রবি নিয়োগী

0

রবি নিয়োগী, বিপ্লবী রাজনীতিক। পূর্ণনাম রবীন্দ্র নাথ নিয়োগী। শেরপুর জেলায় গৃদানারায়ণপুর (পুরাতন গরুহাটী) গ্রামে এক জমিদার পরিবারে ১৯০৯ সালের ২৯ এপ্রিল তাঁর জন্ম। পিতা রমেশ চন্দ্র নিয়োগী ও মাতা সুরবালা নিয়োগী কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
রবি নিয়োগী শেরপুর গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল হাইস্কুল (বর্তমানে জি. কে পাইলট স্কুল) থেকে ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯২৭ সালে ঐ কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের এক সংঘর্ষের ফলে রবি নিয়োগীসহ কিছুসংখ্যক ছাত্র কলেজ থেকে বহিস্কৃত হয়। এরপর তিনি কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়নকালেই তিনি বিপ্লবী যুগান্তর দলের সান্নিধ্যে আসেন। ১৯২৯ সালে তিনি আই. এ পাস করেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ময়মনসিংহে সংঘটিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনে রবি নিয়োগী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ঐ আন্দোলনের সময় রবি নিয়োগীসহ ১৭ জন রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার হন। ১৯৩০ সালে মাস্টার’দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অব্যবহিত পরে ময়মনসিংহে যুগান্তর দলের যে-কয়জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় রবি নিয়োগী ছিলেন তাঁদের একজন। ১৯৩১ সালে শেরপুরের ঝিনাইগাতি এলাকায় সালদার জমিদার বাড়িতে যুগান্তর দলের হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে রবি নিয়োগীর সাত বছর কারাদন্ড হয়। তাঁকে প্রথম রাজশাহী জেলে আটক রাখা হয়, এবং পরে একজন বিপজ্জনক বন্দী হিসেবে আন্দামান সেলুলার জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি সাড়ে পাঁচ বছর বন্দীজীবন যাপন করেন। আন্দামান জেলে আটক থাকা অবস্থায়ই রবি নিয়োগী কয়েকজন বিপ্লবীর সাথে সাম্যবাদে দীক্ষিত হন। ১৯৩৭ সালে গঠিত অবিভক্ত বাংলার প্রথম সংসদীয় সরকারের আমলে মুক্তি পেয়ে ময়মনসিংহে ফিরে এসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
রবি নিয়োগী চল্লিশের দশকে বৃহত্তর ময়মনসিংহে কৃষক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে নালিতাবাড়িতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৫-৯ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে নেত্রকোণায় যে সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রবি নিয়োগী ছিলেন তারও অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা ছিলেন।
রবি নিয়োগীর জীবনে যেমন আন্দোলন-সংগ্রাম শেষ হয় নি, তেমনি জেল-জুলুমও ছিল তাঁর প্রায় নিত্য সঙ্গী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতেই তেভাগা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা পাঁচ বছর কারাভোগ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সাথে রবি নিয়োগীকেও গ্রেফতার করে। এ সময় তিনি দু’বছর কারান্তরালে ছিলেন। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের আমলে তাঁর কারাজীবনের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৯১ সালের ২৫-২৮ ফেব্রæয়ারি ভারতের মুম্বাই নগরীতে অনুষ্ঠিত জীবিত আন্দামান-বন্দীদের যে সম্মাননা প্রদান করা হয় তাতে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে রবি নিয়োগী অংশগ্রহণ করেন।
রবি নিয়োগী লেখক হিসেবেও অবদান রাখেন। রাজনীতি বিষয়ে তাঁর রচিত নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে একাত্তরের বিজয়গাঁথা: শেরপুর, শেরপুরের ইতিহাসে মুসলিম অবদান এবং তেভাগা আন্দোলন, সংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ। ২০০২ সালের ১০ মে শেরপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। সূত্র : বাংলাপিডিয়া