মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : অতুল আনন্দের দিন

13

এমরান চৌধুরী

আমাদের জাতীয় জীবনে বেশ কয়েকটি দিন আছে, যেমন শহিদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিন, স্বাধীনতা দিবস, জাতীয় শোক দিবস,বিজয় দিবস প্রভৃতি। এ দিবসগুলো কখন কোনটা পালিত হয় তা আমরা সবাই জানি। না জানারও কথা নয়। কারণ আমরা দেশকে ভালোবাসি। তাইতো আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কথাও ভালোবাসার। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি / চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস/ আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ এই দিবসগুলোর কোনোটি আনন্দের, কোনোটি বেদনার আর কোনোটি মেঘমুক্ত আকাশ জুড়ে রোদ ওঠার মতো। যেমন করে রবি ঠাকুর বলেছেন, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/ বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই/ আজ আমাদের ছুটি। তেমনি একটি দিন বা দিবসের নাম বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়। এই দিনটি আমাদের কাছে বাদলের শেষে মেঘের কোলে রোদ হাসার মতো। এই দিনটি আমাদের মানে আমরা যারা বাংলাদেশের মানুষ তাদের কাছে বড় আনন্দের দিন। প্রজাপতির রঙিন পাখায় ভর করে আকাশে ওড়ার দিন। কেন এত আনন্দ? আনন্দ এজন্যেই যে এদিন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন বিজয়ীর বেশে। তিনি যদি সেদিন এদেশে ফিরে না আসতেন বা আসতে না পারতেন তাহলে আমাদের স্বাধীনতা অপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ থেকে যেত। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেও স্বাধীনতা নামক মহার্ঘ বস্তুর সুখ যে কি রকম তা থেকে বঞ্চিত থেকে যেতাম। এটা আমাদের জন্য হতো জন্মের আগে পিতাহারা বা এতিম হওয়ায় মতো।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরের দিন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। সেখানে ফয়সালাবাদের একটি জেলে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে রাখা হয়। ৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশনের এক ঘোষণায় জানানো হয়, ১১ আগস্ট থেকে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হবে। বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এদেশের জনগণ বহিঃবিশ্বের মানবতাবাদী সরকার ও জনতার কাছে বঙ্গবন্ধুর এই বিচার বন্ধে সোচ্চার হওয়ার আহŸান জানান। বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে ব্যাপক জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে। বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিচারের রায় স্থগিত রাখে। তবে ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে ৪ ডিসেম্বর তড়িঘড়ি করে বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদÐের রায় দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে লায়ালপুর থেকে ইসলামাবাদের মিয়ানওয়ালি জেলে রাখা হয়। তাঁর সেলের পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছিল মৃত্যুদÐ কার্যকর করার জন্য। ইতিমধ্যে মাত্র তেরদিনের চূড়ান্ত যুদ্ধে পাকবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ও আত্মসমর্পণ এবং ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে নতুন সূর্যোদয়ের কারণে তা করতে পাকিস্তান সরকার আর সাহস করেনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ১১দিন পর ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদানের জন্য পাকিস্তানের নিকট দাবি জানানো হয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতি স্বীকার করে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১০ জানুয়ারি সকালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের আগ্রহে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমান বাহিনীর এক বিশেষ বিমানে তিনি নতুন দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে পৌঁছান। ঐদিন দুপুরে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে তিনি নিজ জন্মভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি দুপুর ১-৪৫ মিনিটে ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে নামে। এ সময় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। তাঁর এই আপন মাতৃভূমিতে ফিরে আসার সাথে সাথে দীর্ঘ প্রায় দশ মাস পর পূর্ণতা পায় ২৫ দিন আগে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। স্বাধীনতার পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ।
স্বদেশে ফিরে যে কোনো মানুষের প্রথম স্বজনের মুখ দেখার কথা। বঙ্গবন্ধুও ইচ্ছে করলে তাই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বন্ধু। প্রাণের নেতা। তাই নিজ পরিবার পরিজনের মুখ দেখা তাঁর জন্য সাজে না। তাঁর মাসুম শিশু শেখ রাসেলসহ পরিবারের সদস্যরা যতই তাঁর পথের দিকে চেয়ে থাকুক। ছোট রাসেল যতই অপেক্ষায় থাকুক এই বুঝি বাবা এলো! না, তিনি ধানমÐির বত্রিশ নম্বরে গেলেন না। সরাসরি চলে গেলেন তাঁর বৃহত্তম পরিবারের কাছে। রেসকোর্স ময়দানে। একেই বলেই নেতা। জননেতা। দীর্ঘ দশ মাস মৃত্যুর মুখোমুখি বাস করে প্রিয়জনের মুখ না দেখে যিনি মিশে যেতে পারেন জনতার মাঝে। জনতার বাঁধভাঙা জোয়ারে। যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল নেতার বীরোচিত ভাষণ শোনার জন্য। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের মতো বিশাল জনসমুদ্রে সেদিন আবেগ আর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বাধীন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এ দেশের মানুষের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল তিনি তা কারাগারে থেকেও উপলব্ধি করেছিলেন। এই নিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানিদের নির্মমতা হিটলারের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে। হিটলার বেঁচে থাকলে পাকিস্তানিদের এই নির্মমতা দেখে লজ্জা পেতো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরই এর স্থান। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধর্মের নামে এদেশের মানুষকে হত্যা করেছে। আমাদের মা-বোনদের বেইজ্জত করেছে। ‘রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন,’ পাকিস্তানি কারাগার থেকে যখন মুক্ত হই, তখন জনাব ভুট্টাে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, সম্ভব হলে আমি যেন দুদেশের মধ্যে একটা, শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি এখন বলতে চাই, জনাব ভুট্টো সাহেব, আপনারা শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন কেউ যদি স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তাহলে সেই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে।
বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়া খানের কারাগারে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিন গুনেছেন। তিনি বিশাল জনসমুদ্রে সেই দুঃসহ জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করার শত চেষ্টা করা হয়। কারাগারে নির্জন সেলের সামনে তাঁর জন্যে প্রতি রাতে কবর খুঁড়ে ভয় দেখানো হতো। পাকিস্তানি জান্তারা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন খাঁটি মুসলমান। তিনি দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর। মুসলমান কখনও এক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। নির্ভীক বঙ্গবন্ধু প্রতিবারই তাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত বলে হানাদারদের জানিয়ে দিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ। মানুষ একবারই মরে। আমি কখনও মাথা নত করব না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেলো, মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার দেশে আমার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।’
দেশের প্রতি কতটা দরদ থাকলে এভাবে উচ্চারণ করা যায়! বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধ্যানজ্ঞান ছিল এদেশ আর দেশের মানুষ। তাই দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী মরণপণ যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রæমুক্ত হলেও মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠেনি। কারণ মানুষ তখনো ছিল অজানা আশংকায়। জনক কোথায় ? এ প্রশ্ন বার বার তাদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে স্বশরীরে পাওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠেছিল। এদিনই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার পরিপূর্ণ সুখ অনুভব করে। সেদিন বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত ছিল জনতার উল্লাস আর আনন্দ ধ্বনি। সে উল্লাস আর আনন্দধ্বনি ছিল অতুল, অপার। আমাদের জাতীয় জীবনে তাই ১০ জানুয়ারি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আর এই স্থান বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার সঙ্গে এক ও অভিন্ন সুতোয়গাঁথা।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক