মহাকবি ইকবাল এবং তাঁর ‘রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম’

564

আল্লামা ড. মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) কবি ও দার্শনিক। প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যে কবি পরিচিতি বেশি হলেও পাশ্চাত্যে দার্শনিক হিসেবেও ও সমাদৃত। অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট শহরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মুহাম্মদ ইকবালের জন্ম। পিতা শেখ নুর মোহাম্মদ এবং মাতা ইমাম বেগম। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন কাশ্মীরের পুরোহিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে তাদের পরিবার ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে শিখরা কাশ্মীর আক্রমণ করলে তারা পাঞ্জাবে হিজরত করেন। বিদ্যোৎসাহি শেখ নুর মোহাম্মদের দু’সন্তানই ছিলো মেধাবী। বড় সন্তান আতা মোহাম্মদ ইঞ্জিনিয়ার এবং মুহাম্মদ ইকবাল জগদ্বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক। স্থানীয় মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর শিয়ালকোটের স্কচ মিশন স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৯৩ সালে এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। পাকিস্তানের লাহোর কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা সমাপন করার পর আরো অধিকতর শিক্ষা ও গবেষণায় মনোবিনেশ করেন তাঁর প্রিয়ভাজন আরবি ও দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ড. টি ডবিøউ আরনল্ডের পরামর্শে। ১৯০৫ সালে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শনশাস্ত্রে মাস্টার্স এবং লিঙ্কনস্ ইন থেকে ব্যারিস্টারিও পাস করেন। পরবর্তীতে জার্মানীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০৭ সালে “ঞযব উবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ গবঃধঢ়যুংরপং রহ চবৎংরধ”. বিষয়ের উপর অভিসন্দর্ভ রচনা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। অতঃপর ১৯০৮ সালে ভারতবর্ষে ফিরে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং লাহোরের একটি কলেজে খÐকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
আল্লামা ইকবালের উর্দু ছাড়াও হিন্দি, ফারসি, ইংরেজি, জার্মান এবং আরবি ভাষায় অসাধারণ দখল ছিলো। তিনি পাকিস্তান নয় কেবল, ইরান, ভারত ও বাংলাদেশে সমান জনপ্রিয়। ইকবালের সাহিত্যে দর্শন ও ধর্ম নির্ভরতা অত্যন্ত প্রকট। ‘আসরারে খুদি’ একটি বিখ্যাত দর্শন নির্ভর কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের জন্য বৃটিশ সরকার আল্লামা ইকবালকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। মানবতার কবি ইকবাল এ বিশ্বকে বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ উপহার দেন। এদের মধ্যে উর্দু কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ শিকওয়াহ (১৯০৯), জওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯১১), বাঙ্গ-ই- দারা (১৯২৪), বাল-ই জিবরিল (১৯৩৫) জারবে-ই কালিম (১৯৩৬), ফার্সী কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ আসরার-ই-খুদি (১৯১৫), রমুজ-ই-বেখুদি (১৯১৮), যাবুর-ই-আজম (১৯২৭), জাবীদ নামা (১৯৩২), মুসাফির (১৯৩৪), পালবিহ বায়দ (১৯৩৬), রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম (১৯৩০) এবং আরমগান-ই-হিজাজ (১৯৩৮)। এছাড়া তাঁর ডক্টরাল থিসিস (১৯০৮) ও মাকাতিব-ই-ইকবাল (কয়েক খÐ) প্রকাশিত হয়। ‘শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া’ মূল মর্মকথা হচ্ছেঃ ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়াই মুসলমানের পুন এবং এর অনুসরণের মাধ্যমেই মুক্তি ও কল্যাণ নিহিত। তাঁর কাছে ইসলাম হচ্ছে একটি গতিশীল ও বিশ্বজনীন ব্যবস্থা। নিজেকে বিশ্বসভার একজন সাধারণ নাগরিক মনে করতেন।
“চীন ও আরব হামারা হিন্দুস্তাঁ হামারা
মুসলিম হ্যায় হাম, ওতন হ্যায় সারা জাঁহা হামারা
(অর্থাৎ আরব আমাদের, চীন আমাদের, হিন্দুস্তান আমাদের,
আমরা মুসলিম, বিশ্বজগত আমাদের জন্মভ‚মি)
আল্লামা ইকবালের রচিত এই গানটি বর্তমানে ভারতের অন্যতম জাতীয় সংগীতের মর্যাদায় অভিষিক্ত। ইকবালের স্বপ্ন ছিলো প্রথমত উপমহাদেশে এক বা একাধিক স্বাধীন- সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয়ত বিশ্বমানবতার আদর্শ ইসলামের মাধ্যমে বিশ্বমানবসমাজ পরিগঠন। এদিক দিয়ে ইসলামকেও কমিউনিজমের মতো একটি সা¤্রাজ্যবাদ বলা যায়। তবে মৌলিক ও উদ্দেশ্যগতভাবে এর সাথে ইসলামের মিল আকাশ-পাতাল। কারণ ইসলাম মানুষের উভয় জাহানের মুক্তি চায়, কমিউনিজম দুনিয়াকে লুটেপুটে খাওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী। পরকালে বিশ্বাস অবান্তর বৈকি!
