বেঁচে থাকুক নৃ-গোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য

40

 

ঠিক কখন থেকে জানি না, তবে বুদ্ধির বয়স থেকেই তাদের প্রতি একটি অন্যরকম টান অনুভব করেছি। তাদের রকমভেদে ঘরবাড়ি তৈরির ঢং, তাদের পোশাক, খাবারের বৈশিষ্ট্য, আচরণ, সবমিলিয়ে খুব টেনেছে বরাবরই। সেই ছেলেবেলায় পিতা আর বড় বেলায় স্বামী বা বন্ধুদের সাথে নিয়ে চলে গেছি তাদের কাছাকাছি। কাছে থেকে উপভোগ করার চেষ্টা করেছি তাদের জীবনযাপনে সাদামাটা কিন্তু মাধুর্যপূর্ণ আয়োজন। এই বৈচিত্র্য সন্ধানে তাই জুটেও গেছে কয়েকজন পাহাড়ি বন্ধু। তাই হয়তো একটু কাছে থেকে দেখার সুযোগ একটু বেশি হয়েছে।
পাহাড় এখন সেজেছে বর্ণিল সাজে। বছর বিদায় ও বরণ ঘিরে শুরু হয়ে গেছে উৎসাহ উদ্দীপনার আনন্দ আমেজ। আর বৈসাবি আমাদের পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামে স¤প্রদায়ভেদে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই আর তঞ্চ্ঙ্গ্যা ও ত্রিপুরারা ফুল বিজু উৎসব পালন করে ।
পাহাড়ি রমনীরা সবসময়ই একটু সৌখিন পোশাকে আশাকে, চলনে বলনে। এসময়ে তারা নতুন পোশাকে , রকমারি রূপার গয়না , মাথায় ফুল গুঁজে উৎসব আমেজে মেতে ওঠে। এই দিনে খুব ভোরে ঘুম হতে উঠেই রকমারি ফুল কুড়িয়ে তা একটি পাতায় প্রদীপযোগে পানিতে ভাসিয়ে কামনা করে একটি সুন্দর বছরের, যা তাদের জীবনে সুখ – শান্তি বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করে। এছাড়াও নারী পুরুষে পানি খেলা, একসাথে বিহারে মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করা , আবার একই সাথে হয় নানাধরনের নাচ ,গান ও খেলাধুলার আয়োজন। মূল বৈসাবির দিনে প্রধান আকর্ষণ হলো পাচন। পাচন মূলত অনেক রকম সবজির মিশ্রণে তৈরি করা তরকারি। ৩০ থেকে ৫০ রকমের সবজি দিয়ে এটি রান্না করা হয়। বৈসাবি মানে আনন্দ, হইহুল্লোড়, বৈসাবি মানে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো। বৈসাব মানে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, সর্বোপরি বৈসাবি মানে হলো মিলনমেলা।
ক’দিন আগে সম্ভবত ৮ এপ্রিল ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় সাহিত্যিক আনিসুল হক এর বাংলাদেশ শুধু বাঙালির নয় শিরোনামে একটা লেখা পড়েছি। চমৎকার লেগেছে। যেখানে তিনি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাদের সমতলের অবস্থানরত জনজাতি বা নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসীরা যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এবং একই সাথে আমাদের দেশের আদিবাসীরাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নামে ‘ক্ষুদ্র’ শব্দটির সাথে পরিচিতি পেয়ে নিজেদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল ভেবে ক্রমেই এই দেশ হতে তাদের অধিকারের জায়গাটাও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এই লেখাটি নিজের বিবেকের দেয়ালে নাড়া দিয়ে গেলো।
আসলেই তো , একটু ভাবলেই বোঝা যায় একটি রাষ্ট্র শুধুমাত্র একটি বড় জনগোষ্ঠী বা নৃ-গোষ্ঠী দিয়েই গড়ে ওঠে না। বরং ছোট- বড় নানা নৃগোষ্ঠী তাতে থাকে, নানা ধর্ম -বর্ণ-শ্রেণি-পেশার লোক নিয়েই একটি রাষ্ট্র ; যেখানে বসবাসরত সকল নাগরিক সমান অধিকারে , সমান মর্যাদায় বসবাস করবে। আর দেশে বসবাসকারী মানুষ বিশেষ করে ধর্ম, বর্ণ বা নৃতাত্তি¡ক বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন হয় বা সংখ্যায় ক্ষুদ্র হয় তাদের প্রতি একটি দেশ কেমন আচরণ করছে তার ওপর কিন্তু একটি দেশের রাষ্ট্রনায়কের মানসিকতা এবং দেশটি কতোটা উন্নত হয়েছে তারও পরিচয় পাওয়া যায়। শুধু মাথাপিছু আয় বা অবকাঠামোগতভাবে কতোটা উন্নত হয়েছে তা বিবেচনা করলে হবে না ।বরং একটি স্বাধীন দেশে সকল জনগোষ্ঠী কিভাবে, কতোটা স্বন্তি , শান্তি ও স্বাধীনভাবে বাস করতে পারছে তাও কম গুরুত্ব বহন করে না।
কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্যনীয়, তা হলো কালের বিবর্তনে আমাদের পাহাড়ি বাঙালিদের যে নিজস্ব মৌলিক কৃষ্টি , সংষ্কৃতি বা সমাজ ব্যবস্থা, তা মূল ধারা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে গেছে। লুপ্ত এসব ভাষা সংরক্ষণে চেষ্টা যেমন দরকার, তেমনি দরকার এখন যেসব ভাষা আছে, সেগুলোর সঠিক লালন। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি এ দেশের অমূল্য সম্পদ একই সাথে অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক নানা উপাদান এসব জাতিগোষ্ঠীর সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
জাতীয় উন্নয়নের জন্যই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির বিকাশে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। দেশের সংখ্যাগুরু বা কেন্দ্রের মানুষের উচিত প্রান্তের বা সংখ্যায় কম মানুষের সংস্কৃতির বিকাশে এগিয়ে আসা। ক্ষুদ্র সংস্কৃতির বিকাশে সা¤প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাকে বড় অন্তরায় বলেও বিবেচনা করা যায়। দেশে স্বীকৃত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০টি। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন সংশোধন করে ২৭ থেকে ৫০টি গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উপাদান মানুষে মানুষে বিভাজন বন্ধ করতে পারে। তাই এই কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা ও সম্প্রসারণে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
পরিশেষে বলতে চাই, ছোট ছোট ভুলগুলো বড় বড় সম্পর্ক, সম্প্রীতি নষ্ট করে। সেই ছোটখাটো ভুলগুলো শুধরে নিয়ে সকলের সাথে সকলের সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে সবাইকে। এই দেশ আমাদের সবার। ধর্মে, বর্ণে আমরা ভিন্ন হতে পারি। কিন্তু সকল জাতিগোষ্ঠীর ভালো থাকাতে নিজেদের আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। এই দেশ অসা¤প্রদায়িক চেতনার দেশ। এই দেশে পূর্বে যেমন সকলে মিলেমিশে একথালাতে সকল সুখ খুঁজে পেয়েছে তেমনি আমাদের আগামী দিনগুলোও তেমনি সুখ ভাগাভাগির হোক।
আসছে নতুন বছর।
এই দেশ আমার তোমার সবার,
চিন্তনে মননে অসাম্প্রদায়িক দেশ
এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক