হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী পুনর্মিলনী পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন ফিরে আর আসবে কি কখনো নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

547

হাবিলাস মল্ল, শ্যাম মোড়ল, আজিজ খাঁ রোয়াজা, মুসা খাঁন এমনি অনেক ইতিহাস যেন থমকে আছে হুলাইনে, এমনি ইতিহাস-প্রসিদ্ধ গ্রাম হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ, রাউজানের কদলপুর। ইতিহাস যখন বাকরুদ্ধ, অগত্যা কল্পনার পাখা গজায়, কিংবদন্তী ডানা মেলে, ঝিকিমিকি ওড়ে রূপকথার জোনাকি।
ইতিহাসের ছায়া তখনো কায়া হয়ে ওঠেনি, এমনি ধূসর অতীতে হাবিলাস মল্ল কিংবা শ্যাম মোড়ল নামের দুঃসাহসী সমুদ্র অভিযাত্রী ‘সপ্তডিঙ্গা’ বা ‘ময়ুরপঙ্খী’ নাও ভাসিয়ে সেই দ্বীপময় হাবিলাসদ্বীপ ও হুলাইনের জলাভূমিতে নোঙর করেছিলেন কিনা সে ছবি দেখা যায় না বটে; কিন্তু আজিজ খাঁ রোয়াজা কিংবা তদীয় পুত্র মুসা খানরা ঐতিহাসিক সময়ের প্রসিদ্ধ পুরুষ। দিল্লির সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে ভ্রাত্বদ্বন্দে¦ পরাজিত হয়ে মোগল শাহজাদা সুজা যখন হুলাইনের পাশ ঘেঁষে আরাকান অভিমুখে রাস্তা (বর্তমানে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক) তৈরি করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন হয়তো সম্পূর্ণ হুলাইন পানির ভিতর থেকে মাত্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এই হুলাইনেই উনিশশো উনসত্তর সালের কোনো এক শীতের সকালে মুসা খানেরই ভাই দরিয়া খানের উত্তর পুরুষ ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও নূর মোহাম্মদ চৌধুরী দুই ভ্রাতা একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে নতুন ইতিহাসের দ্বারোদঘাটন করেন। যেমন দুই ভ্রাতার নাম তেমনি তাঁদের গ্রামও অমর হয়ে আছে কলেজের নামকরণে।
আহমদ হোসেন খান নামে হুলাইন গ্রামের একজন বিশিষ্ট বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি তাঁদেরকে প্রেরণা জোগান। দু’ভাইয়ের মধ্যে ছালেহ আহমদ চৌধুরী জ্যেষ্ঠ। তাঁদের পিতা আমিন শরীফ চৌধুরীর আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিলো না। তাঁর চার পুত্রের মধ্যে ছালেহ আহমদ চৌধুরী সবার বড়। তাঁকে খুব অল্প বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথে নেমে পড়তে হয়। সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হন। তাই লেখাপড়ার প্রতি তাঁর খুব দরদ ছিলো। নিজে পড়তে না পারলেও ছোট ভাই নুর মোহাম্মদ চৌধুরীকে যতটা সম্ভব লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, যার ফলে নুর মোহাম্মদ চৌধুরী ডিগ্রি পর্যন্ত পড়তে পেরেছিলেন। পরে ব্যবসা-বাণিজ্য করে যখন তিনি এবং ছোট ভাই নুর মোহাম্মদ চৌধুরী বিত্তশালী হয়ে ওঠেন, তখন আহমদ হোসেন খানের মুখে কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব শুনে দু’ভাই তা লুফে নেন এবং কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যত টাকা-পয়সা লাগে দিতে সম্মত হন এবং দিয়েছেনও। পটিয়া ও বোয়ালখালীর দু’জন শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও এম এ কাশেম এবং আরো অনেক ছোটখাটো ব্যবসায়ী, স্বচ্ছল মানুষ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু টাকা-পয়সা দেন।
আহমদ হোসেন খান একজন ঁহংঁহম যবৎড়- কিন্তু তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, একাগ্রতা, অপরিসীম আগ্রহ ও আন্তরিক উদ্যম না হলে কলেজ প্রতিষ্ঠা দুরূহ হয়ে পড়তো।
কলেজ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ১৯৬৯ সালের ২ মার্চ ১৩৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়েছিলো। তৎকালীন সদর দক্ষিণ মহকুমার এসডিও রফিক আহমদ চেয়ারম্যান, তৎকালীন হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (কলেজের প্রতিষ্ঠাতা) ছালেহ আহমদ চৌধুরী, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী বিএ (হুলাইনের প্রাচীন গ্র্যাজুয়েট নুরুল আনোয়ার চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে চাকরি করে তখন স্বগ্রামে অবসর জীবন যাপন করছিলেন), অ্যাডভোকেট জালালউদ্দিন আহমদ চৌধুরী এমএ.