বিটকয়েনের গোলক ধাঁধা

146

আচ্ছা বলুন তো পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দামী কাগুজে মুদ্রা কী? একবাক্যে সবাই বলবেন ইউএস ডলার। এক ইউএস ডলার বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮৫ টাকা। ইউএস ডলার ছড়াও ইউরো, পাউন্ড, কুয়েতি দিনারের মূল্যমানও বেশি কিন্তু এখন আমি আপনাদের এমন একটি মুদ্রা সম্পর্কে বলব যা শুনে হয়ত আপনার চোখ কপালেও উঠতে পারে। মুদ্রাটি হলো ‘বিটকয়েন’। অনলাইনের কল্যাণে এই নামটি এখন অনেকেই জানেন। এটি একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা যা কয়েন বলা হলেও কিন্তু ধরা বা ছোঁয়া যায় না। বর্তমানে ১ বিটকয়েন-এর মূল্য কত জানেন? একটু নড়েচড়ে বসুন। এক বিটকয়েন-এর মূল্য ৭,৫৭০.৩১ ইউএস ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় ৬,৪০,৬১১.৮৮ (ছয় লক্ষ চল্লিশ হাজার ছয়শত এগারো টাকা অষ্টাশি পয়সা)। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? চাইলে গুগলে সার্চ করে দেখতে পারেন। অন্যান্য মূদ্রার মতো বিটকয়েনের মূল্যমানও উঠা-নামা করে।
২০০৯ সালে যখন এর যাত্রা শুরু হয়েছিল তখন ১০,০০০ বিটকয়েনের মূল্য ছিল মাত্র ২৫ ডলার। এখন অবশ্যই সবার মনে হচ্ছে ইস! সেই সময় যদি বিটকয়েন কিনে রাখতাম তাহলে আমার ভবিষ্যত আরো ৩ পুরুষ বসে বসে খেতে পারত কিন্তু কেন এই বিটকয়েন এতো জনপ্রিয় আর এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে এর মূল্য বাড়ার কারণই বা কী? শুরুতেই আমরা জানি বিটকয়েনের ইতিহাস। বিটকয়েন একটি ওপেনসোর্স ক্রিপ্টোকারেন্সি। যেকেউ এটি নিয়ে কাজ করতে পারবে। এটি তৈরি করেন সাতোশি নাকামোতো কিন্তু মজার বিষয় এই যে কে এই সাতোশি নাকামোতো এ ব্যাপারে কোনো পরিষ্কার তথ্য করো কাছেই নেই। এটি ব্যক্তি নাকি কোনো প্রতিষ্ঠান সেটি কেউই বলতে পারবে না। তবে ধারণা করা হয় এর নামের সাথে জাপানী ভাষার একটি সম্পর্ক আছে বিধায় এটিতে জাপানের কেউ জড়িত। বিটকয়েন জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হচ্ছে এটির ট্র্যাকিং সিস্টেম। বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেনের টাকা কোথায় যাচ্ছে এবং এর মালিক কে তা ট্র্যাক করা সম্ভব না। তাই বেশিরভাগ অবৈধ লেনদেন এই বিটকয়েনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে সারাবিশ্বে যে র‌্যানসমওয়্যার আক্রমণ ঘটেছিল তার মুক্তিপণের টাকাগুলো হ্যাকাররা এই বিটকয়েনের মাধ্যমেই লেনদেন করেছিল। গোপনে লেনদেনের জন্য সবাই বিটকয়েনকেই প্রাধান্য দেয় যার ভালো ও খারাপ উভয় দিকই আছে। বিটকয়েন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আগেই বলেছি এটি একটি ওপেন সোর্স ক্রিপ্টোকারেন্সি। এটি নিয়ন্ত্রণ ও ভেরিফাই করে এর ব্যবহারকারীরাই। আমরা যখন কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে এক একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে টাকা পাঠাই তখন ব্যাংকের সার্ভার লেনদেনটি কনফার্ম করে। প্রাপকের একাউন্টে টাকা যোগ করে এবং প্রেরকের একাউন্ট থেকে টাকা কমানো হয়। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে যখন কোনো একাউন্টে বিটকয়েন ট্রান্সফার হয় তখন তার সাথে কিছু আলগরিদম বা গাণিতিক সমস্যা যুক্ত হয় এবং প্রত্যেকটি কয়েনের সাথে একটি গাণিতিক নম্বর লাগিয়ে দেয়া হয় একে ট্র্যাক করার জন্য। তখন নেটওয়ার্কের অন্য কম্পিউটারগুলো গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে থাকে এবং একাউন্ট নম্বরটি ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিটকয়েন ট্রান্সফারটি ভেরিফাই করে। বিটকয়েনের এই বিশাল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে যারা এই ট্রানজেকশনগুলো সফল করিয়ে দেয় তাদের বলা হয় বিটকয়েন মাইনারস। তারা যদি এই ঝামেলার গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে সবার আগে ট্রানজেকশন করিয়ে দেয় তাহলে ট্রানজেকশন তো হয়েই যাবে এবং এই কাজ করিয়ে দেয়ার জন্য মাইনারসরাও কিছু বিটকয়েন পুরস্কার স্বরূপ অর্জন করতে পারবে। তবে কাজটি অত সহজ নয়।
মাইনিংয়ের জন্য অনেক শক্তিশালী কম্পিউটার প্রয়োজন হয় যেখানে অনেক শক্তিশালী জিপিইউ লাগানো থাকে যার ফলে অনেক বেশি বিদ্যুতের ব্যবহার হয়। অবশ্য এখন বিটকয়েন মাইনিংয়ের জন্য অনেক রেডিমেড হার্ডওয়্যার পাওয়া যায়। আপনি সারাদিন চেষ্টা করলেও ইঞঈ ০.০০০০০০২৫ (বিটকয়েনকে সংক্ষেপে ইঞঈ বলা হয়) ইনকাম করতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। বিটকয়েন-এর ক্ষুদ্র একক হলো সাতোশি। এক টাকা যেমন ১০০ পয়সা তেমনি ১ বিটকয়েন = ১০,০০,০০,০০০ (১০ কোটি) সাতোশি। তাই আপনাকে সাতোশি কামাতে হবে।
বিটকয়েন মাইনিংয়ের লাভ-লোকসান হিসাব করার জন্য অনলাইনে অনেক ওয়েবসাইট পাবেন। তবে একটি ব্যাপার অবশ্যই জেনে রাখবেন বাংলাদেশ ব্যাংক-এর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিটকয়েন লেনদেন এদেশে নিষিদ্ধ। বিটকয়েনের সকল আদান-প্রদানকে অবৈধ হিসাবে ধরা হবে এবং আপনি মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় পড়বেন। বিটকয়েনেরও কিন্তু লিমিটেশন আছে। এটি এমনভাবে বানানো হয়েছে যে ২১ মিলিয়ন বিটকয়েনই বাজারে থাকতে পারে। কেননা এই মুদ্রা অনেক বেশি বেড়ে গেলে এর মূল্য কমে যাবে। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। এমন একসময় আসবে যখন নতুন কোনো বিটকয়েন আর মার্কেটে আসবে না। ক্রিপ্টোকারেন্সির ভবিষ্যত খুবই ভালো কারণ আগামী দিনে এ ধরনের লেনদেনের ওপর মানুষের আগ্রহ বাড়বে। ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানও নিজেদের ক্রিপ্টোকারেন্সি লিবরা বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে। বিটকয়েনকে অনেকে ফিউচার মানি হিসেবেও মনে করছে।