মহান বিজয় দিবস সকল সংকীর্ণতা পরিহার করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়াই হোক-একমাত্র অঙ্গীকার

25

আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসÑবাঁধভাঙা আনন্দের দিন, গৌরবের দিন। লাখো শহীদের রক্তস্নাত বিজয়ের দিন। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৪৯ বছর পূর্তি আজ। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নিপীড়ন আর দুঃশাসনের কুহেলিকা ভেদ করে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিজয়ের হাসিমাখা রক্তিম সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠেছিল বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তর। অবসান হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। নারী-পুরুষ-শিশু সবার চোখে ঠাঁই পেয়েছিল সীমাহীন আনন্দের অশ্রু-বিজয়ের আলোর ঝিলিক। সেই মুহূর্তের প্রাপ্তির অনুভূতি ভাষার জালে কি সবটুকু তুলে আনা যায়!
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাঙালির স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তার পুনঃউদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের মহাক্ষণটি সূচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে; ৯১ হাজার ৫৪৯ পাকিস্তনি সৈন্য প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর নত মস্তকে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় মেনে নিয়েছিল। পৃথিবীর বুকে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটেছিল। আর সারা বিশ্ব বিস্ময়ে দেখেছিল বাঙালিরা কতবড় ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। আনন্দ অনেকভাবেই আসতে পারে মানুষের জীবনে, তবে মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা যুদ্ধজয়ের আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। ৪৮ বছর আগে আজকের এই দিনে উদিত হয়েছিল বিজয়ের লাল সূর্য। মুক্তিপাগল বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলো। যে সূর্যকিরণে লেগে ছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত বিজয়ের রঙ। সেই রক্তের রঙ সবুজ বাংলায় মিশে তৈরি করেছিল লাল-সবুজ পতাকা। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্নÑ যে স্বপ্ন অর্জনে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। ত্যাগের সর্বোচ্চ নিদর্শন রেখেছিল আড়াই লাখ মা-বোন। ৯ মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে এই দিনে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখÐ। তাই বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ কিন্তু একদিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে এই জাতির ঘাম ঝরানো দীর্ঘ সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের মহান সেনাপতি ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪‘র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২‘র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ঐতিহাসিক ৬ দফা, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থানÑ এ সবই ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সব পরিণতিকে দিয়ে দেয় চূড়ান্ত রূপ। শুরু হয় সংগ্রামের নতুন অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের বঙ্গবন্ধুর বজ্র নিনাদ ঘোষণাÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ঘোষণা জাতির মনোজগতে বয়ে আনে আকাশচুম্বী প্রেরণাÑ জাগিয়ে তোলে মুক্তির উন্মাদনা। এরপর একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যদিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হলেও এদেশে স্বাধীনতা বিরোধীরা সরব ছিল দীর্ঘদিন। অনেক দেরিতে হলেও বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী মুক্তিকামী বাঙালিদের হত্যাকারী মানবতাবিরোধী অপরাধকারীদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। রায়ও কার্যকর করা হয়েছে বেশিরভাগ অপরাধীদের। স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৯ বছরে এটি একটি বড় অর্জন বলে আমরা মনে করি। এর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের কলঙ্কের দায় মুক্তি ঘটেছে অনেকাংশে। একইসাথে শিক্ষার প্রসার, নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথেও আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আমরা বিজয়ের মাসে পেয়েছি পদ্মাসেতুর চূড়ান্ত রূপ। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে পেতে যাচ্ছি স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল। সড়ক ও রেল যোগাযোগ কানেক্টেভিটে আসছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ তো আজ বাস্তবতাই। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা।
আমরা বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে আমরা অচিরেই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারবো। তাই মহান বিজয় দিবসে আমাদের চাওয়া এবং একমাত্র চাওয়া হোক দেশকে ভালোবাসারÑ দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হোক আজকের বাংলাদেশ।