এলএলবি (তিনি পরে হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম বারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন) ও সিটি কলেজের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ ভাইস চেয়ারম্যান, আহমদ হোসেন খান সাধারণ সম্পাদক, খলিলুর রহমান চৌধুরী (মুকুটনাইট) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং নাছির উদ্দিন আহমদ বিএবিএড (হুলাইন) সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সদস্য পদে হুলাইনের সিরাজুল হক চৌধুরী, নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, আবুল হাশেম মাস্টার, সৈয়দ আহমদ চৌধুরী, এসআইএম মমতাজউদ্দিন চৌধুরী, আবদুর রশিদ চৌধুরী, আবদুল মজিদ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইসহাক, আহমদুর রহমান, আবদুল গণি খান, নজির আহমদ, সোনা মিয়া সওদাগর, ছগীর আহমদ, নুরুল আলম মাস্টার, সেকান্দর আলী চৌধুরী, ডা. পজির উদ্দিন চৌধুরী, জহুরুল হক বিকম, শামসুল আলম খান বিএসসি; সিটি কলেজের অধ্যাপক খান শফিকুল মান্নান, চরকানাই’র নুরুল হুদা, এয়াকুব চৌধুরী, হাজি ইকবাল আহমদ, ছাবের আহমদ চৌধুরী, হাবিলাসদ্বীপের ননী গোপাল, বিজয় চৌধুরী, পাঁচরিয়ার অশ্বিনী রঞ্জন বড়–য়া (মাস্টার), মনসার নুরুল ইসলাম চৌধুরী, মওলানা সৈয়দ আহমদ, ইকবাল আহমদ (মাস্টার), সুলতান আহমদ সওদাগর, বদিউল আলম, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী; জিরির আবদুল মজিদ সওদাগর, মওলানা আমজাদ আলী খান, সৈয়দ আবদুস সবুর, খলিলুর রহমান, আশিয়ার আবদুল আজিম, শামসুল আলম চৌধুরী বিএ, নুরুল আনোয়ার খান, নাইখাইনের এমএ বখতিয়ার বিএসসি, সিরাজ আহমদ; এয়াকুবদÐীর ফজল আহমদ চৌধুরী, শাহজাহান চৌধুরী, ডা. এ জেড এম আবু জাফর, সৈয়দ আহমদ চৌধুরী, শাহজাহান চৌধুরী, বারৈখাড়ার মাস্টার নুর আহমদ, শামসুল আলম; আল্লাইর মাস্টার আলী আহমদ, কর্তালার কিরিটীরঞ্জন বড়–য়া, লড়িহরার আবদুল হাকিম সওদাগর, করণখাইনের শান্তি বিজয় সেনগুপ্ত, গৈড়লার সুশীল ঘোষ; মুকুটনাইটের দ্বিজেন্দ্র লাল বড়–য়া, পেরলার মোহাম্মদ একরাম চৌধুরী, তেকোটার অ্যাডভোকেট বদিউল আলম, ধলঘাটের আবদুস ছাত্তার চৌধুরী, বেঙ্গুরার মোহাম্মদ ইসহাক, আনোয়ারার ফজল আহমদ চৌধুরী, হাইলধর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান চৌধুরী (পরে এমপি, চিটাগাং চেম্বার ও এফবিসিসিআই’র সভাপতি, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য) হাবিবুর রহমান খান (বার্তা সম্পাদক-ইস্টার্ন এক্সামিনার), হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য আবু ছিদ্দিক চৌধুরী (চরকানাই), এয়াকুব আলী তালুকদার (পূর্ব পাঁচরিয়া), হাজি মদন আলী (শিকলবাহা), সোনা মিয়া চৌধুরী (মোহাম্মদনগর) ও তেজেন্দ্র লাল চৌধুরী (হাবিলাসদ্বীপ); ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল চৌধুরী (শিকলবাহা), একেএম নুরুল ইসলাম (জঙ্গলখাইন), সৈয়দ আহমদ চৌধুরী (কুসুমপুরা ইউসি-বর্তমানে ইউপি), আবদুল আউয়াল চৌধুরী (দৌলতপুর), দেবেন্দ্র মহাজন (হাবিলাসদ্বীপ)Ñএঁরা ছাড়াও ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে পশ্চিম বোয়ালখালী ও পশ্চিম পটিয়ায় সেসময় বিভিন্ন স্কুলের উদ্যোক্তা, সাধারণ সম্পাদক, প্রধান শিক্ষক ও বিশিষ্ট শিক্ষকগণ এবং শিক্ষিত, প্রভাবশালী ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ ছালেহ-নূর কলেজ প্রতিষ্ঠা-কাÐের সহযোগী হয়েছিলেন। স্থানাভাবে তাঁদের নাম উল্লেখ করা সম্ভব হলো না বলে আমরা দুঃখিত। তারা কোন না কোনভাবে জড়িত হয়েছিলেন কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গে।
ছালেহ আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে শাহনেওয়াজ চৌধুরী এমপি কলেজের হাল ধরেন। তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইমান চৌধুরীও তখন কলেজের কাজকর্মে জড়িত হন এবং নানাভাবে অবদান রাখেন।
হুলাইনের সমাজসেবী ইসহাক চৌধুরীও ছালেহ আহমদ চৌধুরী ও আহমদ হোসেন খানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সে সময় জনাব আহমদ হোসেন খানের সঙ্গে তিনি কলেজে যাতায়াত করতেন এবং কলেজের কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এই লেখা যখন তৈরি করছি, তখন ইউটিউবে মান্না দে’র আবেশমাখা দরদী কণ্ঠে গাওয়া চিরকালীন সেই পানটি শুনে আমার দেহমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো-আমি ফিরে গেলাম পঞ্চাশ বছর পেছনে।
মান্না দে গাইছেন-
“পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন
ফিরে আর আসবে কি কখনো…”
আহা ! আমি আবেগে থরথর করে কাঁপছিÑসত্তার গভীরে কোথাও রক্তপাত হয়, অন্তর্গত রক্তক্ষরণে আমি ভিজে ভিজে যাচ্ছি। পঞ্চাশ বছর আগে যখন জুলাই মাসে আমরা ক্লাস করতে গেলাম, সেটাও পৌষের কাছাকাছি সময়ই ছিলো। তখন পিঠাপুলির দিন, ধান কাটা মাঠে নাড়া জ্বালিয়ে চড়–ইভাতি হচ্ছে, হালকা কুয়াশার আস্তর ধরায় নেমে আসবে কি আসবে না দ্বিধায় ঝুলে আছে আকাশে।
মিঠে রোদে কলেজের পূর্বদিকে অনেক গাছগাছালির ছায়াঘেরা সবুজ নিসর্গের পশ্চাদপটে কী মনোরম দিন ছিলো তখন। তারুণ্য পেরুনো যৌবনের লাজন¤্র সীমান্তে সেই ফেলে আসা দিনগুলি আর কখনো ফিরে পাবো না। এই না পাওয়ার বেদনা যে কত মর্মান্তিক, হৃদয় অন্তর্ঘাতী, মর্মভেদীÑ তা’ কী করে বুঝাব? ভিতরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্তপাত হবে, কিন্তু প্রকাশও করা যাবে না। হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে হায় বেদনা জাগাতে কে ভালোবাসে?
আমাদের শিক্ষকদেরও অধিকাংশের সেই প্রথম শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। তারাও কি ভুলতে পারবেন জীবনের প্রথম চাকরি বা শিক্ষকতার কথা। তারাও নব্য যুবক তখন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস দিয়ে প্রথম হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজের চাকরিতে ঢুকেছেন। প্রায় কারো কৌমার্যের অবসান ঘটে নি। চোখ থেকে তখনো স্বপ্নের ঘোর কাটেনি, মনে কত কল্পনার ডালপালা মেলছে।
আহা ! একদিন আকবর স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিতে যখন হারমোনিয়াম নিয়ে গাইছিলেন এই রবীন্দ্রসঙ্গীত-
“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
মম শুন্য গগন বিহারী
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে
তোমারে করেছি রচনা
তুমি আমারই তুমি আমারই।”
শিল্পী নন তিনি, কিন্তু যে আবেগ, দরদ দিয়ে তিনি গাইছিলেন, তাতে সুরের ঊনতা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো। পাশা স্যারও সম্ভবত গলা মিলাচ্ছিলেন। কত আবেগ, কত অনুভ‚তিÑ প্রকাশের অপেক্ষায় ডানা ঝাপটে নিথর হয়ে পড়েছে। সেইসব স্মৃতি চিরদিনের জন্য চাপা দিয়ে ফেলেছেন। আজো জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিদাঘ দুপুরে কোন অলস মুহূর্তে মনের গহীন প্রদেশ থেকে সেই কী স্মৃতি উঠে এসে তাঁদের চোখ অশ্রæসিক্ত করে না ? তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীরা পুনর্মিলনীতে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে ভালোই করেছে। তারাও এই সুযোগে কলেজের আঙিনায় আবার পদচারণা করবেন, কেমন মধুর হবে সেই মুহূর্ত।
শিক্ষকদের মধ্যে সবার কথা মনে নেই। যাঁরা আমার স্মৃতিতে এখনো জীবন্ত, তাঁরা হলেন-বাংলার অধ্যাপক বিপ্রদাশ বড়–য়া, অর্থনীতির অধ্যাপক আওরঙ্গজেব চৌধুরী, ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, লজিকের অধ্যাপক আকবর আহমদ, পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), রসায়নের অধ্যাপক বাকী অংশ পৃষ্ঠা-৪এ

রফিকুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মনোরঞ্জন (তাঁর পদবি আমি ভুলে গেছি), হিসাব বিজ্ঞানের অধ্যাপক জিতেন্দ্র লাল দে-এই পর্যন্ত আমার মনে আছে। প্রবীণ শিক্ষক বিভ‚তি বাবু এবং প্রবীণতর জে.এল.দে. স্যারের কথা আগেই বলেছি। আওরঙ্গজেব চৌধুরী ও আনোয়ারা পাশা টকটকে ফর্সা, বেশ সুন্দর মানুষ ছিলেন। পাশা সাহেব ও আকবর সাহেবও আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তবে বিপ্রদাশ বাবুর সঙ্গেই আমার বেশি নৈকট্য স্থাপিত হয়েছিলো। বিশেষ স্মৃতি আছে। আমি তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যাই।
দিলীপ বাবুর জন্য মনটা হাহাকার করে ওঠে। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না, তবুও আমাদের সময়ের শিক্ষক, আমার মনে তাঁর জ্বলজ্বলে স্মৃতি ধরা আছে। বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। রফিক সাহেব পরে কে রহমানে (বর্তমানে আবদুল মোনেম লি.) চলে যান। তিনি আমাদের অনেকদিন কে.রহমানে নিয়ে গিয়ে ফানটা, কোকা-কোলা, আইসক্রিম খাইয়েছেন।
আওরঙ্গজেব সাহেব আওয়ামী লীগ সমর্থন করতেন। তিনি নন্দনকানন ইউনাইটেড বোর্ডিংয়ের পাশে থাকতেন। আমি ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর অনেকদিন তাঁর বাসায় গিয়েছি, তিনি অনেক কিছু খাইয়ে আপ্যায়ন করতেন। স্বাধীনতার বহু পরে আমি তাঁকে চেরাগী পাহাড়ে লুসাই ভবনে দুটি রুম ভাড়া নিয়ে তাঁর বোনকে নিয়ে থাকতে দেখেছি। তিনি যখনই আমাকে দেখেছেন, কখনো না খাইয়ে ছাড়েন নি। আনোয়ার পাশা সাহেব স্বাধীনতার কয়েক বছর পর সিটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে আওরঙ্গজেব সাহেব সম্ভবত এমইএস কলেজেও শিক্ষকতা করেন। উভয়ের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। পাশা সাহেব আন্দরকিল্লা থাকতেন; নামাজ পড়তে আসতেন জামে মসজিদে। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো আন্দরকিল্লায়। তিনি অধ্যক্ষ রেজাউল করিম সাহেবের ভাবশিষ্য ছিলেন।
আকবর সাহেব পরে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতার পর নানুপুর লায়লা কবির কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তাঁর লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। তাঁর অনেক প্রবন্ধ আমি পূর্বকোণে ছাপিয়েছি। বহুদিন তাঁর আর কোনো খবর পাই না। আমি কি তাঁর সঙ্গে সদাচরণ করিনি কিংবা তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনে কখনো কুণ্ঠিত হয়েছিলাম? জানি না কেন তিনি তাঁর এ অধম ছাত্রকে ভুলে গেলেন?
