স্বাগতম বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ চিরায়ত ঐতিহ্যকে ধারণ করে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে উঠুক

17

আজ ১৪৩০ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ। বাঙালির প্রাণের উৎসব আজ। শুভ নববর্ষ। বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জীবনে বছরের যে কয়েকটি দিন সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট-বেদনা, পুরাতন-জীর্ণতা, গøানিকে ভুলিয়ে অন্তরের অন্তঃস্থলে এক নব আনন্দ-উচ্ছ¡াসের সমাবেশ ঘটায়, সেই দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলা নববর্ষের সূচনাকাল- পহেলা বৈশাখ। এ দিনটি উদযাপনে বাঙালির উচ্ছ¡াসের কমতি থাকে না। গতকাল সূর্য স্তমিত হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি জীবনে একটি বছরের ইতি টেনেছে। সেই সাথে নতুন বছরের সুচনা হচ্ছে আজ। চট্টগ্রামের সিআরবি, ডিসি হিল, ফয়েজলেক, সী-বিচ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যালি, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপন করা হবে দিনটি। তবে পবিত্র রমজান ও জুমার দিন হওয়ায় কর্মসূচিগুলো পালনে সতর্ক এবং ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
বৈশাখ মানে নতুন বর্ষের নতুন ঋতুর সূচনায় নয় শুধু, বাঙালি মননে এক পুলক আনন্দ উৎসারিত হওয়ার দিন। মাছ-ভাতে বাঙালি এ চিরায়ত সত্যকে কিছুটা সময় হলেও নগরজীবনে চর্চা হয় পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। কিন্তু করোনা মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুনকরে বৈশ্বিক যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার রেশ বাংলাদেশেও পড়েছে। সংগতকারণে বলা যায়, বাংলা নববর্ষের সূচনাক্ষণ এমন এক সময় আমাদের দ্বারে উপস্থিত যখন সারা দেশজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দরুন জনজীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা বিরাজ করছে। সেই সাথে এখন চলছে পবিত্র রমজান মাস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপনকে কেন্দ্র করে সেসব দেশে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বিশেষ মূল্যছাড়ের রেওয়াজ সুদীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত রয়েছে। যাতে করে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই সেসব সার্বজনীন উৎসব আনন্দের সঙ্গে সাগ্রহে পালন করতে পারে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সারা বছর ধরে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে কখন আসবে রমজান মাস, কখন আসবে ঈদ, কখন আসবে পহেলা বৈশাখ, কখন আসবে দুর্গোৎসব। এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রত্যেকটি দ্রব্যসামগ্রীর অবিশ্বাস্য দাম বাড়িয়ে ক্রেতা সাধারণের ঘাড় কেটে অবৈধ মুনাফা লুটবে; এটা এখন আমাদের দেশের অসাধু ব্যবসায়ী সমাজ রেওয়াজ আর আমরা ক্রেতাসাধারণ তা ভাগ্যের লিখন বলে মেনে নিয়েছি।
পৃথিবীর প্রতিটি জাতিসত্তার কাছেই সেই জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিগত নতুন বছরের সূচনাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গেই দেখা হয়। বাঙালিরাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তাই পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির জীবনে সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যমÐিত একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাংলা নববর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে, পাতাঝরা উষ্ণতম রসকষহীন মাস চৈত্রের বিদায়বার্তা বহনকারী চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখের সূচনার মধ্য দিয়ে বাঙালি নতুন বছরকে আপন মনে বরণ করে নেয়। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে নববর্ষ অত্যন্ত আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে উদযাপিত হয়ে থাকে। এ উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এ ছাড়া আমানি উৎসব, হালখাতা, গাজনের গান, গাঙ্গিখেলা, ঘোড়ার দৌড় ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান বিভিন্ন অঞ্চলভেদে এখনও উদযাপিত হয়। মোঘল স¤্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলার কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনকে মূলভিত্তি ধরে প্রথম বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ১৬১০ সালে যখন ঢাকাকে সর্বপ্রথম রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হয় তখন রাজস্ব আদায় আর ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ শুরু করার জন্য পহেলা বৈশাখকে স¤্রাট আকবরের অনুকরণে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি তার বাসভবনের সামনে সব প্রজার শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ এবং বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই পহেলা বৈশাখ আজও আমাদের কাছে অতুলনীয় আনন্দের একটি দিন। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বাংলা নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, একসময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল কৃষির। কারণ কৃষিকাজ ছিল বিশেষ ঋতুনির্ভর। ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যতœ বা পরিচর্যা, ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন-তারিখ পঞ্জিকা অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা হতো। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে অনুষ্ঠিত হরেক রকম মেলার দিন-তারিখও নির্ধারিত ছিল বাংলা সনের সঙ্গে। শুধু ফসল আর উৎসব নয়, বাঙালি কৃষকের পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম, বিবাহ, জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের সব বিষয়েই বাংলা সন ছিল একক ও অনন্য। কিন্তু নগরজীবনে পহেলা বৈশাখ পালনে যত তোড়জোড় বাংলা সনকে মর্যাদা দিতে তেমনটি আগ্রহী বলে মনে হয়না। সম্প্রতি সরকার নতুন শিক্ষাক্রমে বাংলা নববর্ষকে যুক্ত করেছে। এদিনের তাৎপর্য ও উৎসবের বিষয়ে শিক্ষার্থীরা একটি ধারণা লাভ করবে। তবে পড়া নয় শুধু চর্চায় হচ্ছে মূল কথা। এ কাজটি করতে হবে অভিভাবকদের। এছাড়া সম্প্রতি বাঙলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে কদাচিৎ যা হচ্ছে তা মোটেই কাম্য নয়। একটি জাতির সংস্কৃতি উৎসবকে ধর্মীয় আবরণে মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। পহেলা বৈশাখ মুসলিম শাসক স¤্রাট আকবরই সূচনা করেছেন, বাংলায় সুবেদার ইসলাম খাঁ তা বাস্তবায়ন করেছেন। সুতরাং নানা অযৌক্তিক বচনে না জড়িয়ে উৎসবকে সার্বজনীন রূপ দেয়ার মাধ্যমে একটি সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে উঠুক- এমনটি প্রত্যাশা সকলের।