শোক ও শ্রদ্ধা লড়াকু বীর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চির বিদায়

22

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই। গত ১১ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত সোয়া ১১ টায় ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তিনি মারা যান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে মুক্তিযুদ্ধে আহত ও গরীব অসহায়দের স্বাস্থ্য চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেন ডা. জাফরুল্লাহ। সেই সময় থেকে শুরু করে মৃত্যুও আগ পর্যন্ত আজীবন লড়াই করে গেছেন তিনি। ডা. জাফরুল্লাহর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক ও রাজনীতিবীদ এ তিন পরিচয়কে ছাপিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হয়ে উঠেন সত্য, সুন্দর ও গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর। ‘চিকিৎসা মানুষের অধিকার, ব্যবসা নয়’- এ কথা আমৃত্যু বলে গেছেন তিনি। বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস-এ এফআরসিএস-এর গবেষণাকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। দেশ প্রেমিক জাফরুল্লাহ চৌধুরী চূড়ান্ত পর্ব শেষ না-করে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্তে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন এবং এরপরে ডা. এম এ মবিনের সাথে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন।। মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এই অঞ্চলে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে।
জানা যায়, ওই সময় অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নার্সিং করার জন্য ঈস্খস্তু করেছিলেন। তার অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ওই ফিল্ড হাসপাতাল ঢাকার ইস্কাটন সড়কে পুনঃস্থাপিত করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে গ্রামকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু রূপে গড়ে তোলার জন্য ‘চল গ্রামে যাই’ ¯েøাগান ও উদ্দেশ্য নিয়ে হাসপাতালটি সাভারে স্থানান্তরিত করেন তিনি। এসময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য জায়গা বরাদ্দ নিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হলে বঙ্গবন্ধু নিজেই সেই জাযগা বরাদ্দের ব্যবস্থা কওে দেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই হাসপাতালটির নামকরণ করেন ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে তিনি গণমানুষের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ডা. জাফরুল­াহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করেছিলেন। যে কাজ নারী ‘পারে না’ বলে ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেসব কাজে তিনি নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। ইলেকট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ড্রাইভার হিসেবে নারীদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই প্রথমে সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে। ১৯৮১ সালে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক ‘গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল’। অন্য সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ওষুধের চেয়ে গণস্বাস্থ্য উৎপাদিত ওষুধের দাম প্রায় অর্ধেক। যেমন কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্যে অপরিহার্য ইনজেকশন ‘হ্যাপারিন’। বাজারে দাম ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিতটির দাম ২০০ টাকা। সারা পৃথিবীতে কোলেস্টেরল কমানোর জন্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওষুধ ‘অ্যাট্রোভাসটাটিন’। গণস্বাস্থ্যে উৎপাদিত একটি ট্যাবলেটের দাম ৭ টাকা, অন্যদের উৎপাদিতটির দাম ১১ টাকা। সাভারের পর ১৯৯৫ সালে ঢাকার মিরপুর রোডে চালু হয় গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। এ ছাড়া কক্সবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে ৫০টির মতো। সেখানে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, প্যারামেডিক উপস্থিত থাকেন।
মহামারী করোনাকালেও তিনি ও তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অবদান রেখে গেছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ২০২০ সালের ১৯ মার্চ করোনাভাইরাস শনাক্ত করার কিট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় রি-অ্যাজেন্ট আমদানির সরকারি অনুমোদন পায়। ২০২০ সালের ২৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার্স ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) কাছে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট বøট’ হস্তান্তর করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রামন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাইভহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান তিনি।
ডা. জাফরুল্লাহর রাজনৈতিক জীবনটিও ছিলো স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে তার উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নেয়ার মহান উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন করাতে সক্ষম হন। বাংলাদেশ এখন ওষুধ রপ্তানিকারক দেশও। বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রেখেছেন। আমরা এ মহান সূর্যসৈনিকের বিদায়ে গবীরভাবে শোকাহত। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।