১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, ক্লাস শুরু হয় সম্ভবত জুলাই মাস থেকে। প্রথমদিন আমিও ক্লাস করেছিলাম। কিন্তু কোন্ মাসে সেটা আমার মনে নেই। সেই কলেজ ইন্টারমিডিয়েট থেকে ডিগ্রি কলেজ হয়ে এখন গৌরবের পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করেছে। পঞ্চাশ বছর একটি ল্যান্ডমার্ক, যেকোন কলেজ বা অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানের জন্য তা’ গৌরবময় অর্জন। পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আমরা প্রাক্তন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পুনর্মিলনী উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আগামী ২৮ ও ২৯ ফেব্রæয়ারি ২০২০ আমাদের পুনর্মিলনী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম বর্ষে যাঁরা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের কথা কিছু বলতে হয়। চকরিয়া থেকে আসলেন আমার বন্ধু হাজি বশির, শাহাজাহান, নুরুল আলম (প্রয়াত) সহ আরো অনেকে। হাজি বশির খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, তিনি পরে বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। শাহজাহান প্রথমে ছাত্রলীগ করতেন, পরে অধ্যাপক আরিফ মঈনুদ্দিনের প্রেরণায় জিয়ার রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হন। তাঁকে চট্টগ্রামে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
হাবিলাসদ্বীপের অনেক ছাত্র-ছাত্রী কিন্তু ছয়জন ছাড়া আরো কারো নাম মনে নেই। ছয়জনের পাঁচজন শান্তি, অরুণ, নুরুল হক, তপন দত্ত, ত্রিদিব আমার বন্ধু, আরেকজন মহিলা, তাঁর আসল নাম মনে নেই। তিনি পারুল নামে আমাদের কাছে পরিচিত ছিলেন; পারুল এখন প্রয়াত।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহোদরপ্রতিম স্বপন চৌধুরী আমাদের এক বছর পর ভর্তি হন। হাবিলাসদ্বীপের প্রসিদ্ধ জমিদার তেজেন্দ্রলাল চৌধুরীর কনিষ্ঠপুত্র স্বপন চৌধুরী বড় ভালো মানুষ, উপকারী বন্ধু। স্বাধীনতার পর পর স্বপনকে নিয়ে আমি ঢাকায় ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে গিয়েছিলাম। তখন শীতের দিন, আমার কোন ভালো সার্ট ও শীতের কাপড় ছিলো না। সে আমাকে তার একটি সার্ট ও শাল গায়ে দেওয়ার জন্য দিয়েছিলো। সেই থেকে অদ্যাবধি স্বপনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অটুট এবং অমলিন। স্বপনের বাবা তেজেন্দ্রলাল চৌধুরী কলেজের অন্যতম দাতা এবং উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। স্বপনের জেঠা প্রফুল্ল রঞ্জন চৌধুরীও ছালেহ-নূর কলেজ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। স্বপনের জেঠাতো ভাই মানিক চৌধুরী বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর তিনি দেশজোড়া খ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। হাবিলাসদ্বীপের আশীষ সেনের কথাও মনে পড়ে।
হুলাইনের অনেক ছাত্র। প্রথম বর্ষে আমি, আমার ভাই নজরুল, মুসলিম, আসলাম, রফিক (১), রফিক (২), ইমাম হোসেন চৌধুরী, শোয়েব, নাসির, হারুন, দক্ষিণ হুলাইনের নুরুল আলম, বেলমুড়ির আবুল কাশেম, মামুন ও রফিক আমাদের ব্যাচে এবং হুলাইনের নুরুল আলম, রফিক, আনোয়ার, জামাল পরের ব্যাচে ভর্তি হয়। হুলাইনের সবাই আমার বন্ধু, তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই রফিকের কথা, তিনি আমার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। পরে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে চাকরি নিয়ে অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
আমার ভাই নজরুল, বেলমুড়ির আবুল কাশেম এবং আমাদের পরের ব্যাচের মনসার মনিরও খুব ভালো ছাত্র ছিলো। তুষার নামে একজন ভালো ছাত্র ছিলেন। তিনি সাহিত্যচর্চা করতেন। তিনি কি আমাদের ব্যাচে না পরের ব্যাচে ছিলেন সেটা মনে পড়ছে না। তিনি শিক্ষকতা পেশা অবলম্বন করে শেষদিকে পটিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন।
চরকানাইর আমিনুর রহমান, রফিক (১), রফিক (২), মফিজ, সিরাজ, রফিক (৩), আবদুস সালাম-সবাই আমার বন্ধু ছিলো। তবে দুই রফিকের সঙ্গে খুব বেশি অন্তরঙ্গতা হয়। রফিকুল আলম চৌধুরী খুব চৌকস কেতাদুরস্ত তরুণ ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি কখন মারা গেলেন, আমি জানতেও পারিনি। তাঁর কথা মনে হলে আমার হৃদয় তোলপাড় করে ওঠে। কতো প্রিয়পাত্র ছিলাম তাঁর। আমাকে তিনি বলতেন ‘সাহিত্যিক’। অপর রফিক পরে অগ্রণী ব্যাংকে চাকরি নিয়ে অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি আমার সহোদর ভাইয়ের মত। সালাম নামে খাগরিয়ার আরো একজন ছাত্র ছিলো। তিনি চরকানাই রফিকদের বাড়িতে মান্নান ভাইয়ের বাড়িতে লজিং থাকতেন।
স্বাধীনতার পর আমাদের এলাকায় একটা বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আমাকে দীর্ঘদিন রফিকের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হয়। আমার জন্য তাঁর পরিবারের ত্যাগ আমি ভুলতে পারবো না। একই সময়ে স্বপন চৌধুরীর শহরের রামজয় মহাজন লেনের বাসায়ও মাঝেমধ্যে থাকতে হতো। স্বপনের সঙ্গে তখনই হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। তাঁর পরিবারও আমার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করে। অমরদা, শিবুদার আন্তরিকতা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি।
গোরণখাইন থেকে আসতেন জুলফিকার, একরাম ও নুরুল আলম। জুলফিকার প্রতিভাবান ছাত্র ছিলেন; তিনি পরে আমেরিকা গিয়ে সেখানকার অভিবাসী হন, কিন্তু সেখানে একদিন তাঁর দোকানে ঢুকে দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জুলফিকার আমার ভাইয়ের মতো ছিলেন। খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত থেকে আসার পর জুলফিকার আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে আমার টাইফয়েড হয়। জুলফিকার, তাঁর বড় ভাই বক্কর সাহেব ও তাঁর মায়ের শুশ্রæষায় আমি ভালো হয়ে উঠি। জুলফিকারের পরিবারের প্রতি আমি অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ হয়ে আছি। একরাম ও নুরুল আলমও বন্ধুস্থানীয়।
বিনিনেহারা থেকে ইউসুফ এস্কারী ও কামাল উদ্দিন পড়তেন। ইউসুফ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমার প্রতি তাঁর সহৃদয়তা ভোলার নয়। ইউসুফ অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। তিনি অনেক মেয়ের কাক্সিক্ষত পুরুষ ছিলেন। তিনি নিজেও একজনের প্রতি দুর্বল ছিলেন বলে মনে হয়। ইউসুফ চরকানাই স্কুল থেকে আমার বন্ধু; আমার প্রতি তাঁর সহৃদয়তা ভোলার নয়। বিনিনেহারার গফুর একবছর পরে ভর্তি হয়েছিলো।
সাততথৈয়ার নাজিম উদ্দিন (প্রয়াত) আমার ভালো বন্ধু ছিলো, সে ছাত্র হিসেবেও মেধাবী ছিলো, পরে শিক্ষকতায় যোগদান করে নাম করেছিলো। সে ঈদগাহর দিকে পিডিবি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলো।
জিরির আবু তাহের বাঙালি, এমদাদ আমার বিশেষ বন্ধু। জিরির ফজলুল হক, ইউসুফরা দু’এক বছর পরে ভর্তি হলেও আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। আবু তাহের বাঙালি বয়সে আমার একটু বড়ই হবেন। সেজন্য আমি তাঁকে বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করতাম।
ভেল্লাপাড়ার মোজাম্মেলও ছোট কিন্তু আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ। থানামহিরার এখলাস, মোহাম্মদ হোসেন, আমিনুল হক, বজল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মোহাম্মদনগরের এজাহার মিয়াসহ আমরা ব্রিজ খেলতাম। দিদারও আমাদের পার্টনার ছিলো। মোহাম্মদনগরের এয়াকুবও আমাদের সঙ্গে পড়তো।
মনসা থেকে নুরুল ইসলাম, সিরাজুল হক, ইউসুফ চৌধুরী (প্রকৌশলী, আমেরিকা প্রবাসী), নাজিমুল হক, মোসাদ্দেক এবং আরো কেউ কেউ পড়তেন। কিন্তু নাম মনে নেই। ২য় ব্যাচে মনসার সামশুল হক ও মুজিব উদ্দৌলাও কলেজে ভর্তি হন ।
ইউসুফ চরকানাই স্কুলেও আমার এক ক্লাস নিচে পড়তো। সে পরে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়। ইউসুফ ২৫ মার্চ ৭১ আমার সঙ্গে রেস্ট হাউসে ছিলো। ভারতে গিয়েও আমরা একত্র হই। ইউসুফ এস্কারীর মতো সুন্দর সুপুরুষ ছিলো। দু’জনই অসম্ভব ফর্সা এবং রাজপুত্রের মতো চেহারা ছিলো তাঁদের। সিরাজুল হক আমার বন্ধু। সে দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে এখন দেশে ফিরে এসেছে। আলীনূর পড়তো কিনা মনে নেই। আহমদ নূর সম্ভবত দু’এক বছর পর ভর্তি হয়।
নাইখাইন থেকে হুলাইন খুব কাছে নয়। বরং বাসে পটিয়াই কাছে হয়, তবুও পটিয়া কলেজে না পড়ে নাইখাইন থেকে আমাদের কলেজে পড়তে এসেছিলেন আফসার, শাহজাহান খান, আর্যমিত্র বড়–য়া, নুর মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম। আফসার আমার ভাইয়ের মতো। তাঁর বাবা হোয়েকস্টে চাকরি করতেন। তাঁর সঙ্গে অনেকবার সেখানে গিয়েছি। তিনি হোয়েকস্টের ভালো ভালো খাবার আমাদের খাইয়েছেন। আর তাদের তৈরি টুথপেস্ট উপহার দিয়েছেন।
লড়িহরার আবুল হাশেম (প্রয়াত), সাদারপাড়ার মাহবুব, নিমতলের ইসহাক চৌধুরী-এই তিনজনের মধ্যে কেউ প্রথম বর্ষের, কেউ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলো। ইসহাক চৌধুরী লোক সাহিত্যের গবেষক ও পুঁথি বিশেষজ্ঞ হিসেবে খুব নাম করেছেন।
এয়াকুবদÐীর ইসহাক এক বছর পরে ভর্তি হয়। তা’ সত্তে¡ও তাঁর সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গড়ে ওঠে। নুরুন্নাহার ও সাইফুল দু’ভাইবোন আমাদের সঙ্গে পড়তেন মনে পড়ে।
সাঁইদাইর থেকে আসতেন ইসহাক ও শওকত আলী; দ্বারক পেরপেরা থেকে অসিত বর্ধন, পিঙ্গলা থেকে সুবীর বড়–য়া, পরে দিবাকর বড়–য়া ভর্তি হয়; বাণীগ্রাম অথবা চাপড়ার দিক থেকে পেয়ার মোহাম্মদ নামে একজন আসতেন।
একজন খুব ভালো ছাত্রের কথা আমি উল্লেখ করতে ভুলে গেছি বলে রীতিমতো লজ্জা হচ্ছে আমার। তিনি হচ্ছেন মনসুর উদ্দিন, বাঁশখালী নিবাসী। তিনি ইমাম হোসেনের বাড়িতে লজিং থাকতেন। খুব মেধাবী ছাত্র। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে অনার্স ও এম এ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ডিন হন। আরেকজন আহমদ হোসেন। তিনি সম্ভবত চকরিয়ার মানুষ। পরে খাতুনগঞ্জে ব্যবসা করতেন। প্রাতঃভ্রমণ করেন, আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়।
সেকালের সাতকানিয়া বর্তমান লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ থেকে আসেন দিদার মো. শামসুল আলম; তিনিও ভালো ছাত্র ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। তিনি চরকানাই নিবাসী হাবিলাদ্বীপ ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক চৌধুরীর বাড়িতে লজিং থাকতেন। স্বাধীনতার পর দিদারকে পাই শহরে। তিনি তখন ফিরিঙ্গীবাজারের মুখে অধুনালুপ্ত কবিরাজ বিল্ডিংয়ের দোতলায় লোহাগাড়ার ডা. ফয়েজ সাহেবের বাসায় লজিং থাকতেন। তাঁর ছেলে বর্তমানে কবি, সাংবাদিক অধ্যাপক শাহিদ আনোয়ারা ও তার বোনদেরকে পড়াতেন। শািহদ খুব মেধাবী ছাত্র ছিলো। দিদারের সযতœ পরিচর্যায় শাহিদের প্রতিভা সৃজনশীল পথে বিকশিত হবার সুযোগ পেয়েছিলো। দিদার খুব সিগারেট খেতেন, আমিও কম খেতাম না। তিনি সিগারেট কিনতেন গ্রোস হিসেবে। দেশলাই কিনতনে ডজন হিসেবে। তবে কেটে কেটে খেতেন সিগারেট। দিদার দীর্ঘদিন এম ই এস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। আমার প্রাণের দোস্ত দিদার বহুদিন হলো গত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর স্মৃতি এখনো আমার কাছে তরতাজা।
খাগরিয়া থেকে মোনাফ নামে একজন আসতেন; তিনিও আমার বন্ধুশ্রেণিতে পরিগণিত হয়েছিলেন। কুতুবদিয়া থেকে পড়তেন মোজাম্মেল হক কুতুবী, তিনি হুলাইনে লজিং থাকতেন। দোহাজারী থেকে মালেক নামে একজন পড়তেন আমাদের ব্যাচে, ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন।
আনোয়ারা থেকেও অনেকে এসেছিলেন। আমার শুধু ছলিমউল্লাহ চৌধুরী, আবু বকর ও শম্ভু পালের কথা মনে আছে। শম্ভুকে ছালেহ নূর কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।
মোহরা থেকে আবদুর রহিম, আবদুল হাকিম, বশির; কধুরখীল থেকে খায়রুল বশর; গোমদÐী থেকে আবু জহুর ও নজরুল ইসলাম (উভয়ে প্রয়াত, নজরুল পরে আইনজীবী হয়েছিলেন); শাকপুরা, বড়–য়ার টেক থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী আসতেন, কিন্তু কারো নামই আমার মনে নেই; আমার শুধু নেলীর নাম মনে আছে। ৮০’র দশকে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আহমদ হোসেন খানের পুত্র আমজাদও ছাত্র ছিলেন এবং কিছুদিন শিক্ষকও ছিলেন।
এতক্ষণ ছাত্রীদের কথা বলা হয়নি। এবার সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে চাই। আমাদের সময়ে হাবিলাসদ্বীপ, শাকপুরা, পাঁচরিয়া, মুকুটনাইট, লাখেরা ও কোলাগাঁও থেকে অনেক ছাত্রী পড়তেন।
এয়াকুবদÐী থেকে নুরুন্নাহার ছাড়াও আরো একজন পড়তেন। শাকপুরা থেকে একজন মুসলিম ছাত্রী বোরকা পড়ে আসতেন। নাম আয়েশা খাতুন। মুকুটুনাইটের খলিল সাহেবের কন্যা রোকেয়া আকতার দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হন, পরে তাঁর বোন সেলিনা আকতারও ভর্তি হন। মুকুটনাইট থেকে আরো ছাত্রী আসতেন বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে বড়–য়া ছাত্রী তো ছিলেনই।
আমাদের সময়ে কলেজে অনেক সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন, কিন্তু সুন্দরীÑ শ্রেষ্ঠ ছিলেন দু’জন-শাকপুরার চিন্ময়ী শর্মা ও কোলাগাঁওর ল²ী রাণী চৌধুরী। ¯িøম ফিগারের চিন্ময়ী শর্মা যেন ডানাকাটা পরী, তিনি যখন হাইহিল জুতো পায়ে গটগট করে হেঁটে যেতেন, তখন অনেক ছাত্রের বুকে কাঁপন সৃষ্টি হতো।
ল²ী যেন ল²ীর প্রতিমা। মা দুর্গার মতো তাঁর গোলগাল মুখাবয়ব, ভাসাভাসা চোখ, মৃণাল বাহু এবং ঢল ঢল অঙ্গের লাবণী নিয়ে ল²ী বাংলার চিরায়ত নারীর রূপে যখন কলেজে উদয় হতেন, তখন কলেজ যেন আলো হয়ে যেত। ল²ী চরকানাই স্কুলেও আমার সহপাঠী ছিলেন। চিন্ময়ী এবং ল²ী এখন কোথায় আছেন জানি না। আশা করছি ছালেহ-নূর কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তী ও পুনর্মিলনীর প্রস্তুতি সভাগুলিতে তাঁদের দেখা পাবো।
রাজনীতির কথা কিছু বলতে হয়। রাজনীতির কথা না বললে এ আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি উনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়ে ছালেহ-নূর কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। ৬৮ সাল থেকে জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে। অবশ্য ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার পারদ উর্ধ্বমুখী চড়তে থাকে। আওয়ামী লীগের কথায় ছাত্রলীগও চলে আসে। আওয়ামী লীগেরই সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই ছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী। আমাদের এলাকায় চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন। তিনি হলেন মনসা গ্রামের এসএম ইউসুফ। কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় তিনি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। মূলত তাঁর কারণেই আমাদের এলাকায় এবং কলেজে ছাত্রলীগের কার্যক্রম জোরদার হয়। ছালেহ-নূর কলেজের যাত্রা শুরু হতে না হতেই ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তা মনসার নুরুল ইসলাম। নুরুল ইসলাম চরকানাই হাইস্কুলে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে যোগ দেন। কলেজে আসার পূর্বেই তিনি পশ্চিম পটিয়ায় বিশিষ্ট ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এসএম ইউসুফই নুরুল ইসলামকে ছাত্রলীগে দীক্ষা দেন। এসএম ইউসুফ তখন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁরই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আমরা কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাÐ শুরু করি। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী দু’বছর ছালেহ-নূর কলেজে দু’বার কমিটি গঠিত হয়েছিলো। একবার চরকানাইর শেখ আমিনুর রহমান চৌধুরী সভাপতি এবং আরেকবার গোরণখাইনের নুরুল আলম সভাপতি নির্বাচিত হন।
কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে আমাদের এলাকায় ছাত্রলীগ তেমন শক্তিশালী ছিলো না। ছাত্র ইউনিয়নই ছিলো শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন, মেনন-মতিয়া উভয় গ্রæপই শক্তিশালী ছিলো। ছালেহ-নূর কলেজের একটা অবদান হলো আমাদের এলাকায় কলেজের কারণে ছাত্রলীগের জোরদার কার্যক্রম শুরু হয়। মিটিং-মিছিলে কলেজ এবং সংলগ্ন পাঁচরিয়া দিঘির পাড় সরব হয়ে ওঠে। পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতিও কলেজ এবং পাঁচরিয়া দিঘির পাড়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত থাকে।
এ সময় ছালেহ নূর কলেজে ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন জিরির আবু তাহের বাঙালি ও এমদাদ, আসলাম, রফিক, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (আমি) ও রফিক আহমদ, চরকানাইর মোহাম্মদ রফিক, রফিকুল আলম চৌধুরী ও আমিনুর রহমান, গোরণখাইনের নুরুল আলম, বিনিনেহারার ইউসুফ এস্কারী, নাইখাইনের আফসার উদ্দিন আহমদ, হাবিলাসদ্বীপের নুরুল হক, স্বপন চৌধুরী, আশীষ সেন, লড়িহরার আবুল হাশেম। ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) নেতা ছিলেন হুলাইনের নুরুল আলম, বেলমুড়ির আবুল কাশেম ও রফিক আহমদ চৌধুরী, মনসার আহমদ নূর ও দক্ষিণ হুলাইনের নুরুল আলম। ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রæপের নেতা ছিলেন আনোয়ারার শম্ভু পাল, কোলাগাঁওর নিবেদিতা বড়–য়া, হুলাইনের এ কে এম মামুনুর রশিদ ও মনসার আলী নূর।
২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে আমরা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে গিয়ে বোয়ালখালী থানা থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। আন্দোলন-সংগ্রামে যেমন, মুক্তিযুদ্ধেও ছালেহ-নূর কলেজের ছাত্ররা অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে। যুদ্ধের প্রথমদিকেই ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাই আমি, আসলাম, রফিক ও ইউসুফ খান। কলেজের অন্তত ২২ জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একজন শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী। বোয়ালখালী থানার কধুরখীল গ্রামে তাঁর বাড়ি। আরেকজন শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিকের কাজ করেন। তিনি বাংলার শিক্ষক অধ্যাপক বিপ্রদাশ বড়–য়া। বিপ্রদাশ বাবু দেশের একজন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। তিনি স্বাধীনতার পর শিশু একাডেমিতে যোগ দিয়ে পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে সাহিত্য সৃষ্টিতে নিয়োজিত আছেন। তিনি একজন নিসর্গ প্রেমিক। মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মিকায় অনেকগুলি গল্প-উপন্যাস তিনি লিখেছেন। তন্মধ্যে অন্তত চার পাঁচটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আমি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে তিনি আমাকে অমর করে রেখেছেন গল্পে উপন্যাসে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা হলেনÑআমি, আসলাম, তিন রফিক ও ইউসুফ খান, হাবিলাসদ্বীপের স্বপন, চরকানাইর রফিক ও তাঁর ভাই মহসিন, দুই ভ্রাতা মফিজ ও সৈয়দ, পূর্ব পাঁচরিয়ার ইউসুফ ও সবুর, গোরনখাইনের নুরুল আলম, সাঁইদাইরের ইসহাক (প্রয়াত), জিরির আবু তাহের বাঙালি, এমদাদ ও ফজলুল হক, বিনিনেহারার ইউসুফ এস্কারী ও আবদুল গফুর, মনসার ইউসুফ, নুরুল ইসলাম ও নাজিমুল হক, নাইখাইনের আফসার ও নূর মোহাম্মদ, লড়িহরার আবুল হাশেম, সাদারপাড়ার মাহবুব এবং এয়াকুবদন্ডীর ইসহাক। মনসার নুরুল ইসলাম পটিয়া থানা বিএলএফ’র কমান্ডার ছিলো।
ছালেহ নূর কলেজের কথায় আমি আবেগ সংবরণ করতে পারি না। সেই দু’বছর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। কখন মেঘে মেঘে বেলা বেড়ে যায়। আমরা বুড়িয়ে যাই। কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়লে উদাস হয়ে যাই। বুকের খাঁচার মধ্যে আটকে থাকা একটা দীর্ঘশ্বাস আমাকে ধসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন রিক্ত, নিঃস্ব আমি শুন্য দৃষ্টিতে আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে উদগত অশ্রু চেপে রাখার চেষ্টা করি। এদিকে কলেজও যে কখন পঞ্চাশ বছর পা ফেলেছে সে খেয়াল করি নি। সে কথা মনে পড়তেই মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে ওঠে কবিগুরুর গান-
‘দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায়
রইলো না রইলো না
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি
কান্না-হাসির বাঁধন
তারা সইলো না সইলো না।’
ছালেহ-নূর কলেজ থেকে কিছু ছাত্রনেতা সৃষ্টি হয়েছেন, যারা শুধু পশ্চিম পটিয়া বা পটিয়া নয়, সমগ্র জেলায় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের পরবর্তী দু’তিন বছরের মধ্যে কলেজে যারা ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের নাম যতটুকু স্মরণ করতে পারছি, বলছি-হুলাইনের মুজিবুর রহমান খান (অ্যাডভোকেট), সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ রফিক ও নুুরুল হাকিম, ভেল্লাপাড়ার মোজাম্মেল, মনসার আবু তাহের চৌধুরী (বর্তমানে কলেজের অধ্যাপক), হরিণখাইনের নুরুল আফসার (পটিয়া পল্লী বিদ্যুতের পরিচালক), আলমগীর ও সিরাজ, চরকানাইর সৈয়দ ও নাজিম, নলান্ধার চেয়ারম্যান কাশেমের ছেলে, ওর নাম সম্ভবত জাহাঙ্গীর। মুজিব, হাকিম, আফসার, তাহের আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী। তাঁরা প্রত্যেকেই ছাত্রজীবনে বিখ্যাত ছাত্রনেতা ছিলেন; জেলাব্যাপী তাঁদের পরিচিতি ও প্রভাব ছিলো। আবু তাহের চৌধুরী বর্তমানে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি। তাদের পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত অনেক ব্যাচ কলেজ থেকে পাস করেছে এবং তাদের মধ্য থেকে নিশ্চয়ই অনেক ছাত্রনেতার উত্থান ঘটেছে। কিন্তু আমি তাদের নাম জানি না। সেজন্য তাদের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না বলে আমি তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
কলেজের স্বাধীনতাপরবর্তী চারজন অধ্যক্ষ এবং ছ’জন অধ্যাপকের নাম আমি শুনেছি। তাঁরা হলেন, প্রথমে আমার শিক্ষক বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্যের কথা বলতে হয়; অধ্যক্ষ জে এল দে স্বাধীনতার পরে বেশিদিন ছিলেন না তাঁর পরে বিভূতিবাবু ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন। তারপরে অধ্যক্ষ সম্ভবত মোশতাক আহমদ; তিনি রামুর অধিবাসী, ইংরেজিতে দক্ষ শিক্ষক। মোশতাক আহমদের পরে অধ্যক্ষ হন জনাব নুরুদ্দিন চৌধুরী, জনাব ওয়াজিউল্লাহ, এরপরে বিভূতি ভূষণ ভট্টাচার্য্য পুররায় অধ্যক্ষ হন। তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত আমৃত্যু অধ্যক্ষ ছিলেন। এরপরে অধ্যক্ষ হন ফেরদৌস চৌধুরী ও দিদারুল আলম। কলেজের ছয় অধ্যাপকের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক নাসিরুল হক, অধ্যাপক অলক দত্ত, বন্ধুবর অধ্যাপক ফাউজুল কবির, অধ্যাপক সঞ্জীব বড়–য়া, অধ্যাপক স্বরূপানন্দ, অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী ও অধ্যাপক নারায়ণ চৌধুরী।
অধ্যাপক নাসিরুল হক সাহেব পরে অধ্যাপনা ছেড়ে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করলে আমার সহকর্মী হয়ে যান। তিনি দীর্ঘদিন আজাদীতে সাংবাদিকতা করার পর সুপ্রভাত এবং আরো কোন কোন পত্রিকায় কাজ করে বর্তমানে একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
অধ্যাপক ফাউজুর কবির এককালে সাংবাদিকতাও করেছেন। তবে সাহিত্যই তাঁর প্রতিভার স্ব-ক্ষেত্র, যেখানে তিনি স্বচ্ছন্দ ও সৃজনপ্রসূ। গদ্য-পদ্য উভয় ক্ষেত্রে তাঁর সমান অধিকার। তাঁর গদ্যের হাত শক্ত, পদ্যে তিনি স্বতঃস্ফূর্ত বলা মুস্কিল। তাঁর গদ্য ওজনদার, গম্ভীর এবং ওজস্বিতাপূর্ণ। কবিতাও তার চিন্তার বাহন। কবির আবেগ, অনুভূতি, সংবেদনশীলতা, কল্পনা অবশ্যই তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা কিন্তু আমি বলবো মালার্মের মতো তাঁর কাছেও শব্দই কবিতা। হাল্কা, চটুল চালের কবিতা প্রায় লেখেন নি বলেই চলে; কবিতায়ও তিনি বেছে বেছে তৎসম, ওজনদার শব্দ প্রয়োগ করেন। তিনি শুধু ভাবুক নন, চিন্তাশীল কবিও।
অধ্যাপক সঞ্জীব বড়য়া বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী; তিনি মূলত সৃষ্টিশীল মানুষ। অধ্যাপনা ছাড়া কবিতা, ছড়া লেখেন, নাট্যচর্চা করেন।
অধ্যাপক নারায়ণ একজন উঁচু মানের সংগঠক; তিনি সম্ভবত আমার শিক্ষক অধ্যক্ষ বিভূতিভূষণ ভট্টাচার্যের প্রেরণায় ধর্মসংস্কারে নিয়োজিত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আবার কলেজেই অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন নারায়ণ চৌধুরী ও আবু তাহের চৌধুরী। শিক্ষক হিসেবেও তাঁরা সুনাম অর্জন করেন। অধ্যাপক আবু তাহের চৌধুরী খুব ভালো সংগঠক।