শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ, আগ্রাবাদের সৈয়দবাড়ি ও একজন প্রতিবাদী মা

17

জামাল উদ্দিন

সৈয়দা রেজোয়ান বেগম আগ্রাবাদ ভাÐার মার্কেটের মালিক সৈয়দ আবু সিদ্দিকের স্ত্রী। সৈয়দ আবদুল গনি ও সৈয়দ মাহমুদুল হকের মাতা। সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়ার ফুফু। তিনি একজন সাধারণ গৃহিণী। এই মহীয়সী নারীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ। একাত্তরে তাঁর মাতৃসুলভ অন্যান্য ভ‚মিকার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। মৌলভী সৈয়দ সম্পর্কে তাঁদের আত্মীয় হলেও রেজোয়ানা বেগমের সাথে মৌলভী সৈয়দ আহমদের সম্পর্ক ছিল মা এবং ছেলের। যাকে তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। আত্মীয়তা এবং মুক্তিযুদ্ধের সূত্র ধরে দুই পরিবারের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ ভাই রিজোয়ানা বেগমকে খালা বলে ডাকতেন। সৈয়দ আবদুল গণি ও সৈয়দ মাহমুদুল হক ও সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়া মৌলভী সৈয়দ আহমদকে আপন ভাইয়ের মত জানতেন এবং তারাও মৌলভী সৈয়দ আহমদের মাকে খালা এবং তার পরিবারকে নিজেদের পরিবার ভাবতেন। মৌলভী সৈয়দ আহমদ যুদ্ধ পরবর্তীতে উত্তর আগ্রাবাদ মুহুরীপাড়াস্থ বার্ডস কোম্পানির অবাঙালির বাড়িটা সরকার থেকে লিজ নিয়েছিলেন। তাঁর মা/ছোট বোন মনোয়ারাও সেখানে থাকতেন। সৈয়দ ভাইয়ের খালা হিসেবে সৈয়দ ভাইয়ের সাথে জড়িত মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা সবাই রিজোয়ানা বেগমকে খালা ডাকতেন। তিনিও প্রত্যেককে স্নেহের চোখে দেখতেন। রিজোয়ানা বেগমের পুরো পরিবার ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী এবং ছেলেদের সবাই আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগ এর সাথে জড়িত। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মাহমুদুল হক জানালেনÑএকটা সময় আসলো সৈয়দ ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে হবে। সেই দায়িত্ব দেওয়া হয় মাকে। মা পাত্রী দেখলেন সৈয়দ ভাইয়ের সাথে গেরিলা যুদ্ধে সহযোদ্ধা হিসেবে অংশ নেওয়া মিস্ত্রীপাড়া নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন হাজি মিয়ার ভাতিজি কামরুন্নেসাকে। কথাবার্তা সব ঠিক ঠাক বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক, বিয়ের আনন্দ সবার মাঝে। এমন সময় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় তৎকালীন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনিকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সৈয়দ ভাই ঢাকা থেকে ফিরে আর মুহুরী পাড়ার বার্ডস কোম্পানির বাসায় যাননি, এসে আমাদের আগ্রাবাদ শেখ মুজিব রোডস্থ ভাণ্ডার মার্কেটের বাসায় আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে সৈয়দ ভাইয়ের নেতৃত্বে শুরু হলো প্রতিশোধের প্রতিরোধযুদ্ধ, আমাদের বাড়িটা হয়ে উঠলো প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ঘাঁটি, মেজ ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুল গণির কর্ণফুলী মার্কেটস্থ শাপলা টেইলার্স ছিল যোগাযোগের মূলকেন্দ্র। আমরা ভাইয়েরা পাহারাদার থাকতাম। প্রতিদিন চট্টগ্রাম শহর ও জেলার অনেক নেতা-কর্মী সৈয়দ ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য আসতেন। তাদের চা-নাস্তা/খাওয়া-দাওয়া দায়িত্ব মা একাই সামলাতেন। আলাপ-আলোচনা হত কীভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া যায়। এর মধ্যে সৈয়দ ভাই ভারত যাওয়া-আসা শুরু করলেন। চট্টগ্রাম এসে আমাদের বাড়িতে থাকতেন, রাতে স্থান বদল করতেন। কখনো মসজিদের ছাদে কখনো পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংএ, কখনো বা আমাদের আত্মীয়দের বাসায়। দিনে দিনে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো এর মধ্যে কিছু জায়গায় ছোট-খাট অপারেশন হলো। সৈয়দ ভাই আমাদের বাসায় শেষবার আসেন ১৯৭৬ সালের নভেম্বরের প্রথম দিকে ৫ নভেম্বর। সেদিন সৈয়দ ভাইকে সকাল থেকে অস্থির দেখাচ্ছিল। বিকেলে সৈয়দ ভাই আমাকে বললেন, সন্ধ্যার দিকে নিউ মার্কেটের আশপাশে,কোনো ঘটনা হলে আমাকে জানিও। আমি যথারীতি নিউমার্কেটের পাশে অবস্থান নিই, সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলো আর প্রচÐ বিস্ফোরণ এর শব্দ হলো। পরে শুনেছি চট্টগ্রাম শহরের চারটি স্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়েছে, আমি এসে সৈয়দ ভাইকে বললাম। সৈয়দ ভাই কিছুই বললেন না। মাকে বললেন খালা ভাত খাব। খাওয়া-দাওয়ার পর সৈয়দ ভাই কাপড়-চোপড় নিয়ে রাতেই আমাদের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় আমাকে বললেন তোমরা সাবধানে থেকো।
৭৬ সালের ৭ নভেম্বর আমার ফুফাতো বোনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সারারাত ওখানে ছিলাম। ভোরবেলা বাসায় এসে শুয়েছি, সকাল ৯টার দিকে দেখি আর্মি/পুলিশ আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না পুলিশ/আর্মি পাগলের মত মৌলভী সৈয়দকে খুঁজছে। আমি পালাবার চেষ্টা করলাম। ভাÐার মার্কেটের অর্ধেক পথে এসে ধরা পড়লাম। পরে জানলাম আমার মেজ ভাই সৈয়দ আবদুল গণিকে প্রথমে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদের বাসা থেকে আমার বাবা এবং পরে আমার মামতো ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়াকে গ্রেফতার করে। সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বাসায় আমার মায়ের সাথে খুব খারাপ আচরণ এবং গালমন্দ করে। সাহস না হারিয়ে মা ধৈর্য সহকারে তাদের প্রতিটি কথার উত্তর দিয়েছেন। সৈয়দ পরিবারের দেখভাল করার মতো কোন উপযুক্ত পুরুষ অবশিষ্ট নেই। বড় ছেলে সৈয়দ আব্দুস সাত্তার দেশের বাইরে ছিলেন। অন্য দু’ছেলে সৈয়দ আব্দুল জাব্বার ও সৈয়দ আব্দুর রহিমকে অন্যত্র সরিয়ে রাখেন। কেননা, তাদেরও সেনাবাহিনী বারবার খোঁজ করছিল। বাড়িতে আমার মা/ভাবী/খালাতো বোন ছাড়া কোন পুরুষ ছিল না। আমরা ক্যান্টনমেন্টে। মা একাই নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিয়েছে আমাদের খোঁজে। কিন্তু কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি। এমনকি শুধু মানুষ নয়, কুকুর বিড়ালও বোধ হয় আমাদের বাড়ি এড়িয়ে চলেছে।
এমতাবস্থায় রেজোয়ানা বেগম ডবলমুরিং থানা ও কোতোয়ালী থানায় খোঁজ নিয়ে স্বামী ও ছেলেদের না পাওয়ায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে যান। কিন্তু সেখানেও কোন খোঁজ বা কুলকিনারা করতে না পেরে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় কেউ সাহায্যের হাত বাড়াতে আসেননি। তিনি কোন আত্মীয়র বাড়িতে বা কোন নেতার বাড়িতে গেলে তাঁর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিত। বড় নেতারা এমনও বলেছিল যে, তোমাদেরকে কে বলছে যে, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় ৪ নেতা হত্যাকাÐের প্রতিবাদ বা প্রতিশোধে এগিয়ে আসতে। যাই হোক তিনি স্বামী ও পুত্রদের খোঁজে দিনরাত হন্য হয়ে দিশাহারার মতো কখনো নেতাদের কাছে কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ছুটে যান। খবর পান যে, তাদেরকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে রাখা হয়েছে। সেনানিবাস থেকে ১০/১২ দিন পর সৈয়দ আবু সিদ্দিক ও সৈয়দ মাহমুদুল হক ও সৈয়দ মোহাম্মদ জাকারিয়াকে কোতোয়ালী থানায় এনে কোর্টের মাধ্যমে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী। কিন্তু রেজোয়ানা বেগম দীর্ঘদিন পুত্র সৈয়দ আবদুল গনির খোঁজ না পাওয়ায় বারবার চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গিয়েও ব্যর্থ হন। বাইরে প্রচার করা হয়, সৈয়দ আবদুল গনিকে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে আবার তিনি কোর্টে আইনজীবী নিয়োগ করে ডিভিশনের ব্যবস্থা করেন এবং মামলার খবরাখবর রাখতে থাকেন। এসময় আত্মীয়-স্বজনের কারো সাহায্য না পেয়ে রেজোয়ানা বেগম শাপলা টেইলার্সের প্রধান কাটার মাস্টার মিলন চৌধুরীকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে থাকেন। ভাÐার মাকের্টের বাসায় কোন আত্মীয়-স্বজন বা বহিরাগত কাউকে যেতে দেওয়া হতো না। সব সময় সিভিল ড্রেসে সেনাবাহিনীর লোক থাকতো। সে এক রুদ্ধশ্বাস জীবন কেটেছে তাঁর। কোনোদিন ১ ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। ইতোমধ্যে কিছু টাউট-বাটপার তথ্য দেবে বলে তার কাছ থেকে টাকাও আত্মসাৎ করে। তারমধ্যে লালদিঘির সিটি স্টোরের ফজল আহমদ অন্যতম। দীর্ঘ ১ মাস দৌড়ের পর তিনি খবর পেলেন পুত্র গনিকে কোতোয়ালী থানায় আনা হয়েছে। কোতোয়ালীতে গিয়ে তিনি গনির সাথে দেখা করেন। জানুয়ারির প্রথম দিকে গনিকে কোতোয়ালী থানা থেকে ৩টি মামলা দেখিয়ে চট্টগ্রাম জেলে প্রেরণ করা হয়। জেলে থাকা অবস্থায় ১৫ দিন পর পর সবার সাথে রেজায়ানা বেগম দেখা করতেন কোর্টে। জেলে দেখা করার জন্য কোর্ট থেকে স্পেশাল পারমিশান নিতে হতো। ইতোমধ্যে বহু টাকা-পয়সা নষ্ট হওয়ার পর রেজোয়ানা বেগম চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর এফআইও’র প্রধান মেজর রবের সাথে দেখা করেন। মেজর রব তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি ছাড়াও তার মায়ের সমান বয়সী মহিলাকে পা দ্বারা আঘাত করেন। তারপর যখন মামলা ট্রায়ালে ওঠে চন্দনাইশের এমপি পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত ব্যরিস্টার মাহবুবুল কবির চৌধুরীকে প্রধান করে কয়েকজন আইনজীবী নিয়োগ দেন তিনি। জামিনে থাকা অবস্থায় তাঁর পরামর্শে গনি সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে পটিয়ার এমপি প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সহ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস. আর পালের সাথে তাঁর চেম্বারে সাক্ষাৎ করেন এবং অন্য আসামিদের ডিটেনশানের ফাইল তৈরি করেন। এস আর পাল বলেন যে, ডিটেনশান উঠে যাবে এবং মামলা যখন ফাইনাল ট্রায়াল পর্যন্ত যাবে তিনি ঢাকা থেকে সিনিয়র আইনজীবী পাঠাবেন। তাদের জন্য কোন ফি দিতে হবে না। বিমানের টিকিট ও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে মাত্র। ইতোমধ্যে আমার মাতা ক্যাশ টাকা ছাড়াও তাঁর নিজের এবং বড় ছেলের স্ত্রীর সকল অলংকার বিক্রি করে দেন। ভাণ্ডার মার্কেটের ভাড়া শাপলা টেইলার্সের ইনকাম ছাড়াও বহু টাকা লোন হয়ে যাওয়াতে তাঁর স্বামীর ভিটে ভ‚মি হতে ৫ শতক জায়গা বিক্রি করে দেন। যার বর্তমান মূল্য ৭/৮ কোটি টাকা হবে।
প্রতি মাসে ২/১বার কোর্টে হাজিরা দেওয়া, উকিলের টাকা যোগানো তাতো আছেই। কোর্টে মা সবার জন্য রান্না করে খাবার নিয়ে যেতেন। সৈয়দ আবদুল গণি এ প্রসঙ্গে বলেনÑকোর্ট পুলিশ আমাদের সবসময় সহযোগিতা করেছে। শুধু কোর্ট পুলিশ নয়, পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি, বিশেষ করে আমাদের মামলার আই.ও কোতোয়ালী থানার তৎকালীন এস.আই নুর হোসেন আমার মা তাকে ধর্মের ভাই ডেকেছিলেন এবং ওনি মাকে বোন হিসেবে নিয়েছিলেন, তার ঋণ আমরা জীবনেও শোধ করতে পারব না। এই ভদ্র লোক ঐ সময়ে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা কর্মীর মামলায় সহযোগিতা করেছিলেন।
এর মধ্যে মায়ের সাথে সৈয়দ ভাই যোগাযোগ রাখতো সবার খোঁজখবর নিত। আমরা গ্রেফতার হওয়ার পর জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কিন্তু থেমে থাকেনি, প্রতিদিন রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হত। ডিটেনশন এবং ডিভিশন ওয়ার্ডে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। তাই অনেককে আলাদা ওয়ার্ডে ট্রান্সফার করা হয়। সৈয়দ ভাই মাকে সান্ত¡না দিয়ে চিঠি লিখতেন এবং একদিন মায়ের কাছে চিঠি লিখে জানালেন, উনার হবু বউ যেন উনার জন্য আর অপেক্ষা না করে। এ খবরা যেন উনাদের পরিবারকে জানিয়ে দেয়া হয়। কারণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যস্ত উনার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মা একদিকে আমাদের মুক্ত করার জন্য লড়াই করছে অন্যদিকে সৈয়দ ভাইকেও মাঝেমধ্যে আর্থিক সহযোগিতা করছে।
১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে এবং মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতা পার্টি সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধকারীদের লড়াই সংগ্রামে ভাটা পড়ে। মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার ঘোষণা দেয় যে ভারতের মাটি বাংলাদেশের সামরিক সরকার বিরোধী কার্যকলাপে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে তৎকালীন ভারত সরকার ও বাংলাদেশের সামরিক সরকারের সাথে একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের বাংলাদেশে প্রেরণ এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয়দের ভারতে প্রেরণ করা হবে এবং তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনে পুনর্বাসন করা হবে। ভারত সরকার জুলাই ৭৭ এর মাঝামাঝি সময়ে ভারতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী প্রতিরোধযোদ্ধা বাংলাদেশিদের ক্যাম্পে ঘিরে ফেলে সবাইকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশব্যাক করে। ভাগ্যক্রমে এ.বি.এম. মহিউদ্দিন চৌধুরী সেদিন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেদিন পুশব্যাকের আওতায় সৈয়দ ভাইও ছিলেন এবং ময়মনসিংহ বর্ডারে বিডিআরের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। ময়মনসিংহ বিডিআর ক্যাম্প থেকে সৈয়দ ভাই চট্টগ্রামে এক সিপাহীর মাধ্যমে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে লেখা ছিল সৈয়দ ভাই ময়মনসিংহে বিডিআর ক্যাম্পে আছেন। উনি ভালো আছেন এবং অচিরেই মুক্তি পাবেন, উনার জন্য যেন চিন্তা না করেন। সৈয়দ ভাই সিপাহী মারফত কিছু টাকা পাঠাতে বলেন, মা সিপাহীকে কিছু টাকা দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন নিজেই ময়মনসিংহ যাবেন, তিনি ছোট ভাই জব্বার এবং শাপলা টেইলার্সের হেড কাটার মাস্টার মিলন বাবুকে নিয়ে ময়মনসিংহ বর্ডারে বিডিআর ক্যাম্পে যান এবং সেখানে কর্তব্যরত মেজরের সাথে কথা বলে সৈয়দ ভাইয়ের বিষয়ে জানতে চান, মেজর তার সম্পর্কে কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন পরে তাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে গেছেÑ সে কথাটি জানান। মা মেজরের উপর খুব ক্ষুুব্ধ হন। পরে ময়মনসিংহ হতে ছোট ভাই জব্বার এবং মিলন বাবুকে সাথে নিয়ে ঢাকা আসেন। ঢাকায় ক্যান্টনম্যান্ট/বিডিআর হেড কোয়ার্টার রাজারবাগ সহ সব জায়গায় খোঁজ করেন। কিন্তু কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারেনি অবশেষে মা হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে আগস্টের ৯/১০ তারিখ গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের বাড়িতে এসে সৈয়দ ভাই এবং তাঁর পরিবারের বিষয়ে জানতে চান, মা বুঝতে পারেননি কেনো সৈয়দ ভাইয়ের কথা জানতে চাচ্ছিল। পরে আগস্টে ১১ তারিখ তাঁর মৃত্যু সংবাদ পায়।
এদিকে আরেকটি বিষয় ছিল সৈয়দ মৃত্যুর পর আমরা সবাই হতাশাগ্রস্ত। তখন ডবলমুরিং এলাকার জিয়াউর রহমান সরকারের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সুলতান মাকে লোক মারফত খবর পাঠান আমরা যদি জিয়াউর রহমান সরকারের দল করি তাহলে আমাদের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। মা ঘৃণা ভরে তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন আমার এক সন্তান তোরা মেরে ফেলেছিস, বাকিদের আল্লাহ দেখবেন, আমি আমার স্বামী সন্তানদের খুনির করুণারপাত্র হতে দেব না, বিষয়টি মা আমাদের কারাগারে জানিয়েছিলেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ ৩১ মার্চ ১৯৮০ সালে সকলেই মামলা হতে অব্যাহতি পান। ক্ষতিপূরণ দাবি করার অধিকার থাকলেও পুনরায় সরকারের রোষানালে না পড়ার জন্য ক্ষতিপূরণ মামলা করা হয়ানি।
লেখক: গবেষক ও প্রকাশক