যুবক বয়সে ইকবাল যখন ইংল্যান্ড গমন করেন, জ্ঞান গরিমায় তিনি একজন কবি, সুপÐিত এবং উদার জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পাশ্চাত্যে অবস্থানকালীন সেখানকার শিক্ষা, দর্শন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করেন। জীবন ব্যবস্থা ইসলাম এবং এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যয়নের ফলে তাঁর চিন্তাজগতে বিপ্লব সাধিত হয়। দেশে ফেরার পর ১৯২৬ সালে পাঞ্জাব আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালের এলাহাবাদে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। এই অধিবেশনেই তিনি তাঁর স্বপ্নের পাকিস্তান তথা মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভুমি রাষ্ট্রের বিষয়টি উত্থাপন করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। মহাকবি ইকবাল বিশ্বাস করতেন, ‘প্রতাপশালী রাজতান্ত্রিক সরকার হোক বা গণতান্ত্রিক সরকারই হোক, রাজনীতি থেকে যদি ধর্মকে বাদ দেয়া হয় তাহলে চেঙ্গেসিই থাকে।’ কারণ ধর্ম মানুষকে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত রাখে এবং ধর্ম মানুষকে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় পাহারা দেয়ে। আমরা যে সর্বত্রই শুনতে পাই, ইসলাম হলো জীবন ধর্ম এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, কোনো সন্দেহ নেই আধুনিক মুসলিম মানসে এই বোধ ও বিশ্বাসটিকে পুনর্জীবিত করার পথিকৃৎ ইকবাল। আর এটাও সত্য যে ইকবালের কবিতা, দর্শন, স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা ও উপলব্ধি দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়েই গড়ে উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামী সিয়াসত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। তাঁর ‘রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম’ বা ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন-গ্রন্থটিতে তারই সুদূরপ্রসারি চিন্তা প্রতিভাত হয়েছে। মূলত ৭টি ইংরেজি ভাষণের সংকলন এটি। ১৯২৮ সালে ভারতবর্ষের মাদ্রাজ, হায়দ্ররাবাদ, আলীগড়, মহিশুরসহ কয়েকটি শহরে এভাষণগুলো দেন। ১৯৩০ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, পরবর্তীতে ১৯৩৪ সালে অক্সফোর্ড সংস্করণ এবং জার্মান ভাষায়ও অনূদিু হয়। বাংলা অনুবাদ হয় ১৯৫৭ সালে ইসলামিক একাডেমি থেকে। পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের উদ্যোগে বইটির দু’টি সংস্করণ হয় ১৯৮১ এবং ১৯৮৭ সালে।
ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন বা ‘রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম সংকলনের আলোচ্য বিষয়গুলো সমকালীন মুসলমানদের মনের সংশয় এবং দোলাচল নিবারণে জিজ্ঞাসার জবাবমাত্র। গ্রন্থটিতে ইবাদু, আত্মা, ইসলামী সংস্কৃতি এবং দর্শন নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। বিষয় নির্ধারণে তিনি বেশ কৌশলী ভ‚মিকা নিয়ে আধুনিক যুগের চিন্তাধারার সাথে ইসলামের সাযুজ্যতার পরিচয় দেন। ৭টি বিষয়ের শিরোনামগুলো হচ্ছেঃ ‘জ্ঞান ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, দর্শনের চোখে প্রত্যাদেশমূলক ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা ও ইবাদতের মর্মকথা, মানুষের খুদি: তার স্বাধীনতা ও অমরতা, মুসলিম তমদ্দুনের মর্মকথা, ইসলামি জীবন-ব্যবস্থার গতিশীলতা এবং ধর্ম কী চলতে পারে?’ বাংলায় যে অনুবাদ পাওয়া যায় তার অনুবাদক কয়েকজন। সর্বজনাব কামাল উদ্দিন খান, মোহাম্মদ মোকসেদ আলী, অধ্যাপক সাইদুর রহমান এবং আবদুল হক। আমার কাছে অনুবাদকরা বড়ো বড়ো পন্ডিত-সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু অনুবাদ কর্মটি তারা বেশ কঠিন করে ফেলছেন মনে হয়েছে। ইসলাম সহজ একটা ধর্ম, তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার সহজভাবে। যাতে মানুষ তার আমলে রূপ দিতে সহজতর হয়। কারণ ঈমানের পরই আমলের প্রশ্ন! এ বিষয়টি মাথায় রেখে যেকেউ গ্রন্থটি সহজ অনুবাদ করে বিরাট খেদমত করতে পারেন। বাংলা ভাষাভাষীদের ইকবাল চর্চার জন্য এটা অত্যাশ্যকীয় বিষয়। দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (রহ) বইটির ভ‚মিকাতে বলেনঃ
এক. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান, যুক্তিলব্ধ জ্ঞান এবং বিবেকের ক্রিয়াশীলতা স্বীকারপূর্বক ইসলামি জ্ঞানের কোনো সিস্টেমকে পরিহার করা হয়নি। যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের প্রয়োগ বৈজ্ঞানিক জগতে অনিবার্য সেজ্ঞান লাভে কুরআনে বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে। দুই. প্রত্যাদেশ বা অহি অবশ্যই বিশ্বাসের ব্যাপার। ধর্মীয় জীবনের উপলব্ধি কেবল সজ্ঞা দ্বারা এবং তার ভিত্তি হচ্ছে কলব বা হৃদয়জাত উপলব্ধি। তিন. মানুষ নিজের অস্তিত্বের প্রতি অসারতা ব্যক্ত করে চরম ও পরম শক্তিশালীর মুখাপেক্ষী হতেই হবে। এটা তাকে আনুগত্যের পরাকাষ্ঠার আলোকে পরিচালিত করা দরকার। চার. মানবাত্মার অমরত্ম তার কর্মফলেরই দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কর্মফলের দ্বারা আত্মা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বা ভবিষ্যত জীবনে চলার পথে টিকে থেকে অগ্রগামী হয়। পাঁচ. চিন্তা ও সংস্কৃতির ঐক্য সম্পর্কে বিশদ আলোকপাত ছয়. ইসলামি সমাজজীবন কোনোকালেই স্থবির ছিলো না। যুগে যুগে নানা সংস্কার আন্দোলনে এর গতিশীলতা লক্ষ্য করা গেছে এবং সাত. তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ধর্ম এ যুগ নয় কেবল, কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম স্বকীয়তা রক্ষা করে সগৌরবে টিকে থাকতে পারবে। ইসলামী বিধান মেনে রাষ্ট্র ও সমাজগঠন যুগের অপরিহার্য দাবি বলে জোর দিয়েছেন। ধর্ম, দর্শন, ঈমান ও এহসানের দৃপ্ত প্রত্যয়ে ব্যক্ত করে ধর্মের উপরই সমস্ত বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করেন। ধর্মআশ্রয়ী তৌহিদবাদি কবি হিসেবে তিনি তাই লিখতে পারেন মদিনাওয়ালা নবির প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য:
“পাশ্চাত্যের চাকচিক্য
আমার চক্ষুকে প্রতারিত করতে পারেনি,
কারণ মদিনার ধূলিকতা
আমার দু’চোখে জড়িয়ে ছিলো।”
প্রবন্ধসূত্রঃ
১। আল্লামা ইকবাল কবি ও নকীব-আবু জাফর
২। ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন-আল্লামা ড.মুহাম্মদ ইকবাল
৩। আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্ম-ড. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ
৪। স্যার মুহাম্মদ ইকবাল: মোহাম্মদ মজলুম খান (অনুবাদ-আশরাফ আল দীন), নোঙর, জুন ২০১৪ সংখ্যা।
৫। ড. আল্লামা ইকবাল: জীবন ও সাহিত্য-হেলাল উদ্দিন