রহমতের মাসের প্রস্তুতি

24

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

স্বাগতম মাহে রমজানুল মোবারক ! অভিনন্দন রহমতের মাস, সিয়ামসাধনার মাস, রাত্রি জেগে কোরান তেলাওয়াতের মাস; নামাজ পড়ার মাস তোমাকে। হে অশ্রæবিসর্জনের মাস, পাপ হতে মুক্তির মাস, রহমত, বরকত নাজাতে মাস রমজান, তোমাকে স্বাগত জানাই। অভিনন্দন জানাই উপহার এ সন্তুষ্টির মাস তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের মাস তোমাকে। ধীরে ধীরে তুমি আমাদের মাঝে আসছো অথচ আমরা অনেকেই এখনো বেখবর। তোমার আনন্দের প্রতীক্ষায় বিশ্বের মুমিন মুসলমান। তুমি মুসলমানদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার। তোমার প্রতিটি দিন পুণ্যের একটি একটি পর্বতমালা। তোমার দেখা যেন জীবনে বারবার হয়। তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম এক বছর। তোমার আগমনে মনপ্রাণ উজ্জ্বল হয়। প্রসারিত হয় হৃদয়। তোমার আগমনে আমাদের মসজিদগুলো পুষ্পে পুুষ্পে ভরে উঠে। আফসোস ! তোমার মর্যাদা অনেকে বুঝে না বলে তাদের প্রস্তুতি নেই তোমাকে স্বাগত জানাতে। তারা জানে না তোমার বিদায়ে পুষ্পগুলো ঝরে যাবে। রমজানের আগমনে মুসলমান অনেক ধরনের ইবাদত করে, বিদায়ে সবই আস্তে আস্তে দূরে সরে যাবে। প্রচুর মানুষ আবার আস্তে আস্তে ইবাদত হতে দূরে সরে লিপ্ত হবে পাপাচারে ব্যভিচারে। কত মানুষ তোমার সাথী ছিল এ রমজানে তাদের আবাসস্থল কবরস্থান। আজ তাদের নিজ আত্মার উপর কোন অধিকার নেই। তারা কেয়ামতের দিনের প্রতীক্ষায়। হে বিশ্বজগতের মালিক ! হে করুণা বর্ষণকারী হে রহমানুর রহিম দয়াময়! তুমি আমাদের পবিত্র রমজানের পুণ্যের মহাসাগরে প্রবেশাধিকারের ক্ষমতা দাও। তুমি রমজানের রহমত বরকত নাজাতের বর্ষণে স্নান করার তৌফিক দাও। বরকত দাও আমাদের কর্মে। চালাও সকল সঠিক পথ সিরাতোয়াল মুস্তাকিমে। দয়াময় ক্ষমা কর আমাদের পাপ। রক্ষা করো জালিমের অত্যাচার হতে। আমরা তোমার কুদরতী হাতে বন্দী। তুমি আমাদের মুক্তির মাসে মুক্ত করে মুক্তি দাও।
আমরা জানি রহমতের মাস রমজানুল আগমনের সাথে সাথে মহান আল্লাহপাক কর্তৃক নিযুক্ত জান্নাতের অধ্যক্ষ বিদওয়ান ফেরেস্তাকে ডেকে বলেন, রোজা ও ইবাদতকারীর জন্য জান্নাতকে সজ্জিত কর। আর এই মাস অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তার দরজা বন্ধ করো না। যখন এই মাসের দ্বিতীয় দিন আগমন করে তখন আল্লাহপাক জাহান্নামের অধ্যক্ষ মালেককে বলেন, রোজাদার ও রাতে ইবাদতকারীদের জন্য জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দাও এবং এই মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত খোল না। যখন তৃতীয় দিন উপস্থিত হয় তখন হযরত জিব্রাইল (আ.)কে বলেন, তুমি পৃথিবীতে গমন কর এবং শয়তান উদ্যত জ্বিনগুলোকে শিকল বাঁধ, যেন আমার বান্দাদের রোজা নষ্ট না করতে পারে।
মহান আল্লাহ পাকের এক ফেরেস্তা আছে, যার মাথা আরশের ও পদদ্বয় দুনিয়ার সপ্তম স্তরে অবস্থিত, দুই বাহুর একটি সূর্যোদয়ের অপরটি সূর্যাস্তের দিগন্তে রয়েছে, একটি ইয়াকৃত পাথরের তৈরি, অন্যটি সবুজ মর্মর পাথরের। যে রমজান মাসের প্রতি রাতে আহŸান করে, ‘কোন তাওবাকারী আছে কি, যার তাওবা মঞ্জুর করা হবে। কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি, যাকে ক্ষমা করা হবে। কোন অভাবগ্রস্ত লোক আছে কি, যার অভাব পূরণ করা হবে। হে মঙ্গলপ্রার্থী ! তুমি আনন্দিত হও। হে অমঙ্গলকারী। তুমি বিরত থাক। সাবধান, নিশ্চয় মহান আল্লাহ জাল্লেশানহুর আদেশে প্রতি রাতে সেহেরী ও ইফতারের সময় জাহান্নাম হতে সাত হাজার লোক মুক্তি দেন যারা শাস্তির যোগ্য হয়েছিল’। এ ধরনের মহাপুণ্যময় মাসের শুরুতে আমাদের প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। মাসটির আগমনের পূর্বেই যদি তার মর্যাদা অভিহিত না হই তাহলে এমাসকে সম্মান জানাব কী ভাবে !
তোমাদের সমাজে দুই শ্রেণীর লোক আছে, একশ্রেণীর মানুষ বরকতময় মাস রমজানের আগমনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে, কারণ তারা রোজার মর্যাদা সম্পর্কে জানেন। তাই তারা রমজানের যত কষ্ট সবই হাসিমুখে বরণ করে। তারা ইহকালের সুখ বর্জন আর পরকালের সুখ অর্জন করতে চায়। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায়। তার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় আনন্দের সাথে। তারা প্রবাসী প্রিয়তমের জন্য প্রিয়া যেরূপ অপেক্ষা করে তদ্রুপ তারা রমজানের জন্য অপেক্ষা করে এবং মিলনে মহাআনন্দিত হয়।
আর দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ এই বরকতময় মাসকে কষ্টকর মনে করে। তারা এমাসের বিদায় মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকে। বিদায়ে আনন্দিত হয়। এ শ্রেণীর মানুষ ভোগবিলাসী। তারা জীবন মানে বুঝে পানাহার, যৌনাচার। তারা জীবনটা ভোগ করতে গিয়ে উপভোগের কথা হারিয়ে ফেলেছে। তারা মহান আল্লাহর আদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে জানে না। তাই তাদের এ মাসটি কষ্টদায়ক মনে করে।
এই মাসকে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে সকল মন্দ কাজ বর্জন করে নানা ধরনের ইবাদত মানসিক প্রস্তুতির মাধ্যমে। এই মাসকে স্বাগত জানার, সুদৃঢ় ঈমানী শক্তি দিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করে, প্রতিটি রোজা পুণ্যময় কার্যে ব্যবহার করতঃ সময় নষ্ট না ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকার মাধ্যমে। এ মাসের প্রতিটি দিনকে এক একটি সুযোগ ভাবতে হবে। কারণ আগত মাসটিই হতে পারে আমার শেষ রমজান। সুতরাং এ মাসের প্রস্তুতি আগে ভাগেই গ্রহণ করা কর্তব্য।
রমজানের পূর্ব মাস শাবান। শাবানের শেষ দিনটি উপস্থিত হলে মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিকাল বেলায় রমজানের আগমনী বার্তা সম্পর্কিত এক ভাষণ মুসলমানদের নিকট প্রদান করতেন। তাঁর ভাষণে বলতেন, হে মানুষ ! তোমাদের ছায়া দিতে আগমন করছে এক পবিত্র মাস। এই মাসে রয়েছে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ রাত। এ মাসে রোজাকে করেছেন ফরজ। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল কাজ সম্পাদন করবে, সে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করার সমান পুণ্য পাবে। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান পুণ্য অর্জন করবে।
এই ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। … এটি এমন একমাস, যার প্রথমাংশ রহমতের, মধ্যাংশ মাগফিরাতের আর শেষাংশ জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তির। আর যে ব্যক্তি এ মাসে অধীনস্থ চাকরদের কাজের ভার লাঘব করবে মহান আল্লাহ পাক তাঁর পাপ ক্ষমা করে দিবেন। দোজখ হতে মুক্ত করে দিবেন। (বায়হাকী ও মিশকাত শরীফ)

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক