বিনা টিকিটের যাত্রীরা মন্ত্রীর আত্মীয় নন

29

পূর্বদেশ ডেস্ক

রেলমন্ত্রীর ‘আত্মীয়’ পরিচয়ে বিনা টিকিটের তিন ট্রেন যাত্রীর সঙ্গে ‘অসদাচরণ’ করার দায়ে ঈশ্বরদীর ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক বা টিটিই শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা যাত্রীরা রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয় নন। গতকাল শনিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এমনই দাবি করেছেন।
বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়াসহ জরিমানা আদায় ও টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সেই ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলামকে পশ্চিমাঞ্চল পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে কার্যালয়ে তলব করে গতকাল শনিবার চিঠি দিয়েছে তদন্ত কমিটি। আজ তিনি হাজির হয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানাবেন। তিন সদস্যের কমিটিতে পাকশী বিভাগীয় সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলামকে প্রধান করা হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটিকে দুই কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে নৈতিক অবস্থান থেকে রেলমন্ত্রীকে সাময়িক সময়ের জন্য পদত্যাগের আহŸান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ওদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। নাম ভাঙিয়ে কেউ হয়তো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি বলেন, ঘটনাটি আজ (শনিবার) সকালেই শুনেছি। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ওই টিটিই বিনা টিকিটের যাত্রীদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করেছেন। সে কারণেই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রেলের দাপ্তরিক কার্যক্রমের সঙ্গে মন্ত্রীর কোনো সংযোগ নেই জানিয়ে নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয় জড়িত নন। রেল কর্মকর্তারা ওই টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।
সরকার রেলসেবা বাড়াতে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিনা টিকিটের যাত্রী যদি মন্ত্রীর আত্মীয়ও হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। একইভাবে কোনো রেল কর্মকর্তা যদি যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, তাকেও শাস্তি পেতে হবে। যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার কারণে টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খবর বাংলানিউজের।
বরখাস্ত হওয়া টিটিই শফিকুল ইসলাম রেলওয়ে জংশন স্টেশন ঈশ্বরদীর টিটিই হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যুক্ত। ঘটনার রাতে টিটিই শফিকুল ইসলাম ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে দায়িত্বরত ছিলেন। ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে ৫ মে দিবাগত রাতে ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন থেকে তিন যাত্রী বিনা টিকিটে এসি কেবিনে চেপে বসেন। এ সময় টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের কাছে টিকিট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। টিটিই বিষয়টি পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (এসিও) নুরুল আলমের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি সর্বনিম্ন ভাড়া নিয়ে টিকিট কাটার পরামর্শ দেন। এসিওর পরামর্শ অনুযায়ী টিটিই শফিকুল ইসলাম ওই তিন ট্রেন যাত্রীকে এসি টিকিটের পরিবর্তে মোট ১০৫০ টাকায় জরিমানাসহ সুলভ শ্রেণির নন এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকিট বানিয়ে দেন।
ওই তিন যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেনে লিখিত কোনো অভিযোগ না করলেও তারা ঢাকায় পৌঁছে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ‘অসদাচরণ’ করার অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগ পেয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন সংশ্লিষ্ট টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন।
রেলমন্ত্রীর সাময়িক পদত্যাগ চায় টিআইবি
এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে রেলমন্ত্রীর আত্মীয়দের বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের দায়ে জরিমানা করায় এক টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) বরখাস্ত হওয়ার ঘটনা ন্যাক্কারজনক। তাই নৈতিকবোধ থেকে মন্ত্রীর সাময়িক সময়ের জন্য পদত্যাগের আহŸান জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহŸান জানিয়েছে টিআইবি।
সংস্থার পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মন্জুর-ই-আলম স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়- বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের দায়ে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর তিন আত্মীয়কে জরিমানা করায় সংশ্লিষ্ট টিকিট পরিদর্শককে (টিটিই) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এটি একটি ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত। এ ঘটনায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গভীর উদ্বেগ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।
ন্যায়-নিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট টিটিইকে তড়িৎ গতিতে বরখাস্তের সিদ্ধান্তে দেশবাসীর কাছে এই বার্তাটিই পরিষ্কার হয়েছে যে, ক্ষমতাবানরাই শুধু নয় বরং তার/তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকা আত্মীয় পরিজনদের জন্যও আইন প্রযোজ্য নয়। বরং অনিয়মের কাছে মাথানত করাই, রুটিরুজি টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায় বলে মন্তব্য করছে টিআইবি।
একই সঙ্গে, ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে নৈতিক অবস্থান থেকে রেলমন্ত্রীকে সাময়িক সময়ের জন্য পদত্যাগের আহŸান জানাচ্ছে সংস্থাটি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রধরে শনিবার এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঘটনাটি ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি নির্লজ্জ ও নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এখানে মূলত দুইভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত রেলমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ অর্থাৎ তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে, রেলের প্রচলিত আইন তাদের জন্যপ্রযোজ্য নয়!
দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট টিকিট পরিদর্শক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করায়, কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল ফোনে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে বরখাস্ত হওয়ার ঘটনা- দেশবাসীর কাছে এই বার্তাটিই পৌঁছেছে যে, ক্ষমতার দাপট ও অনিয়মই হচ্ছে বাস্তবতা।
এছাড়া, এই নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত এখনও গুটিকয়েক যারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে স্ব স্ব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের জন্য একটি শক্তিশালী নেতিবাচক বার্তা হিসেবে বিবেচিত হবে।