হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় ৪ জনের মৃত্যুদন্ড

18

ঢাকা প্রতিনিধি

দেড় যুগ আগে একুশে বইমেলার বাইরে বহুমাত্রিক লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার ঘটনায় চার জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আল-মামুন গতকাল বুধবার দুপুরে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। সর্বোচ্চ সাজার পাশাপাশি চার আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন তিনি।
দন্ডিত আসামিদের মধ্যে কারাগারে থাকা দুই আসামি নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) শুরা সদস্য মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন এবং আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
বাকি দুই আসামি নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু এবং সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ পলাতক।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা চলে। দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নষ্ট করার জন্যে এবং ধর্মান্ধতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আসামিরা নৃশংসভাবে হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়েছিল।
নিয়ম অনুযায়ী এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে সাত দিন সময় পাবেন আসামিরা। তবে আপিল করতে হলে পলাতক আসামিদের আত্মসমর্পণ করতে হবে।
বিজ্ঞানমনস্কতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পক্ষে লেখা হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হয়েছিলেন একুশে বইমেলা চলাকালে। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি রাতে বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে টিএসসির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীর চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হন তিনি।
দেশে লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, মুক্তমনা মানুষের ওপর বিগত বছরগুলোতে যে ধারাবাহিক জঙ্গিবাদি হামলার ঘটনা বাংলাদেশ দেখেছে, তার সূচনা হয়েছিল হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে।
কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ওই বছর আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। পরে ১২ আগস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
হামলার পরদিন হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন। আদালতের আদেশে অধিকতর তদন্তের পর তা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। সেই মামলার রায় হল বুধবার।
প্রেক্ষাপট
ভাষা বিজ্ঞানী, বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ তার লেখার কারণেই প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। ২০০৪ সালে তার ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে মৌলবাদীরা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তখন বাংলাদেশের ক্ষমতায়। আর বইটির প্রেক্ষাপট ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে জামায়াতে ইসলাম এ দেশে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল।
সে সময় জামায়াতের এমপি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, যিনি পরে যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদের বইটি নিষিদ্ধেরও দাবি তুলেছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ সে সময় নানাভাবে সা¤প্রদায়িক হুমকি পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু একুশে বইমেলার বাইরে এভাবে তাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করা হবে, সেটা কেউ ভাবেনি।
ওই হামলার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ইসলামি জঙ্গিরা হুমায়ুন আজাদের ওপর ওই হামলা চালিয়েছিল।

তদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, জার্মানি থেকে পাঠানো হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু সনদ এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, অ্যানাটমিক্যালি মৃত্যুর যথেষ্ট কারণ পাওয়া না গেলেও টর্চারের (নির্যাতনের ফলে) ফলে তার মৃত্যু ঘটেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এবং হাইপার টেনশনে তিনি মারা যান।
জার্মানির মিউনিখ হাসপাতালের অটোপসি রির্পোট পর্যালোচানায় দেখা যায়, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির ওই তারিখে ঘটনার দিন মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি অসুস্থ ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসার পরও আরোগ্যপ্রাপ্ত না হয়ে বরং তিনি ধীরে ধীরে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখের বাসস্থানে যাওয়ার চারদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

বিচারের দীর্ঘ অপেক্ষা
প্রথমে দায়ের করা হত্যা চেষ্টা মামলায় পুলিশ ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়ে বাদী মঞ্জুর কবির ২০০৯ সালের অক্টোবরে অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন।
সেই আবেদনে তিনি বলেছিলেন, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটি প্রকাশের পর ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সংসদে বইটির সমালোচনা করেন, কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা তার বিষয়ে তদন্ত করেননি। অপরাধী চক্র একটি বৃত্তি দিয়ে হুমায়ুন আজাদকে জার্মানিতে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি হত্যার শিকার হন।
হুমায়ুন আজাদ নিজেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় হামলার পেছনে মৌলবাদী সংগঠন এবং যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর জড়িত থাকার ইংগিত করেছিলেন সাংবাদিকদের কাছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেন।
সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ১৪ মে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে হত্যার অভিযোগ যুক্ত করে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
মো. মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন ওরফে হামিম ওরফে হাসিম, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জে এম মবিন ওরফে সাবু, সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ এবং হাফিজ মাহমুদ ওরফে রাকিব ওরফে রাসেলকে সেখানে আসামি করা হয়।
তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় আসামির তালিকা থেকে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী, ছাত্রলীগ নেতা আবু আব্বাস ভূঁইয়া, গোলাম মোস্তফা ওরফে মোস্তফা মাহমুদ, আবদুল খালেক গবা ওরফে টাইগার, শফিক উল্লাহ ওরফে সাদ এবং ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, আতাউর রহমান সানি, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও খালেদ সাইফুল্লাহর নাম সম্পূরক অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূইয়া জিন্নাহ ২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সম্পূরক অভিযোগপত্রের পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচার শুরুর আদেশ দেন।
আসামিরা নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তাদের মধ্যে মিনহাজ ও আনোয়ার কারাগারে আটক রয়েছেন। নূর মোহাম্মদ শুরু থেকেই পলাতক।
সালাহউদ্দিন সালেহীন ও হাফিজ মাহমুদ গ্রেপ্তার হলেও ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নিয়েছিল জঙ্গিরা। সালেহীন পালিয়ে যেতে পারলেও হাফিজ মাহমুদ পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
গত ২৭ মার্চ দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে এ মামলা রায়ের পর্যায়ে আসে। গতকাল বুধবার সেই রায়ে জীবিত চার আসামির সবাইকে মৃত্যুদন্ড দিলেন আদালত।