অমর একুশে

100

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/ কারো দানে পাওয়া নয়/ দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি/ জানা আছে জগতময়/ সতেরোশো সাতান্ন সনে/ ভাইবা দেখেন পড়বে মনে/ দাম দিছি পলাশীর মাঠে/ ইতিহাস তার সাক্ষী রয়/ সেইবারে জানিল বিশ্ব/ আমরা কত ধনী রে/ দান করিতে লক্ষ জীবন/ তুচ্ছ বলে গণি রে/ আঠারোশো সাতান্ন সালে/ দাম দিছি ফের জানে-মালে/ ওরে, পিছন ফিরে চাইলে পরে’/ একশ’ বছর কথা কয়/ ব্রিটিশ গিয়া সইপ্যা গেল/ জল্লাদেরই হাতে রে/ তারা মোদের খুন কইরাছে/ নানা অযুহাতে রে/ লক্ষ তরুণ হাসি হাসি/ খাইছে গুলি পরছে ফাঁসি/ তবু না দুঃখিনী বাংলা/ তোমার-আমার কারো হয়/ বায়ান্নতে মুখের ভাষা/ কিনছি বুকরে খুনে রে/ বরকতেরা রক্ত দিল/ বিশ্ব অবাক শোনে রে/ দিছি রক্ত জন্মাবধি/ কত
সাগর কত নদী/ রক্তে বাংলা লাল কইরাছি/ এই কথা তো মিথ্যা নয়/ ঊনিশশো একাত্তর সালে/ পঁচিশে মার্চ রাতে রে/ মেয়ের-মায়ের-বোনের ইজ্জত/ লুইটাছে ডাকাতে রে/ বাপের সামনে বলুক তো ঝুট/ মেয়ের ইজ্জত হয়নি কি লুট/ আজো বাংলার আকাশ-বাতাস/ দুঃখে-শোকো উদাস হয়/ দাম দিয়াছি মায়ের অশ্রু/ বোনের সম্ভ্রম রে/ ওরে, বলতে কি কেউ পারো রে ভাই/ দাম কি কারও কম রে/কত কুলের কুলাঙ্গনা/ নাম নিয়ােেছ বীরাঙ্গনা/ দুঃখে বাংলার পদ্মা মেঘনা/ যমুনা যে উজান বয়/ দাম দিয়াছে বুদ্ধিজীবি/ নামী-দামী লোক কত/ এই জনমে ফুরাবে কি/ আমার বুকের সেই ক্ষত/ ঊনিশশো একাত্তর সনে/ ওরে, ষোলই ডিসেম্বর সকালে/ অবশেষে দুঃখিনী এই/ বাংলা মা যে আমার হয়…
বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অনুযায়ী, ভারত ভাগের পর পাকিস্তান সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের অন্যান্য কলেজ, কয়েন, স্ট্যাম্প এবং নৌবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষাসহ সরকারি সকল কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মঘট থেকে পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য পূর্ব পাকিস্তানে সরকারিভাবে বাংলা ভাষা ঘোষণা করার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ধর্মঘট থেকে শামসুল হক, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল ওয়াহেদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় মোহাম্মদ তোয়াহা নামে এক ছাত্রনেতা পুলিশের এক অফিসার থেকে একটি রাইফেল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাবে বেধড়ক পেটায়। গুরুতর আহতবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বেশ ক’জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের বর্বরতা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাজপথে মিছিল বের করে ছাত্রনেতারা। আব্দুল মতিন ও আবদুল মালেক উকিল মিছিলে নেতৃত্ব দেয়। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাড়ির দিকে যেতে চাইলে পুলিশ থামিয়ে দেয়।
একটি নিয়মানুগ রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে ভাষা চালু করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পরে একটি সংগ্রাম কাউন্সিল গঠন করে। আব্দুল মতিন পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হন। এই পরিষদের ব্যানারে তিনটি ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা সংগঠিত হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে, সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর থেকেই বাংলা ভাষার দাবি আদায়ের আন্দোলন ব্যাপকভিত্তিতে গতিলাভ করে। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলনের দ্রোহী চেতনা। যা পরবর্তীতে রূপ নেয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হতে থাকে তরুণ ছাত্র-যুবরা। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনপণ লড়াইয়ের চেতনার অগ্নিমশাল জ্বলে ওঠে দিকে দিকে।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন নিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদেও আহবানে ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। এ উপলক্ষো অনুষ্ঠিত সংগ্রাম পরিষদের সভায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন এবং এক প্রস্তাবে দাবি করা হয় গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরা যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকার করিয়ে নিতে না পারেন তবে তারা পদত্যাগ করুন। সভায় নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যেও সমালোচনা করা হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী মোমেনশাহী, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও অন্যান্য জায়গায় ঢাকার অনুরূপ ছাত্রবিক্ষোভ হয়।