রহস্যঘেরা আমাদের এই মহাবিশ্ব

26

মহসিন মিথু

বিশাল এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব নিয়ে মানবমনে অনেক জিজ্ঞাসা। আমাদের পৃথিবী, সৌরজগত দূর ভবিষ্যতে কোন দশায় পর্যবসিত হবে ? মহাকাশে ভাসমান উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো কি এভাবেই জ্বলবে চিরকাল, নাকি ম্লান হতে হতে কোনও এক সময় এরা নিঃশেষ হয়ে যাবে। অবশেষে এই সমগ্র মহাবিশ্বের পরিণতিই বা কি ? মহাকাশের বিস্ময়কর নানা তথ্য, পর্যবেক্ষণ সহ এই রকম অনেক জিজ্ঞাসার অনেক উত্তর দেওয়ার প্রাণান্ত প্রয়াস করেছেন ছোট দেশের বড় বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম ‘দি আলটিমেইট ফেইট অব দি ইউনিভার্স বা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি বইটিতে। যাদের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ আছে তাদের জন্য এটা একটি মাস্টারপিস বই হতে পারে। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অনঙ্গভূষণ দাস। বইটি প্রকাশ করেছে নাগরী প্রকাশনী।
স¤প্রতি নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের সূচনালগ্নের যে ছবি প্রকাশ করে হইচই ফেলে দিয়েছে সেই ছবিগুলোর ব্যাখ্যা ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে দিয়ে গেছেন। বইটিতে দেখা যায় আমাদের এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। পর্যবেক্ষণযোগ্য এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় শত বিলিয়নেরও বেশি গ্যালাক্সি। প্রতিটি সাধারণ গ্যালাক্সিতে রয়েছে প্রায় কমবেশি দশ হাজার কোটি নক্ষত্র। এসব নক্ষত্রের মৃত্যু হয়। কিন্তু এদের মৃত্যুর ধরন হয় ভিন্ন ভিন্ন। এবার প্রশ্ন হচ্ছে মহাবিশ্ব তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যেতে যেতে আমাদের গ্যালাক্সি, সৌরজগত এবং আমাদের আদর্শ এই পৃথিবীকে কোন দশায় ফেলবে ? দূর ভবিষ্যতে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আমাদের পৃথিবীর শক্তির উৎস সূর্য এক সময় লাল দানবে পরিণত হবে। অগ্নিবৎ উত্তাপে ছেয়ে যাবে সমগ্র পৃথিবী। শেষ পর্যন্ত সূর্য তার শক্তি হারিয়ে সে-ও শীতল হয়ে যাবে। নিকষ অন্ধকার পৃথিবীতে তখন বিরাজ করবে শীতলতা আর শীতলতা। এই দুই অবস্থাতে কি পৃথিবীতে মানব সভ্যতা টিকে থাকতে পারবে ? নাকি মানব সভ্যতা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাড়ি জমাবে মহাশূন্যে, খুঁজে নেবে শক্তির নতুন উৎস ?
সৃষ্টিতত্তে¡র খুবই একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ‘মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ।’ এই বিকিরণ সমগ্র মহাবিশ্বে সমরুপে পরিব্যাপ্ত। ধারণা করা হয় মহাবিশ্বের বিশেষ কোনও স্থান থেকে এসে এই বিকিরণ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ থেকে বিজ্ঞানীগণ এই ইঙ্গিত পান যে , মহাবিশ্ব প্রথমে অতি উষ্ণ ও অতি ঘনিভূত অবস্থায় ছিল। তারপর এক মহাবিষ্ফেরণের পর (যেটাকে বিগ ব্যাং বলে) এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বিগ ব্যাং যে মহাবিশ্বের উৎস তা নিয়েও রয়েছে মতানৈক্য। বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামের মতো অনেকেই মনে করেন যে, বিগ ব্যাং সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু জানার বাকি আছে। বিগ ব্যাং এর পূর্বেও কি মহাবিশ্বের অন্যকোন পর্যায় ছিল ? বিগ ব্যাং এর মুহূর্তেই কি সময় তার যাত্রা শুরু করেছিল ? এসব প্রশ্নের উল্লেখ করে জামাল নজরুল ইসলাম বলেন, বিজ্ঞানের এই জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনও পর্যন্ত নেই। রাশিয়ার গণিতবিদ আলেকজান্ডার ফ্রিদম্যান মহাবিশ্বের দুটি মডেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মডেল দুটি ছিল ‘মুক্ত মহাবিশ্ব ও বদ্ধ মহাবিশ্ব। মুক্ত মহাবিশ্ব চিরকালই স¤প্রসারিত হয় আর বদ্ধ মহাবিশ্ব অতি দূর ভবিষ্যতে স¤প্রসারণ থামিয়ে দেয়। অবশেষে বদ্ধ মহাবিশ্বের সংকোচন শুরু হয়। অতএব মুক্ত মহাবিশ্ব ব্যাপ্তির দিক থেকে হয় অসীম আর বদ্ধ মহাবিশ্ব ব্যাপ্তির দিক থেকে হয় সসীম। এই দুই মডেলদ্বয়কে জামাল নজরুল ইসলাম পর্যবেক্ষণ করেছেন। এদের স্পেসের জ্যামিতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন খুব স্পষ্টতায়। তিনি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে দেখলেন যে, দুই মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতির রুপ ভিন্ন ভিন্ন হয়। বর্তমান প্রেক্ষপটে দঁড়িয়ে তিনি আদর্শ মডেল বিবেচনা করেছিলেন। মডেল মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের সকল বস্তুকে মূর্ত করে। গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি কিছূ যুক্তিসঙ্গত অনুমান পেয়েছিলেন। ছায়াপথ বা গ্যালাক্সিগুলোকে মহাবিশ্বের মূল উপাদান ধরে নিয়ে তাদের চূড়ান্ত পরিণতি অনুসন্ধান করেছেন। গ্যালাক্সিদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রদের জন্ম, বিবর্তন ও মৃত্যুর প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন অধিক স্বচ্ছতায়। এসব নক্ষত্রের সমস্ত বস্তুর মূল উপকরণ হচ্ছে পরমাণু। পদার্থের পরমাণু আবার ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন দ্বারা গঠিত। এখনও পর্যন্ত এরা মৌলিক কণা হিসেবে বিবেচিত। বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহাকর্ষীয় তত্ত¡ অনুসারে প্রোটন কনার বিনাশ হওয়া উচিত। আর প্রোটন কণা অস্থায়ী হলে মহাবিশ্বের সকল বস্তুর গঠনও হবে অস্থায়ী। অর্থাৎ বদলে যাবে সমগ্র মহাবিশ্বের গঠন।পর্যবেক্ষণযোগ্য আমাদের মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতির অধিক সম্ভাব্য দশাগুলো এই বইয়ে আমরা দেখতে পাবো।এই বইয়ে মোট পনেরোটি অধ্যায়ে তিনি আমাদের গ্যালক্সি, মহাবিশ্বের বৃহৎ পরিসরে গঠন, মৌলিক কণা, প্রাথমিক অবয়ব, মহাবিশ্ব মুক্ত না বদ্ধ, নক্ষত্রের মৃত্যুর ধরন, বø্যাক হোল এবং কোয়েসার, গ্যালাকটিক ও সুপার গ্যালাকটিক বø্যাকহোল, বø্যাকহোল চিরস্থায়ী নয়, ধীর ও সু² পরিবর্তনসমূহ, জীবন ও সভ্যতার ভবিষ্যৎ, একটি পতনশীল মহাবিশ্ব, অবিচল অবস্থার তত্ত¡, প্রোটনের স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করেছেন।
এই বইটিতে অতি দীর্ঘ সময় শেষে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ এবং তার চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে তার আনুমানিক রূপরেখা উপস্থাপন করা হয়েছে। মহাবিশ্ব আবদ্ধ হলে এর চূড়ান্ত পতনের রূপ কি হবে ? আর একটি মুক্ত মহাবিশ্বে জীবন ও সভ্যতার অনির্দিষ্টভাবে টিকে থাকা সম্ভব ? বুদ্ধিমান মানুষেরা সমাজের সামাজিক দ্ব›দ্বগুলো মোকাবিলা করতে পারবে ? সবচেয়ে সুপ্ত সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে সময়ের সঠিক রূপকে অনুধাবন করা। বিশেষ করে মহাবিস্ফোরণ ( বিগ ব্যাং ), মহাসঙ্কোচন ( বিগ ক্রাঞ্চ ) এবং একটি মুক্ত মহাবিশ্বের সাপেক্ষে সময়ের রুপকে বুঝতে পারা একটি প্রধান সুপ্ত সমস্যা। সময়ের সঠিক সংজ্ঞা নিরুপণ করা একটি পুরাতন সমস্যা। খ্রিস্টান দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিন এই সমস্যার অতি উত্তম এক অভিব্যক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, সময় কি ? যদি আমাকে কেউ এই প্রশ্নটি করে না তবে আমি জানি সময় কী। যদি কারো কাছে আমি ঐ প্রশ্নের ব্যাখ্যা করতে চাই তখন আমি জানিনা।
এই অসীম মহাবিশ্বে আমরা মানে পৃথিবী কতটা ক্ষুদ্র তা কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরলেই বুঝবেন। ১৯৯০ সালে ভয়েজার ১ যখন আমাদের সৌরজগত পাড়ি দিচ্ছিল তখন বিজ্ঞান কল্প লেখক কার্ল সাগান নাসাকে অনুরোধ করেছিলেন ঐ দূর থেকে আমাদের পৃথিবীকে কেমন দেখায় তা দেখার জন্য। আমাদের পৃথিবীকে ছোট্ট একটা নীল বোতামের মতো লাগছিল। সাগান এটার নাম দিয়েছিলেন বøু পেলেট। আমাদের গ্যালাক্সির দৈর্ঘ্য ১ লক্ষ আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আলোর গতিতে ছুটলেও আমাদের গ্যলাক্সি পাড় হতে কোন যানবাহনের এক লাখ বছর লাগবে। তো মহাবিশ্বে এই রকম বিলিয়ন বিলিয়ন ছায়াপথ আছে। এইটা হচ্ছে শুধু দৃশ্যমান মহাকাশের হিসাব। এটা যে কতো বড় মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। খুব সহজবোধ্য ভাষায় এই বইটি লিখা হয়েছে। এমনকি যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েননি তারাও কিছু গানিতিক সূত্র ছাড়া বাকী তথ্যগুলো ভালোভাবে বুঝবেন।