রোহিঙ্গাদের সচেতন হতে হবে

10

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনী এখন চরমভাবে বিপর্যস্ত। দেশব্যাপী বিরোধী শিবিরের টানা প্রতিরোধ এবং বিশেষ করে আরাকান আর্মির কাছে রাখাইন প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা সরকার এবং তাদের সেনাবাহিনী এখন একেবারেই কোণঠাসা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ বিদ্রোহীদের আক্রমণে টিকতে না পেরে এ পর্যন্ত ৬ শতাধিক দেশটির সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত দু’দফায়। সামরিক ও পুলিশবাহিনীর অনেকেই অবস্থা বুঝে জান্তার পক্ষ ছেড়ে বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়ার খবরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রকাশ করছে। গত সোমবার শেষ খবর পর্যন্ত দেশটির বিজেপির ১৭৯ জন সদস্য বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষে টিকতে না পেরে বাংলাদেশের সীমান্তে পালিয়ে এসেছে। তারা এখন বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)’র হেফাজতে রয়েছেন। শুধু রাখাইন প্রদেশে নয়, চীন ও তাইওয়েনের পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলোতেও বিদ্রোহীদের কাছে চরমভাবে পর্যুদস্ত দেশটির সেনা ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনী। এ অবস্থায় জান্তা সরকার তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় নতুন নতুন কৌশল নিচ্ছে, এমনকি রোহিঙ্গাদের জান্তা সরকারের পক্ষ নেয়ারও নানারকম ফন্দিফিকির করার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তবে তাতেও বিদ্রোহীদের থামানো দায় হবে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। বেশ কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমগুলোয় রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রচারিত একটি খবর সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সেটি হলো, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতির প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের দলে টানার চেষ্টা এবং আরাকান আর্মির বিপক্ষে অস্ত্র ধরতে উদ্বুদ্ধ করা। সূত্র জানায়, টিকে থাকার শেষ উপায় হিসাবে জান্তা সরকার মরিয়া হয়ে বেশকিছু অদূরদর্শী পদক্ষেপ নেয়। জানুয়ারিতে গণচীনের মধ্যস্থতায় বিচ্ছিন্নতাবাদী জোট দ্য থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়। যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানির কারণে জনবলের ব্যাপক ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে জান্তা সরকার ১০ ফেব্রæয়ারি ঔপনিবেশিক আমলের কন্সক্রিপশন আইন বা বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরির বিধানটি পুনরুজ্জীবিত করে। এ আইনে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের প্রত্যেক পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সের প্রত্যেক নারীর জন্য ন্যূনতম দুই বছর এবং ক্রান্তিকালীন পাঁচ বছর সামরিক চাকরি বাধ্যতামূলক। কিন্তু আইন করেও জান্তা সরকার আশানুরূপ ফল পায়নি। মিয়ানমারের ওই বয়সের যুবক-যুবতিরা প্রায় সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। সবদিক থেকে নিগৃহীত জান্তা সরকার শেষমেশ দলে টানার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গাদের; যাদের ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে তারাই সাত বছর আগে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। এখন তারা প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে, জান্তার হয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। খবরে প্রকাশ-কিছু কিছু রোহিঙ্গা টোপ গিলছে। স্বীকৃতির বিনিময়ে তারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন, নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো শক্তিশালী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। অতীতে একসময় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। এছাড়া প্রবাসের ক্যাম্পগুলোয় রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ থাকায় কোনো অভিবাসী রাজনৈতিক সংগঠনও গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য এ জনগোষ্ঠীর যুবসমাজ হয়তো জানেই না, যুগে যুগে মিয়ানমারের জান্তা সরকারগুলোই বারবার রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে এবং স্বার্থসিদ্ধির পরপরই তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
স্বাধীনতার পরপরই ১৯৪৮ সালে প্রণীত মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনটি ছিল বেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক। কিন্তু জান্তা সরকার এ আইন রহিত করে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত হিসেবে জাতিগত নিধনের উদ্যোগ নেয়, যা ১৯৬২ সাল থেকে চালিয়ে আসছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে এর চূড়ান্ত পর্যায় দেখতে পেয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়। এরপরও সা¤প্রদায়িক সংঘাত এড়াতে প্রবীণ নেতারা রোহিঙ্গাদের জন্য উত্তর আরাকানে একটি বিশেষায়িত অঞ্চল গঠনের দাবি তোলেন, যা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৬০ সালের এপ্রিলে প্রাকনির্বাচনি প্রচারণায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উ-নু প্রতিশ্রæতি দেন, ক্ষমতায় এলে তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য একটি বিশেষায়িত অঞ্চল গঠন করবেন। উ-নু নির্বাচিত হন এবং প্রতিশ্রæতি রক্ষা করেন। উত্তর আরাকানের মায়ু নদীর নামের সঙ্গে মিল রেখে মংডু, বুথিদং ও রাথেদং জেলা নিয়ে তৈরি হয় ‘মায়ু ফ্রন্টিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’। মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের দেওয়া এটাই একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশ্রæতি, যা রক্ষা করা হয়েছিল। তবে মায়ু ফ্রন্টিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের স্থায়িত্বকাল ছিল এক বছর মাত্র-১৯৬১ থেকে ১৯৬২। মার্চ ১৯৬২-তে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উ-নু সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। জেনারেল নে উইনের সামরিক সরকার মায়ু ফ্রন্টিয়ার তো বটেই, এমনকি আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার সব পরিকল্পনাতেও পানি ঢেলে দেয়। ১৯৭৪-এর সংবিধানে যদিও আরাকানকে একটি রাজ্য বা প্রদেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। পরবর্তীতে ১৯৯০ হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গারা দেশটির জান্তা সরকারের ক্রীড়ানকেই পরিনত হয়েছিল। এরপরও নিজ দেশে তারা টিকতে পারেনি।
আবারও সেই পুরোনো খেলায় নেমেছে জান্তা সরকার। এ খেলার ফাঁদে রোহিঙ্গারা পা দিলে আবারও তাদের ঠেলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে এমন আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। আমরা মনে করি, এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের উচিৎ হবে ধৈর্যের সাথে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। কোন পক্ষকে সমর্থন না দিয়ে বরং নিজেদের স্বকীয় অবস্থানকে সুদৃঢ় করে সম্মানের সাথে নিজ দেশে ফেরৎ যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করা।