ভূমিব্যবস্থায় ওয়ানস্টপ সার্ভিস আধুনিকায়নে আরেক ধাপ

18

 

 

মানুষের নাড়ির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ভূমি বা জায়গা-জমির সম্পর্ক। এ বৈষয়িক সম্পর্ক যোগসূত্র সৃষ্টি করে পূর্ব ও উত্তর পুরুষের সাথে। সঙ্গতকারণে কারো একখÐ ভূমি থাকলে তা পরম যতেœ এবং নিখুঁতভাবে রাখার প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু কারো ছোট্ট একখÐ ভূমি বা কারো বিস্তৃত জায়গা যাই থাকুক, দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় মান্দাতা আমলের পদ্ধতি, দলির দস্তাবেজ ও নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেককে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিও ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। বিশাল জমিদারি একসময় হাতছাড়া হয়ে মানবেতার জীবন বেছে নিতে হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে যেসব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষ করে, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ভূমি মন্ত্রণালয় দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজড করার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ভিডিও কনফারেন্স-এর মাধ্যমে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’-এর উদ্বোধন করে তা শতভাগ বাস্তবায়নের পথ অবমুক্ত করেছেন। ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে সরকারের এ উদ্যোগ জনদুর্ভোগ কমাবে নিঃসন্দেহে। সূত্র জানায়, ভূমির নামজারি, দলিলাদি সংরক্ষণ, প্রকৃত মালিক নির্ণয় এবং এ সংক্রান্ত যে কোন মামলার সহজ সমাধান পাবে ওয়ানস্টপ সার্ভিস থেকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়ার কথা তুলে বলেন, “এই যে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সেবাটা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া এবং মানুষের জীবনটা সহজ করা এবং দুর্নীতি, অনিয়ম দূর করা- এটাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই এবং ভূমি ব্যবস্থাপনাটাকেও ডিজিটালাইজড করে মানুষের সেবাটা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আর মানুষের অধিকারটা সুরক্ষিত করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। ক্রমান্বয়ে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি ভবন, উপজেলা ও ইউনিয়নের ভূমি অফিস ভবন, অনলাইন ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ কার্যক্রম এবং ভূমি ডেটা ব্যাংকের মাধ্যমে মানুষ একই ছাদের নিচে সবসেবা পাবেন। ভূমি মালিকরা হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন”। আমরা প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার সাথে সম্পূর্ণ একমত। দেশের অধিকাংশ মানুষ জীবনের শেষ সম্বল তার প্রাপ্ত বা অর্জিত ভূমিটা সুরক্ষা করতে পারলে, মাথা গুজার ঠাঁই হয়, সচ্ছল জীবনের সুযোগ হয়। সরকারের এ উদ্যোগ দেশের অর্থনীতির গতিধারাকে সবল করবে; মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সহায়ক হবে বলে মনে করি।
আমরা জানি, বর্তমানে ভূমি নিবন্ধনের কাজটি হয় আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের মাধ্যমে। আর নামজারির কাজটি হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ের মাধ্যমে। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে দুই দপ্তরের মধ্যে অভিন্ন ‘সফটওয়্যার’ এর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তা যৌথভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া আমরা দেখছি, জমি বা ভূমি-সংক্রান্ত মালিকানা বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। বাড়ছে প্রতারণাও। দুষ্টচক্র দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা রকম অপকৌশলে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। ভূমি সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোতে খাজনা দেওয়া থেকে শুরু করে নিবন্ধন, নামজারি পর্যন্ত চলে পদে পদে হয়রানি- এও নতুন নয়। নামজারির জন্য জমি বা ভূমির মালিককে যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় তাও সেবাপ্রার্থীদের জন্য বাড়তি বিড়ম্বনা। জায়গা-জমিন এমনিতেই সংবেদনশীল বিষয়। এর সুযোগ নিচ্ছে একশ্রেণির অসাধু। তবে সরকারের খাজনাসহ মামালা নিস্পত্তিতে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি হয়রানি বন্ধ হলেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এর সুফল জনগণ পাবে না। স্বচ্ছতার অভাবেই বাড়ছে দুর্নীতি। সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে শুধু প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনে সুফল মিলবে না। মনে রাখা জরুরি, ভূমি খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির একটি বড় কারণ সরিষার ভূত। অতীতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক জরিপে ভূমি খাতকে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করেছিল। এ পরিস্থিতিতে সরকার এ খাতের সেবাপ্রার্থীদের সেবা পাওয়ার পথ কণ্টকমুক্ত করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে দুর্নীতি দূরীকরণে তা সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। ভূমি খাতের বিদ্যমান সমস্যা ও জনভোগান্তি দূর করার স্বার্থে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনার এ উদ্যোগের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর আধুনিকায়ন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এখন আমরা কাজ দেখতে চাই। আমরা জানি, ভূমির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সরকারের অনেক বিভাগ ও শাখা-প্রশাখা। আইন মন্ত্রণালয়ের সাথে যেভাবে সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্বচ্ছতার সঙ্গে জমি রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর সাথেও তাই করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নকে দৈনিক পূর্বদেশের পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই। এর সফলতা কামনাসহ সুফল জনগণ ভোগ করতে সক্ষম হবে-এমনটি প্রত্যাশা করি।