর দ্বারাই তো হিন্দু ধর্মের বেশি ক্ষতি হয়েছে।
হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.)ও ছিলেন সর্বত্যাগী অলি। ইসলামের প্রচার ও মহামানবতার সেবায় দেশে দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন। সর্বশেষ হাটহাজারী উপজেলার ধলই ইউনিয়নে ইন্তেকাল করেন। আজ এই মহান অলির বরকতে ধলই ইউনিয়ন আলোকিত। তাঁর মাজার শরীফ আজ আধ্যাত্মিক প্রাণকেন্দ্রে পরিণত।

লেখক : রাজনীতিক, কলাম লেখক