সুপারবাগ

115

ইতিহাসের পাতায় খুঁজলেই পাওয়া যাবে সংক্রামক ব্যাধির মহামারীর গল্প-যা ধ্বংস করেছে একের পর এক শহর, জনপদ আর সভ্যতা। কলেরা, ম্যালেরিয়া আর যক্ষার মতো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছে কোটি মানুষের জীবন। স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং আবিষ্কার করেন প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দেওয়া এই ওষুধকে ডাকা হত ‘মিরাকাল ড্রাগ’। চিকিৎসাশাস্ত্রে পৃথিবীজুড়ে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে পেনিসিলিন।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাফল্যের অন্যতম হাতিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক, যার সাহায্যে কোটি কোটি রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু কোনো কারণে যদি এ অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করে তাহলে তা মারাত্মক বিপদের ইঙ্গিত করে। সম্প্রতি গবেষকরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনকারী জীবাণুর সন্ধান পাচ্ছেন, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সুপারবাগ হচ্ছে এমন এক ব্যাক্টেরিয়া যার বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করে না। ই-কোলি ব্যাক্টেরিয়ার সাথে যুক্ত এই সুপারবাগ প্রাথমিক অবস্থায় প্রস্রাবের রাস্তা অথবা শ্বাসনালীতে ক্ষত সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সুপারবাগ অন্যান্য গুরুতর ব্যাধির জীবাণুর সাথে যুক্ত হলে ওই রোগগুলোতে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না। উন্নত বিশ্বে সুপারবাগ এখন এক আতঙ্কের নাম। যদিও এটা অবধারিত যে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে এর বিরুদ্ধে একসময় না একসময় প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হবেই। কিন্তু আমাদের অসচেতনতা, স্বভাব এবং অবহেলার কারণে এসব প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার গুণ দ্রুতগতিতে।
আমরা না জেনে, না বুঝে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছি, এমনকি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই। ডাক্তাররাও প্রায়শই যথাযথ ল্যাব টেস্ট না করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছেন। ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে রোগের প্রকৃত কারণ বের না করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন দিলে তাতে চিকিৎসায় ভুল হওয়ার অনেক বেশি আশঙ্কা থাকে। আর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ না করা। গবেষণায় দেখা গেছে, অল্পমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে সহযোগিতা করে এবং পরবর্তীতে বেশি মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলেও তাতে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকতে পারে। কাজেই অ্যান্টিবায়োটিকের সুপারিশকৃত ডোজ সম্পূর্ণ করা উচিত যাতে ব্যাকটেরিয়া সহজে প্রতিরোধী হয়ে উঠতে না পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ব্যতীত আরও যেসব দৈনন্দিন চর্চা অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তৃতিতে সহায়ক তা হল, ল্যাব টেস্টিং এবং মনিটরিংয়ের অভাব। হাসপাতালে বা নিজের বাড়িতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, রোগ সংক্রমণে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকা, ঘন ঘন হাত না ধোয়ার অভ্যাস, হাত ধুতে সাবানের ব্যবহার না করা, ঠিকভাবে হাত ধুতে না জানা, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব ইত্যাদি। অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে শুধুই সংক্রামক রোগ নয়, অন্যান্য অনেক রোগ যেমন ক্যানসার, আর্থ্রাইটিস এবং কিডনি রোগের চিকিৎসাও সম্ভব নয়। কেননা এসব ক্ষেত্রে রোগীকে এমন সব ওষুধ দিতে হয় যা আমাদের শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে ফেলে, যাতে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই এর সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিকভাবে। কোনো এক দেশ এককভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কেননা উন্নত যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সারা বিশ্বের মানুষ এখন একই সূত্রে বাঁধা। দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যতই নিশ্ছিদ্র হোক না কেন, সাদা চোখে অদৃশ্য, এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুপারবাগের প্রবেশ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
