মেধাবী সমাজ বিনির্মাণে বই হোক নিত্যসঙ্গী

5

বাবুল কান্তি দাশ

অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার যে চিরন্তন আগ্রহ মানুষের আছে, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের সবচেয়ে সহজ রাস্তা হল বই পড়া। এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের একটি উক্তি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন ‘তিনটি জিনিস মানুষের জীবনে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন, বই, বই এবং বই’। বই হোক জীবনের আদর্শ। জীবন হবে আলোকিত উন্নত সমৃদ্ধ। শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত। উন্নত আদর্শ অনুসরণে মানুষ মহৎ ও সুখী হয়। নৈতিক অন্ধত্বের নিরাকরণ ঘটে। আদর্শ মানুষের চিন্তাকে করে আলোকিত, জ্ঞানকে করে প্রসারিত। প্রেমকে গভীরতর করে দৃষ্টিকে করে বিস্তৃত,ব্যক্তিত্বকে করে অচিন্তনীয় মূল্যবোধে সমৃদ্ধ। ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস। বিশ্বের বহু দিবসের মতো এটিও অন্তরালে থেকে যায়। অবশ্য বিশ্ব বই দিবস কোনো সময় তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। দুঃখের বিষয় জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত দিবসগুলোর মধ্যে অন্যতম অজ্ঞাত এবং অনুজ্জাপিত একটি দিবস হচ্ছে বই দিবস।বিশ্ব বই দিবসের মূল ধারণটি আসে স্পেনের লেখক ভিসেন্ত ফ্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে। ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল মারা যান স্পেনের আরেক বিখ্যাত লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেস। আন্দ্রেস ছিলেন থের্ভান্তেসের ভাবশিষ্য। প্রিয় লেখক এবং তাঁর সৃষ্টিকে স্মরণ করে জ রাখতেই মূলত আন্দ্রেস ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল নিজ দেশ স্পেনে পালন করেন বিশ্ব বই দিবস। ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে অর্থাৎ ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয়।শুধু বই কেনা নয়, বই হয়ে উঠুক আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বই-ই পারে আমাদেরকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে। ধর্মান্ধতা থেকে ধার্মিকতায় উন্নীত করতে। আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক, তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। একটা ভাল বই আমাদের মানসলোক কে করে আলোকিত, চিত্তকে করে প্রসারিত। বই পড়া, বই এর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলা অপরিহার্য্য। অন্যের সঙ্গে বই ভাগ করা জারি থাক আজীবন। জীবনের স্তুতি তো বইয়ে নিহিত। বই তো কথা বলে জীবনের। তাই জীবন থেকে বই কোনো বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে যদি বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরী করে দেওয়া যায় তাহলে নতুন পরিশুদ্ধ এক বিশ্ব গড়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। আমাদের ভাবনাগুলো শুদ্ধ চেতনায় বিকশিত হয়ে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে মানব সভ্যতা সর্বোপরি মানব অস্তিত্ব রক্ষায় অগ্রণী হব। নিজেদের মধ্যে নির্মল এক পরিবেশের আবহ তৈরী করতে চাইলে তাহলে প্রয়োজন বই আর বই। বর্তমান সময়ে আমরা যেভাবে অস্থির হয়ে পড়েছি, সংকট থেকে উত্তরণে হিমশিম খাচ্ছি যথার্থ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য। মানসিক অস্থিরতা দূরীকরণে এবং মানসিক সুস্থতায় প্রয়োজন বই এর সখ্যতা। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে আমাদের গতিশীলতা এসেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কিন্তু আমাদের যথার্থ পরিপক্বতা, বিষয়ের যথার্থ বিশ্লেষণ পূর্বক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখনো অদক্ষতা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান। তার অন্যতম কারণ বই বিমুখী হওয়া। একটি ভালো বই থেকে আমরা যথার্থ জ্ঞান আহরণ করতে পারি। সঠিক জ্ঞানার্জন আমাদের শেখায় বিবেচনা বোধ। বিবেচনা বোধ জাগ্রত হলেই সমাজ রাষ্ট্র হয়ে উঠে পরিশীলিত পরিশুদ্ধ। আজকের বই বিমুখীনতা সমাজ নষ্টের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে এখন বই পড়ার ঝোঁক কমছে বলে অনুযোগ শোনা যায় হামেশাই। সাধারণ মানুষের এই ‘বই বিমুখতা’র কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে তার নানা দিক আমাদের সামনে ধরা দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষের জীবনে প্রযুক্তি- নির্ভরতা বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, তারই হাত ধরে আজ সবার কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুলভ সুযোগ এসে পৌঁছেছে। সেই সূত্রেই বর্তমান তরুণ সমাজ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের বিভিন্ন মাধ্যমকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ডুব দিয়েছে। টেলিভিশনও অবশ্য কম দায়ী নয়। যাই হোক, এ সবের ফলস্বরূপ পাঠকের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইন্টারনেটে গেম খেলার সর্বনেশে নেশা। এখন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়া ব্যাপারটা শুধুই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর অনলাইনের কিছু পত্র-পত্রিকায় সীমায়িত। ‘ই –বুক’-এর প্রচলন হলেও তা কি হাতে বই নিয়ে পড়ার স্বাদ দিতে পারে? প্রযুক্তির প্রতি মানুষের এই যে এত বেশি ঝোঁক, তার পরিণতি কিন্তু সুখকর নয়। মানুষের আচার-আচরণেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পাগলা গণেশ’ শীর্ষক কল্পবিজ্ঞানের গল্পে মজার ছলে তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞেরাও বলছেন, সুস্থ মানসিকতার জন্য বই পড়া খুবই জরুরি। সৃজনশীলতা, মননশীলতা এই সব গুণাবলির বিকাশে বই খুব ভাল বন্ধু। বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই যন্ত্র-নির্ভর সভ্যতায় আজ আমরা বড় আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে উঠছি। অথচ এটা ঘটনা যে, বই পড়ে যে নির্মল আনন্দ পাওয়া যায়, তা অন্য কিছুতে অসম্ভব। কবিগুরুর কথায়, ‘‘ভালো বই আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়।’’ তাই বই পড়ার অভ্যাস হওয়া উচিত শৈশব থেকেই। কারণ, শৈশবই ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রথম পর্ব। এখন সেই শৈশব কেড়ে নিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার। বছর তিরিশ পিছিয়ে গেলেই অন্য ছবি ধরা পড়ে। তখন ছেলেবেলা ছিল বড্ড মজার। ছোটরা লেখাপড়ার ফাঁকে মাঠেঘাটে দাপিয়ে বেড়াত। বর্ষার কাদামাঠে ফুটবল কিংবা শীতের দুপুরের ক্রিকেট ব্যাটমিন্টনের মজাই ছিল আলাদা। দল বেঁধে স্কুল যাওয়ার মধ্যেও ছিল এক অন্য রকম আনন্দ। সে সময় যৌথ পরিবার ছিল। অফুরন্ত আদর ভালবাসা ও আত্মিক বন্ধন ছিল। ঠাকুমার ঝুলি, আবোলতাবোল, বুড়ো আংলা, হযবরল-র আশ্চর্যময় কল্পনার জগৎ ছিল। বড় বড় খেলার মাঠ ছিল। সাঁতার কাটার জন্য পুকুর ছিল। আম বাগান ছিল। এখন ব্যাগভর্তি বইখাতা নিয়ে সকালে ঘুমচোখে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরেও এক শিক্ষকের কাছ থেকে অন্য শিক্ষকের কাছে ছোটা। এ ভাবেই কেটে যাচ্ছে শৈশব। পাঠ্যবইয়ের বাইরে জগৎটাই ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। তরুণ বয়সে তাদেরই মনোযোগ চলে যাচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া বা বিনোদন মাধ্যমগুলির প্রতি। এ ভাবেই তারা গতবাঁধা পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আসলে বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণের কান্ডারী হয়ে ছুটতে ছুটতেই তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই ছেলেবেলায় যখন পাঠক হিসেবে এক জনের হাতেখড়ি হওয়ার কথা, তখনই নানা পারিপার্শ্বিক কারণে বইয়ের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। তা হলে নতুন পাঠক তৈরি হবে কী ভাবে? আগে অভিভাবকেরা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সন্তানের হাতে উপহার হিসাবে বই তুলে দিতেন। আর নিজেরাও অবসরের অনেকটা সময় বই পড়ে কাটাতেন। ফলে পারিবারিক ভাবেই বই পড়ার সুঅভ্যাস গড়ে উঠত। এখন যে সেই রীতি নেই, তা বললে ভুল হবে। তবে সেই চল কমে এসেছে অনেকটাই। প্রথম ধাপে এক জন শিশুকে ছবিওয়ালা বই দেখাতে হবে। ছবির আকর্ষণে সে নিজেই ওই বইয়ের পাতা ওল্টাতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে ছবি সম্পর্কিত কথার সঙ্গে তার পরিচয় করাতে হবে। সেই সঙ্গেই তাকে তার বয়সপোযোগী বই পড়ে শোনাতে হবে। এ রকম করে তার শোনার ক্ষমতা যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনই নিজে পড়ার আগ্রহও জন্মাবে। এ ভাবেই তৈরি হয় এক জন নতুন পাঠক। প্রতিটি গৃহে, পাড়া মহল্লায় পাঠাগার স্থাপন পূর্বক প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে হবে বই পড়ায়। আর তা’তে করে কমে আসবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, তৈরী হবে সৌহার্দ্য, মৈত্রী। গড়ে উঠবে সহযোগিতা, সহমর্মিতা। সমৃদ্ধ হবে প্রজন্মের সৃজনশীলতা ও মননশীলতা। মনোযোগ দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এর প্রভাব খুবই খারাপ। শিক্ষার্থীরা একটা বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে নিয়ত। তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ, মননশীলতাকে সমৃদ্ধায়নে বই অপরিহার্য্য করে তুলতে হবে যে কোন উপায়ে।বপ্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলাদা গ্রন্থাগার নির্মাণ, পাঠকক্ষ তৈরী, বোধবীক্ষণী সভার আয়োজন জরুরী। শিক্ষার্থীদের যদি বইয়ের সাথে সখ্যতা তৈরী করে দিতে পারি তাহলে আমরা সক্ষম হব জ্ঞান নির্ভর একটি সমাজ তৈরী করতে। প্রয়াসী হব মেধাবী রাষ্ট্র বিনির্মাণে। অবসান হবে বৈষম্যের। ঘটবে চেতনার চৈতন্য। তাই আসুন বই পড়ি, প্রিয়জনকে বই উপহার দিই। উৎসাহিত করি বই পড়ায়।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক