ভোরের আলোর প্রত্যাশায়

116

হযরত আদম (আ) এবং তার থেকে হযরত হাওয়া (আ) কে সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির সূচনা করেন। তাদের উভয় থেকে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- “হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি একটি মাত্র দেহ থেকে তোমাদের কে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন তার সহধর্মিণী (হাওয়া আঃ) কে। আর তাদের দু’জন থেকে অসংখ্য নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা নিসা-১)
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতি কে সৃষ্টি করার সাথে সাথে তাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়ার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এমন কোন যুগ বা জাতি ছিল না যাদের উপর আল্লাহ তায়ালা কোন নবী-রাসূল প্রেরণ করেননি। প্রত্যেক জাতির উপর তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। একজন নবী চলে যাওয়ার পর যখন মানবজাতি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে, নবীর শিক্ষা ভুলে যায়, আল্লাহ তায়ালার সাথে বিভিন্ন শিরকে লিপ্ত হয় এবং জমিনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে তখনি আল্লাহ তায়ালা তার নিদর্শনাবলি সহকারে পৃথিবীতে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসূলের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) কে প্রেরণের পূর্বে হযরত ঈসা (আ) কে প্রেরণ করেছিলেন। খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আ) কে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে আসমানে তুলে নেন। এরপর বেশ কিছুদিন নবী-রাসূলের আবির্ভাব বন্ধ থাকে।
লোকেরা হযরত ঈসা (আ) এর শিক্ষা ভুলে গিয়ে বিভিন্ন পাপ কার্যে লিপ্ত হতে থাকে। রাসূল (স) এর আগমণের পূর্ব পর্যন্ত এই সময়কাল কে আরব ঐতিহাসিকগণ জাহেলী যুগ বলে অভিহিত করেন। তবে তাদের এই মু কে পুরাপুরি গ্রহণ না করে ইউরোপীয় ঐতিহাসিক নিকলসন (ঘরপযড়ষংড়হ) ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দীকাল কে জাহেলী যুগ বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক পি.কে.হিট্রি ও এই মত কে সমর্থন করেন।
উপরোল্লিখিত সময়ে অর্থাৎ জাহেলী যুগে আরবের সর্বত্র মারামারি, হানাহানি ও যুদ্ধ বিগ্রহে ছেঁয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় কুসংস্কার, রাজনৈতিক মতানৈক্য, সামাজিক অন্যায়, ন্যায়বিচার পরিপন্থী, নীতি গর্হীত কাজ এবং নৈতিক অবক্ষয়ের দরুণ আরবদের সমগ্র জীবন অধঃপতনের শেষ পর্যায়ে নেমে এসেছিল। সমাজে নারীর কোন সম্মান ছিল না। তাদের কে ভোগ্যপণ্য মনে করা হতো। একজন পুরুষ একাধিক নারী কে বিয়ে করতো। তাদের নির্দিষ্ট কোন মহর ছিল না। সম্পদে তাদের জন্য কোন অংশ ছিল না। তাদেরকে সমাজের অভিশাপ মনে করতো। নারী শিশু কে জীবন্ত কবরস্থ করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করতো না। এতিমের কোন অধিকার ছিল না। সবল কর্তৃক দুর্বলরা নিয়মিত যুলুমের স্বীকার হতো। আরবের সর্বত্র সুধ ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছিল। সুধের ভিত্তিতে গরীবরা ঋত নিতো। আর সেই ঋত শোধ করতে না পারলে অনেক সময় ঋণের পরিবর্তে স্ত্রী -পুত্র পর্যন্ত বন্ধক দিয়ে দিতো। দাস-দাসীদের কোন স্বাধীনতা ছিল না। তাদের সাথে পশুর মত আচরণ করা হতো। তাদের গোত্রগুলো সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। বনু বকর ও বনু তাগলীব গোত্রের মধ্যে বাসুসের যুদ্ধ দীর্ঘ ৪০বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। চতুর্দিকে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বর্ষার ঘোর অন্ধকার রাতে প্রচÐ ঝড়-বাতাস আর আসমানের মুহুর্মুহু গর্জনের মধ্যে মাঝপথে আটকে থাকা পথিক যেমন ভোরের আলোর প্রত্যাশাই প্রহর গুণতে থাকে, ঠিক তেমনি আরবসহ সমগ্র পৃথিবী ভোরের আলোর প্রত্যাশাই প্রহর গুণতে শুরু করেছিল। কখন ভোরের আলো উদ্ভাশিত হবে আর সেই আলোতে চেপে থাকা অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। ভোরের আলোয় আলোকিত হবে চারিপাশ। সোনালী সকাল দিয়ে শুরু হবে নতুন ইতিহাস।
সমগ্র বিশ্ব এমন একজন পরিত্রাণকারীর অপেক্ষায় ছিল যিনি এসে তিমির দূর করে আলোকিত করবে চারিদিক। একজন পরিত্রাণকারীর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে গিয়ে ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেছেন-‘‘ঘবাবৎ রহ ঃযব যরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ ধিং ঃযব হববফ ংড় মৎবধঃ, ঃযব ঃরসব ংড় ৎরঢ়ব ভড়ৎ ঃযব ধঢ়ঢ়বধৎধহপব ড়ভ ধ ফবষরাবৎবৎ.” অর্থাৎ “দুনিয়ার ইতিহাসে পরিত্রাণকারীর আবির্ভাবের এতবেশি প্রয়োজন এবং এমন উপযুক্ত সময় অন্যত্র অনুভ‚ত হয়নি।”
ঠিক এমন সময় আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর মানুষগুলোকে মুক্তির জন্য বিশ্বমানবতার মুক্তির কাÐারি, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) কে ৫৭০ খ্রি: এর ১২ রবিউল আউয়াল (প্রসিদ্ধ মতে) সোমবার সুবহে সাদিকের সময় পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেছেন। তার আগমণের সাথে সাথে পৃথিবীতে অনেক কিছুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল, যার মধ্যে কেসরার রাজপ্রাসাদের চৌদ্দটি পিলার ধসে পড়া, অগ্নি উপাসকদের অগ্নিকুÐ নিভে যাওয়া এবং বোহায়রা পাদ্রীর ক‚প শুকিয়ে যাওয়া অন্যতম।
হযরত মুহাম্মদ(স) এর জন্মের ৬ মাস পূর্বে পিতা মারা যান। ৬ বছর পর মাতা এবং ৮ বছর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিবকে ও হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যান শিশু মুহাম্মদ (স)। তারপর চাচার কাছে বড় হতে লাগলেন তিনি। তার সুন্দর স্বভাব আর উত্তম আচার-আচরণে আশপাশের সবাই মুগ্ধ হতে লাগল। তাদের কাছ থেকে “আল আমীন” এবং “আস সিদ্দিক” উপাধিতে ভ‚ষিত হন যুবক মুহাম্মদ (স)। যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ করে পৃথিবীতে শান্তির ছোঁয়া বয়ে দেয়ার জন্য নবুওয়াতের পূর্বেই গঠন করেছিলেন “হিলফুল ফুজুল” সংগঠন। অনেকের মতে, এই সংগঠনটি দীর্ঘ ৫০ বছর স্থায়ী ছিল। চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করে আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে দাওয়াত দেয়া শুরু করেন। তিন বছর গোপন আর দশ বছর প্রকাশ্যে মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর পরিবেশ অনুক‚লে মনে না হওয়ায় আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন হযরত মুহাম্মদ(স)। মদিনায় এসে এমন একটি সনদ প্রণয়ন করেন, যেটি মদিনা সনদ নামে পৃথিবীর ইতিহাসে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। এরপর স্যু-মিথ্যার মধ্যে বেশকটি যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। দুয়েকটি সাময়িক বিশৃঙ্খলা ছাড়া সব যুদ্ধে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর নেতৃত্বে মুসলমানরা বিজয় লাভ করেছেন। চতুর্দিক থেকে অসংখ্য মানুষ ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন স্বয়ং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে ইসলাম ধর্মের শান্তির সুবাতাস। ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধি আর ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে গিয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে নবী কারীম (স) অন্ধকার আরবকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করেছিলেন। যে আলোর জন্য প্রহর গুণ ছিলেন সমগ্র বিশ্ববাসী। সোয়া লক্ষ সাহাবী নিয়ে রাসূল (স) ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্ব পালন করেন। বিদায় হজ্বের সময় তিনি মানবজাতির জন্য সর্বশেষ নির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। এটা বিদায় হজ্বের ভাষণ নামে পৃথিবীতে আজও স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঐসময় আল্লাহ তায়ালা অহী নাযিল করে ইসলাম ধর্মের পূর্ণাঙ্গতার স্বীকৃতি দেন। তিনি বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলাম কে পছন্দ করলাম।” (আল মায়েদা-৩)
অবশেষে বিদায় হজ্বের ৯১দিন পর একাদশ হিজরীর ১২রবিউল আওয়াল নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব শেষ করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংস্কারক, আদর্শের মহান শিক্ষক, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।