২০৫০ সালের মধ্যে যদি বিশ্ব জরুরি পদক্ষেপ না নেয় তাহলে ব্যাকটেরিয়া সুপারবাগ প্রতি তিন সেকেন্ডে একজনকে হত্যা করবে। সুপারবাগ থেকে বাঁচার জন্য বর্তমানে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে গণহারে প্রচারণা চালাতে হবে। বর্তমান বিশ্বে ওষুধ ব্যবহার করে ইনফেকশন থেকে বাঁচার পদ্ধতি খুব দ্রæত অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
সুপারবাগ বা ব্যাকটিরিয়া বাড়িতেও ঘাঁটি গাড়তে পারে। শুধুমাত্র পঁচা বা বাসি কোনো বস্তু থেকে নয়, বাজার থেকে আনা কাঁচা মাংস থেকে হতে পারে এই সুপারবাগ। বাজারে যে কাঁচা মাংস বিক্রি হয় তাতে ব্যাকটিরিয়া থাকতে পারে। তাই এ থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হলে ব্যাকটিরিয়াগুলো মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। ফলে মানুষ সহজেই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়। ফ্রিজে দীর্ঘদিন ধরে বেশি মাংস সংরক্ষণ করা উচিত না। কেননা যে তাপমাত্রায় অল্প মাংস রাখা উচিত, সে তাপমাত্রায় বেশি পরিমাণ মাংস সংরক্ষণ করলে রান্না করার সময় ব্যাকটিরিয়া মরে যাওয়ার বদলে গাণিতিক হারে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে বোর্ডে সবজি বা মাংস কাটা হয় সেটি কাঁচের হলে ভালো। প্লাস্টিক বা কাঠের বোর্ড থেকে সহজেই ব্যাকটিরিয়া অন্য খাবারে চলে যায়। কাঁচা মাংস, মাছ, সবজি বা সালাদের জন্য আলাদা বাসন-পত্র ব্যবহার করা উচিত। রান্না হলে জীবাণুগুলো যেমন মরে যায়, তেমনই কাঁচা খাবার থেকে ছড়িয়ে পড়া ব্যাকটিরিয়া সুপার ব্যাকটিরিয়ার পরিণত হয়। আসলে এ সব খাবার রান্নার পর আবারো যদি কাঁচা খাবার নাড়ার কোনো আসবাব দিয়ে খাবার নাড়া-চাড়া করা হয়, তবে ব্যাকটিরিয়া রান্না করা খাবারে প্রবেশ করে। বেশিরভাগ জীবাণু ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াম তাপামাত্রায় মরে যায়। তাই কাঁচা মাংস সঠিকভাবে রান্না করা হয়েছে কিনা, তা ভালোভাবে দেখে নিতে হবে। মাইক্রোওয়েভে রান্না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব জীবাণু মরে যাবে কিনা তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই। রান্নার আগে এবং পরে গরম পানি এবং সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ধোয়া উচিত। এছাড়া মাছ, মাংস কাটা এবং ডিম ফাটানোর পর সাথে সাথে হাত ভালো করে ধোয়া জরুরি। তা না হলে গøাভস ব্যবহার করলে ভালো হয়। রান্না ঘরের বাসন-পত্র ও আসবাব গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত। এছাড়া কাঁচা মাছ, মাংস যেসব বাসনে রাখা হয়েছিল, সেগুলো ডিশওয়াশারের ভেতর ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ধোয়া অত্যন্ত জরুরি।
তিন বছর গবেষণার পর মেলবর্ণ ইউনিভার্সিটির ২৫ বছর বয়সী ছাত্রী সু ল্যাম এর দাবী অ্যান্টি বায়োটিক ছাড়া তিনি সুপারবাগ মারার পন্থা আবিষ্কার করেছেন যার পরীক্ষা ইঁদুরের উপর সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। এই সুপারবাগগুলির উপর অ্যান্টি বায়োটিক কোনো কাজ করে না। অ্যান্টি বায়োটিক প্রতিরোধক সুপারবাগগুলি বছরে ১৭০,০০০ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউনাইটেড নেশান স¤প্রতি একে সাস্থ সংক্রান্ত “মৌলিক হুমকি” বলে ঘোষণা করেছে। খুব শীঘ্র এর সমাধান না করতে পারলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখিন হতে হবে। বৈজ্ঞানিকরাও এই সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছেন। সু ল্যাম বিশ্বাস করেন যে তিনি এই স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভয়ঙ্কর সমস্যার সমাধানের চাবি পেয়ে গেছেন এবং তাঁর দল তারকাকৃতি পেপটাইড পলিমার উদ্ভাবন করেছেন যা ঐ অপ্রতিরোধ্য সুপারবাগগুলির কোষ প্রাচীর ছিঁড়ে ফেলে ও সুপারবাগগুলিকে মেরে দেয়। ল্যাম এর এই আবিষ্কার সম্প্রতি নেচার মাইক্রোবায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। পরীক্ষাগারে ও ইঁদুরের উপর সফল হলেও অনেক পথ বাকি। ল্যামের বিশ্বাস খুব শিঘ্রই তারকাকৃতি পেপটাইড পলিমার এসে অ্যান্টি বায়োটিকে জায়গা দখল করবে।