তারল্যের বিপর্যয়

107

১৯৩০ সালে সৃষ্টি হয় মহামন্দা, একে বিশ্বমন্দা হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। এরপর ২০০৭-০৮ এর মধ্যে সংগঠিত আর্থিক মন্দা, যার মাধ্যমে চলে আসে তারল্য ঝুঁকি। তবে এ অবস্থায়ও বাংলাদেশ মহা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের স্পর্শের বাইরে ছিলো। ব্যাংকিং তারল্য হচ্ছে ব্যাংকে চাহিদা মোতাবেক অর্থের মজুদ, যা দিয়ে গ্রাহক চাহিবামাত্র গ্রাহকের ভ্যালেন্স থেকে চেকের বিপরীতে অর্থ প্রদানে সক্ষম থাকে। এ সক্ষমতার যদি ঘাটতি দেখা দেয় তবে বলা যায় ব্যাংকে তারল্য সংকট বিদ্যমান। তারল্য সংকট একটি অর্থনৈতিক সংকট। যা আর্থিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
ব্যাংক হচ্ছে যাদের উদ্বৃত আছে তাদের উদ্বৃত অর্থ জমা রাখে এবং প্রয়োজনের সময় চেকের বিপরীতে অর্থ দেওয়া এবং ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদেরকে উচ্চ সুদে কর্জ দেওয়া। সেই দিক থেকে ব্যাংক একটি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানও বটে। এ প্রত্যাশা যদি আশাবাদী হয়, তবে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে চলবে, অন্যাথায় অর্থনীতিতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। অর্থনীতির গতি নিম্নগামী হতে হবে খারাপের দিকে যেতে পারে। আর্থিক ব্যবস্থার উপর সাধারণ গ্রাহকের আস্থা কমতে থাকে।
ব্যাংক ব্যবসা ধরে রাখতে হলে অবশ্যই ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে ঋণ প্রদান করবে। এটাই ব্যাংকের মূল আয়ের উৎস। একটা ব্যাংক একটা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে গিয়ে কতিপয় বিষয় বিবেচনায় আনতে হয়। অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠান কে ঋণ দেবে ঐ প্রতিষ্ঠানের অস্থিত্ব আছে কিনা, ঐ প্রতিষ্ঠান আর্থিক ব্যবস্থায় দক্ষতার সাথে কাজ করে কিনা ? ঐ প্রতিষ্ঠানের সম্পদের শক্ত ভিত্তি আছে কিনা, প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ফান্ড প্রাপ্তির সম্ভাবনা অবারিত কিনা ? কোন কারণে, ঐ প্রতিষ্ঠান দায় পরিশোধে অক্ষম হলে তা উদ্ধারের জন্য প্রদত্ত বন্ধকী সম্পদ যথেষ্ট কিনা ?
কোন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে যদি অর্থায়ন করা হয় বা কোন অদক্ষ প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করা হয়, অথবা বন্ধকী সম্পদের শক্ত ভিত্তি নেই ঐ প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করলে প্রদত্ত ঋণ খেলাপী ঋণে পরিণত হবার সম্ভাবনা থাকে। খেলাপী ঋণের পরিধি যতই বাড়বে ততই অর্থসংকট বাড়বে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে পড়বে।
আমাদের দেশে ৬০টিরও অধিক ব্যাংক। ব্যাংকগুলো কোন না কোনভাবে তারল্য সংকটে আছে। দেশে ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থাগুলোর ঋণখেলাপী নেই বললেই চলে, সুতরাং এসব প্রতিষ্ঠানের তারল্য সংকট নেই বললেই চলে।
বর্তমানে ব্যাংক সমূহের দৈন্যদশা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে আছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৯৩০ এর মহামন্দার পর ২০০৭-০৮ এর মধ্যে সংঘটিত আর্থিক সংকট সবচেয়ে ভয়াবহ। তারল্যের ঝুঁকি প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে চলে আসে। তখন স্বল্পমেয়াদী তহবিলের যথেচ্ছা ব্যবহার হয় যা মোট বিনিয়োগের ৫৫% ছিলো।
একটি স্বাভাবিক অবস্থায় আর্থিক অবস্থা দক্ষতার সাথে কাজ করে এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠান সমূহের আস্থা বিদ্যমান থাকে। ফলে তাদের আশাবাদী আচরণ পুরো ব্যবস্থার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সম্পদের ভিত্তি থাকে নিরঙ্কুশ, প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ফান্ডপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে অবারিত। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিক পর্যায়ে গ্রাহকদের পছন্দমত ঋণ দিতে পারে।
আর্থিক ব্যবস্থায় সংকটজনক অবস্থায় দু’টো পর্যায় থাকে। ১মত : তারল্য সংকট, যা আর্থিক ব্যবস্থাকে নাস্তানাবুদ করে দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক কার্যক্রমের ও সাধারণের আস্থাহীনতা সৃজন হয়। যার ফলশ্রুতিতে বিদ্যমান সম্পদের মান খারাপের দিকে যেতে থাকে। ফলে স্বল্পমেয়াদী ফান্ড পেতে ও অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়।
২য়ত : তারল্য সংকট সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক ও অর্থসংকটের দিকে ধাবিত হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। এতে ঘোটা অর্থনীতি সংকটে পতিত হয়। অর্থাৎ তারল্য সংকট অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিকে থামিয়ে দিতে যথেষ্ট। তারল্য সমস্যায় তরল্য সম্পদের অস্বাভাবিক চাহিদা আর এর বিপরীতে যোগান অত্যন্ত সীমিত। অর্থাৎ Demand > supply.
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহকদের সঞ্চিত আমানতের পাশাপাশি আমানত ঋণের অনুপাত একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় অবস্থান করা বাঞ্চনীয়। ধরি আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে ৫% ঋণের প্রবৃদ্ধি পেয়েছে ৮% যার কারণে অবশ্য তারল্য সংকট সৃষ্টি হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। এর সাথে যে ঋণ বাজারে ছাড়া হয়েছে তা সময় মতো উসুলের ব্যাপারে ঋণগ্রহিতাদের তাগাদা দিতে হবে। তারল্য সংকট অনেকটা ক্যানসার ব্যাধির মতো খুব ছোট থেকে অনেক বড়ো হতে থাকে তারল্য সংকট অনেকটা ভাইরাস প্রকৃতির অর্থনৈতিক রোগ। এটি এক প্রতিষ্ঠান থেকে আর এক প্রতিষ্ঠানে, এক খাত থেকে অন্যখাতে। একবাজার থেকে অন্য বাজার এক দেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয়। তারল্য ঘাটতির জন্য অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হলে অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতি বদলে যায়। সম্পদের মূল্যের দ্রুত পতন হয়, নগদ তহবিল প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারীর নগদ তহবিলের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা এবং তারল্যের অভাবে চাহিদামাফিক তহবিল প্রদানে যখন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হয় তখন ঐ বাজারে ব্যক্তি / প্রতিষ্ঠান তাদের সিকিউরিটিজ স্বল্পমেয়াদে কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ফলে বাজারে বিক্রিযোগ্য সিকিউরিটিজের দরপতন শুরু হতে থাকে। সুতরাং দৃশ্যমান নয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাহিদামতো তহবিল যোগান দিতে ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হয় তখন ঐ আর্থিক বাজারে দরপতন শুরু হয়। তারল্য সমস্যা মুদ্রাবাজার আর্থিক বাজারে ও রিয়েল সেক্টরে জটিলা আকার ধারণ করে। অর্থনীতি একটা স্থবিরতার ভাব বিরাজ করতে থাকে।
তারল্য সমস্যা শিল্প পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে মূল সমস্যার মুখোমুখি হয় তা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদামাফিক শিল্পের জন্য কাঁচামাল স্বাভাবিক গতিতে আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করতে বাধাগ্রস্ত হয়। এতে করে উৎপাদন সক্ষমতা ব্যর্থ হয়। তা সামাজিকভাবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে আঘাত করে। তারল্য সংকটের কারণে বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে (Micro Economy সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে পরে (Macro) সামষ্টিক অর্থনীতিকে আঘাত করে যার কারণে এউচ প্রসৃদ্ধি হ্রাস প্রাপ্ত হয়। অনুরূপ তারল্য সংকটের জন্য ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ার GDP ১.৭৮% হ্রাস প্রাপ্ত হয়। ইতালীতে ২০১৪ সালে তারল্য সংকটের কারণে GDP ১০% হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং একই সময়ে শিল্প উৎপাদন হ্রাস পায় ২৫%। এধরনের পরিস্থিতি দ্রুত মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থযোগান দানের মাধ্যমে অর্থনীতিকে রক্ষা করতে পারে। ২০০৭-২০০৯ চীন আমেরিকার বাজারে অধিপত্য লাভ করে ভ্যালেন্স অব পেমেন্ট অনুকূল প্রভাব বিস্তার করে ২০০৭-২০০৯ অর্থনৈতিক মন্দার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা কাটিয়ে উঠতে ২০০৯ অর্থনৈতিক মন্দার জন্য যুক্তরাষ্ট্র মন্দা কাটিয়ে উঠতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফেড ৫০০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক তারল্যের যোগান দেয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ব্যাংকের আমানতকারীদের আস্থার আচরণত পরিবর্তনের জন্য এ ব্যবস্থার আবশ্যকতা ছিলো। সাম্প্রতিক কালে ফেড ২০০ বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আমেরিকা অর্থনৈতিক প্রতিশোধ স্বরূপ চীনের রপ্তানি পণ্যের ২৫% আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে, বাংলাদেশে তারল্য সংকট ২ লক্ষ কোটি বা তৎঊর্ধ্বে। অর্থ ঋণ গ্রহিতারা যত সহজে ঋণ প্রাপ্ত হয়েছে তত সহজে ঋণের অর্থ পরিশোধ করছেনা। এতে খেলাপী ঋণের টাকা মাসান্তে সুদে আসলে মিলে বড়ো অংকে পরিণত হয়ে ঋণ অপরিশোধিত হয়ে যাচ্ছে। এতে বড়ো অংকের খেলাপী ঋণ বড়ো তারল্য সংকট সৃষ্টি করে চলেছে। ব্যাংকে চেক উপস্থাপন করে অপেক্ষা করে গ্রাহকরা। এতে কিন্তু ব্যাংক নামক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক আস্থাহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। ব্য্যাংকের গ্রাহক সৃষ্টির ব্যাপারে উৎসাহ জাগ্রত করার বিকল্প নেই। কারণ পুঁজিবাজারে প্রতি মানুষের যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিলো জনগণের আস্থার ভাটার টানে তাতে আর চাঙ্গাভাব জাগ্রত হয়নি। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ শের খুব টাটকা খবর, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাংলাদেশ ব্যাংক এক অংকের অর্থাৎ Single Digite ৯% অনুমোদন করেছে। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবার কথা আছে। শিল্পখাতের মেয়াদী ও তলবী ঋণের গ্রাহকরা এই সুবিধা প্রাপ্ত হবেন। ইতিপূর্বে অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব এক অংকের সুদের হারের পাশাপাশি তরল সুদের অঙ্গিকার ব্যক্ত করলেও সেই ঘোষণা আসেনি, সুতরাং চক্রবৃদ্ধি সুদের হারই বহাল থাকবেই। এক অংকের সুদের হারে বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখবার্তা হলেও মূলবিবেচ্য হচ্ছে, তারল্য সংকট নিরসন করা, আর তা করতে হলে খেলাপী ঋণ উদ্ধারে তৎপর হওয়া। সরকারি নির্দেশনা মতো ২% পরিশোধ করে ঋণ রিসিডিউলের ব্যাপারে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। ধার দেওয়া যত সহজতর আদায় করা ততই কঠিন। ঋণগ্রহীতারা নিশ্চয় অত্যাধিক শক্তি সামর্থ্যরে অধিকারী। নতুন বছরে সরকারের করণীয় হবে ব্যাংকসহ সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংস্কার সাধন করে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলতা সৃষ্টি করে তারল্য সংকট সমাধানে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিদেশি বিনিয়োগকে বিরুৎসাহিত করে দেশীয় বিনিয়োগকারীদেরকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে গতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারলেই ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা অবশ্যই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবো।

লেখক : কলামিস্ট