রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর ভূমিকা চাই জাতিসংঘের

13

পূর্বদেশ ডেস্ক

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘের জোরালো ভূমিকার পাশাপাশি বিশ্ব নেতাদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। তাদের নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও এখনো তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও জটিল করে তুলছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে আশা প্রধানমন্ত্রীর।
গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বিকেলে (বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা ২৭ মিনিট) সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে বাংলায় দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে। এ সঙ্কট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা এই উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনের এ বছরের সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য- ‘একটি সংকটপূর্ণ সন্ধিক্ষণ: আন্তঃসংযুক্ত প্রতিক‚লতাসমূহের রূপান্তরমূলক সমাধান।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রতিপাদ্য-উদ্ভূত জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে আসছে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এই মহান পরিষদে তিনি তাঁর প্রথম ভাষণে বলেছিলেন : শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য, তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারব এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগশোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সব সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হবো। সুতরাং আমরা স্বাগত জানাই সেই সব প্রচেষ্টাকে, যার লক্ষ্য বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করা, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রতিটি স্থানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি জোরদার করা।
বিশ্ব যখন সঙ্কটে, পারস্পরিক সংহতি যখন সবচেয়ে বেশি জরুরি, তখন যুদ্ধ আর ক্ষমতাধরদের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার চক্করে বিশ্বে মানুষের জীবন-জীবিকা যে মহাসঙ্কটে পড়ছে, জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে সেই বাস্তবতা বিশ্ব মোড়লদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বললেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মত বৈরীপন্থা কখনও কোনো জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আলাপ-আলোচনাই সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়। আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই।
বিশ্বের মানুষ ২০২০ সাল শুরু করেছিল ভয়াল এক মহামারীর দুঃস্বপ্ন নিয়ে। এরপর আড়াই বছরে চোখে না দেখা এক ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে সাড়ে ৬৫ লাখ মানুষের প্রাণ, যারা বেঁচে গেছে, তাদের জীবন-জীবিকাকে করেছে বিপর্যস্ত, অর্থনীতিকে করেছে স্থবির। গত ফেব্রæয়ারিতে ওই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম আর খাদ্যের দাম বেড়ে গিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলেছে। বিশ্বকে ফেলে দিয়েছে নতুন এক অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায়। সেই বিপদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে মানবজাতির জন্য ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রæতি দেওয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি থাকাকালে বাংলাদেশকে ‘ঝুঁকির পথ থেকে জলবায়ু সহনশীলতা ও জলবায়ু সমৃদ্ধির টেকসই পথে’ নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লান’ গ্রহণ করার কথাও তিনি বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়ণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আহবান জানাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি হতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হল, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়’। এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাস্তবিক ও অত্যাবশ্যক সংস্কার করার তাগিদ দেন তিনি, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য আরও কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়।
মহামারির শুরু থেকে এ সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংক্রমণের বিস্তার রোধে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতা প্রসারিত করা হয়েছে, প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকার সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, আর টিকা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপির হিসাবে ৪১তম। বিগত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে। মাথাপিছু আয় এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মহামারির মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি ফিরিয়ে আনতে পেরেছে।
সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে বাংলাদেশের ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির কথা জাতিসংঘে আবারও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, মা ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত এক দশকে স্বাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার পথে। তবে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সংকট আমাদের টেকসই উত্তরণের পথে গুরুতর প্রতিক‚লতা সৃষ্টি করেছে। আমাদের উন্নয়নের অংশীজনদের কাছে বর্ধিত ও কার্যকর সহযোগিতার আহবান জানাই।
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে নিজের জীবনের এক নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশার কথা বিশ্বনেতাদের বলেন। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একইসঙ্গে আমার মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, আমার ছোট তিন ভাই – মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও তার নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তার নবপরিণীতা স্ত্রী পারভিন রোজী, আমার দশ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন জার্মানিতে ছিলেন বলে তিনি এবং তার ছোটবোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। তারপর ছয়টি বছর তাদের বিদেশে কেটেছে নির্বাসনে।
১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। দুই লাখ মা-বোনের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। কাজেই যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই।
বিশ্ব নেতাদের সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার আকুল আবেদন, যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ। আসুন, সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যাই।
বিশ্বসভায় সকল দেশের প্রতিনিধিকে তিনি মনে করিয়ে দেন, আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব, যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।