শীত ও বুড়ি

65

 

কাপড় বিতরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। যত না কাপড় তারচেয়ে বেশি অনুষ্ঠান।
একটা বড় সামিয়ানার তলে ক’জন নেতা ব্যস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে। একটি টেবিলে শীতের জামার স্তুপ। তাদের চারপাশে ডজন খানেক ক্যামেরাম্যান। সবাই ব্যস্ত পায়ে ছোটাছুটি করছে।

তাদের সামনে যবুথবু বসে আছে গরিব দুখী নারী-পুরুষেরা। তারা শীতে কাঁপছে।
অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন তারা।
‘এই, বাবারা তোমরা কাপড় দিবা কোন সোময়। ঠান্ডায় শইল্যে কারফি উঠছে।’ এক দুর্বল মহিলা বলল।
নেতারা দুহাত বাড়িয়ে বারবার বলছে, ‘শান্ত হোন, আপনারা অধৈর্য হবেন না, কাপড় পাবেন সবাই। প্লিজ, আপনারা চুপ করে বসুন। বড় নেতা আসছেন। তাঁর হাত দিয়ে বিতরণ হবে কাপড়। আজ আপনারা বড় ভাগ্যবান।’

ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে দুর্বল বুড়ি সামিয়ানার তলে গিয়ে বলল, ‘বাবারা আর টিকতে পারছি না। একটা কাপড় দিলে গায়ে দিয়ে বসি।’
নেতাটি বলল, আরে বলেন কি, বড় নেতার হাতে কাপড় নিবেন। এই সুযোগ পাবেন কই?’
বুড়ি বলল, কেন আপনেগর হাত নাই। দিলে দেন না দিলে যাইগা। ঠান্ডায় শইল জইম্যা যাইতাছেগা।’
মাথা কাৎ করে দুই আঙুল এক করে নেতাটি বললেন, প্লিজ আর একটু…।

দুই.
বড় নেতা এলেন। তিনি দামি গাড়ি থেকে নামলেন। নেতা ও কর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে সামিয়ানার তলে এলেন। কর্মী ও ক্যামেরাম্যানদের ব্যস্ত ছোটাছুটি। অসংখ্য কণ্ঠে দৃপ্ত শ্লোগান উঠল ‘আমার ভাই, তোমার ভাই, জনদরদী … ভাই’।
শ্লোগান আর হাততালির শব্দে গোটা এলাকা কেঁপে উঠছে। এই পবিত্র আনন্দ উৎসবের ভেতর দিয়ে কাপড় বিতরণ সভার কাজ শুরু হয়ে গেল।

বুড়ির ডাক পড়লো। কর্মীরা সমাদর করে যত্নের সাথে বুড়িকে সামনে নিয়ে এলো।
বুড়িকে নানা ঢঙ্গে দাঁড়াতে বলল ক্যামেরাম্যানরা।
শীতে প্রায় জমে গেছে বুড়ি। নেতার হাতে একজন একটা কাপড় তুলে দিলো। ক্যামেরার সুবিধা মতো করে কয়েকজন বুড়িকে ধরে নানাভাবে দাঁড় করালেন। নেতা কাপড় হাতে নিয়ে বুড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। বুড়ি কাপড় নিয়ে চলে আসতে চায়। নেতা কাপড় ছাড়ে না।
দুর্বল বুড়ি কাপড় ধরে ভিড়ের চাপে বলে উঠল, ‘মরণ, ইত্তা কী করতাছেন আফনেরা, কাপড় ছাড়েন না কেরে।’
নেতা কান পর্যন্ত লম্বা হাসি মেলে ধরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর ডান-বাম থেকে ক’জন কর্মী এসে বুড়িকে ঘিরে ধরে বলছে, চাচি হাসেন, হাসেন, ফটু উঠতাছে, হাসেন।’
চাচি একটু হাসি দিয়ে কাপড়টা টেনে ধরে বলে, ‘এলা ছাড়েন।’
নেতা বলল, রাখেন, রাখেন। আপনার হাসিটা চিমসে গেছে চাচি। বড় নেতার সাথে ফটো উঠতাছে, বড় করে একটা হাসি দিয়া রাখেন, কালকে পত্রিকায় ছবি ছাপবে, আপনি দেখবেন, সারা দুনিয়া দেখবে।’
চাচি ভিড়ের চাপে অস্থির। রেগে মেগে বললেন, ‘আমার গায়ে এত তেল নাই যে হাসি দিয়ে থাকুম। বড় হাসি দিমু ক্যামনে, ঠোঁট ফাইট্টা বাঙ্গি হইয়া আছে। হের পরেও হাসি দিছি হেই কোন সোময়। খালি আজাইড়া কথা। এতখন আবার হাসি মাইরা থাহে ক্যামনে?’
একজন বলল, দেখছেন না, নেতা যে ক্যামনে হাসি মাইরে আছে, আপনিও এভাবে বড় কইরা হাসেন, ফটো উঠতাছে।’
চাচি অনেক কষ্ট করে আবার হাসি মেলে ধরলেন।
অসহায় দুর্বল ও ক্ষীণকায় বুড়িকে কাপড় বিতরণ করা হচ্ছে এমন ছবি স্মরণীয় করে রাখার জন্য নেতার পেছনে ডানে বামে ছবি তোলার জন্য প্রচন্ড ভিড়।
বুড়িকে ঘিরে ধরে কাপড়ে হাত লাগিয়ে নেতা-কর্মীরা একের পর এক ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছে।
আর ক্যামেরাম্যান রেডি, রেডি, ওকে, ওকে বলছে। সবার মুখে লম্বা হাসি। ক্যামেরা জ্বলে উঠছে। ক্লিক্ ক্লিক্ ক্লিক্।

তিন.
হঠাৎ ক্যামেরার আলো নিভে গেল। ব্যাপার কী!
বুড়ি কই? বুড়ি কই!
ডানে বামে কোথাও বুড়ি নেই।
অনুষ্ঠান শেষ হলো। নেতারা কাপড় বিতরণ সভা শেষ করে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন। নিচে পড়ে আছে বুড়ি। তাঁর বাড়ি ফেরা হলো না।