ব্যাংকের দায় এড়ানোর মামলায় যোগসাজশে টাকা পাচারের গন্ধ

84

ওয়াসিম আহমেদ

২০১৭-১৮ অর্থবছরে চট্টগ্রাম জেলায় তরুণ বিভাগে সর্বোচ্চ করদাতা আশিকুর রহমান লস্কর। তিনি চতুর্থ প্রজন্মের মেঘনা ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকও ছিলেন। মূলত এক ব্যাংকের ঋণের টাকায় বনে গেছেন আরেক ব্যাংকের পরিচালক। আবার পরিচালকের ক্ষমতা অপব্যবহার করে প্রায় হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নিতে পেয়েছেন ‘ভূতুড়ে’ সব সুবিধা।
একইভাবে কোনো ধরনের জামানত ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৭৫ কোটি মেরে দেছন লস্কর। মেয়াদোর্ত্তীণের দীর্ঘ আড়াইবছর পর বাদী ব্যাংকের দায় এড়ানোর মামলায় আবেদনের প্রেক্ষিতে লস্করসহ তিন জনকে দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। গতকাল আদালতটির বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ রায় দেন। বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম পূর্বদেশকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। যদিও কানাডায় সপরিবারে বিলাসবহুল জীবনযাপনে মেতেছেন এ খেলাপি। এমনই তথ্য দিয়েছে বিশ্বস্ত একটি সূত্র।
চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙা ব্যবসায় খেলাপি ব্যবসায়ী এআরএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশেকুর রহমান লস্কর। তিনি ২০১৬ সালের দিকে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। নিজের অবস্থান কাজে লাগিয়ে ব্যবসার প্রয়োজনে কর্মচারী মোয়াজ্জেম হোসাইনকে মালিক দেখিয়ে গ্রান্ড ট্রেডিং এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। যেটি দিয়ে মেঘনা ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালে ওই ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে প্রায় ১৫ কোটি ঋণ নিয়ে খেলাপি হন। একইভাবে ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে একই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন। তবে এ ঋণ প্রক্রিয়ায় লস্কর পেয়েছেন ভূতুড়ে সব সুবিধা।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, ১৭৫ কোটি ২৮ লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৭ দশমিক ৪৫ টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের দাবিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে। আশিকুর রহমান লস্করের কর্মচারী মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং তার স্ত্রী সাদিকা আফরিন দীপ্তি’র আবেদনক্রমে ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ওভারড্রাফট খাতে ১২ শতাংশ সুদে এক বছরের জন্য ১০০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে। ঋণ আবেদন পত্রের একদিনের মধ্যে কোনোরকম ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাছাই ছাড়া বাদী ব্যাংক ১০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেয়। মঞ্জুরীপত্রে সর্বশেষ বিবাদী আশিকুর রহমান লস্কর কর্তৃক রাজউক এর পূর্বাচল প্রকল্পে এক একর ভূমি সহায়ক জামানত এবং মেঘনা ব্যাংক লিমিটেডের ২০ কোটি টাকার শেয়ার লিয়েন করার শর্ত থাকলেও তা বন্ধক এবং লিয়েন না করেই বাদী ব্যাংক ঋণ মঞ্জুরীপত্র প্রদানের ১০ দিনের মধ্যেই ১০০ কোটি টাকা বিবাদীগণের হিসাবে বিতরণ করে। ১০০ কোটি টাকা বিতরণের পর মঞ্জুরীপত্রের শর্ত অনুযায়ী বিবাদীগণ কোনো টাকা পরিশোধ না করলেও দুই মাসের মধ্যে আরো ১৫ কোটি ৮০ লাখ বিতরণ করে। মঞ্জুরীপত্রের শর্ত মোতাবেক ৬০ দিনের মধ্যে বিবাদীগণ প্রস্তাবিত রাজউকের প্লট এবং মেঘনা ব্যাংকের ২০ কোটি টাকার শেয়ার গৃহীত ঋণের বিপরীতে দায়বদ্ধ করেননি। এতদসত্বেও বাদী ব্যাংক বিবাদীগণের ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ তারিখের আবেদন মঞ্জুর করে একই দিনে ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ঋণ ছাড় করে। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর সমুদয় ঋণ পরিশোধের শর্ত থাকলেও বিবাদীগণ কোনো টাকা পরিশোধ করেননি। ঋণের বিপরীতে কোনো জামানতও প্রদান করেননি। এরপরেও বাদী ব্যাংক আড়াই বছর বিবাদীদের কাছ থেকে ঋণের টাকা দাবি করে কোনো নোটিশ দেয়নি।
এমন ভূতুড়ে সুবিধা দেওয়ার পর আড়াই বছর বাদী ব্যাংকের দায় এড়ানোর মামলায় হতাশ হয়েছেন আদালত। এ নিয়ে আদালত মন্তব্য করেন, ‘বাদী ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকিং নিয়মকানুন লংঘন করে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে এবং বিতরণকৃত ঋণ আদায়ে যথেষ্ট অনীহা প্রদর্শন করেছে। বিপুল পরিমাণ ঋণের কোনো টাকা আদায় না হওয়া এবং বাদী ব্যাংকের নির্লিপ্ততার কারণে বাদী ব্যাংকের নিকট আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ কিনা সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে কিনা এবং এক্ষেত্রে বাদী ব্যাংকের কোনো যোগসাজশ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সমীচীন হবে মনে করেন আদালত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি ইউনিট (বিএফআইইউ) এর ভূমিকা রয়েছে। নাগরিকদের আমানতের সুরক্ষা নিশ্চিত কল্পে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তত্ত¡াবধান আবশ্যক।’ একইসাথে রায়ের কপি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ মামলায় আদালতের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া তিনজন হলেন, মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাদিকা আফরিন দীপ্তি ও আশিকুর রহমান লস্কর।
একই কৌশলে ব্যাংকের টাকা মেরে খাওয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া আশিকুর রহমান লস্করের আরেক আলোচিত প্রতিষ্ঠান ‘মাহিন এন্টারপ্রাইজ’। জালিয়াতি করে এবি ব্যাংক লিমিটেডের ২৭৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ মেলেছে দুদকের অনুসন্ধানে। ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। প্রতারণা, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকের এ টাকা আত্মসাতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছেন এবি ব্যাংক চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ শাখার সাবেক ম্যানেজার মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী। কেবল ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক বা মেঘনা ব্যাংক নয়, দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে সংসদে উত্থাপিত শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপির তালিকায় পাঁচ নম্বরে রয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। এমনকি লস্করের মালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠান ঋণের টাকা পানামা ও লাইবেরিয়ায় পাচারের অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করছে। তবে সব টাকা বিদেশে পাচারের পর তদন্ত ও লস্করকে আইনের আওতায় এনে জনগণের টাকা ফিরিয়ে আনা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ব্যাংক ও বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা।