বাকলিয়ায় দিন-রাত সমানে চলে মাদক-জুয়ার আসর

80

মনিরুল ইসলাম মুন্না

বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় চলছে রমরমা জুয়া ও মাদকের আসর। বাস্তুহারা-ক্ষেতচর এলাকা, রাজাখালীর পূর্বে, মিয়া খান সড়ক, ডিসি রোডে ট্যাক্সি, টেম্পু ও রিকশা গ্যারেজসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে জুয়া। আর জুয়ার পাল্লায় পড়ে নষ্ট হচ্ছে তরুণ-যুবকরা। এ নেশার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই।
জুয়ার আসর সবচেয়ে বেশি দেখা মিলেছে শহীদ এনএমএমজে কলেজ সড়ক দিয়ে বাস্তুহারা যাওয়ার পথে। এসব আসরে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার খেলা চলে। আবার আসরের পাশাপশি চলে মাদক বিক্রি ও সেবন। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাকে ম্যানেজ করে এসব আসর পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, প্রতিনিয়ত জুয়া-মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত জুয়ার আসরে অবস্থানকালে নানা তথ্য পাওয়া যায়।
প্রতিবেদকের পরিচয় গোপন রেখে সরেজমিন দেখা গেছে, বাস্তুহারা যাওয়ার আগে বিদ্যুতের বড় টাওয়ারের গোড়ায় শুঁটকি মাঠের উত্তর দিকে যাওয়ার পর দেখা মিলল খোলা একটা মাঠের। একসময় আঁখক্ষেত থাকাতে এটিকে আঁখক্ষেতও বলে কেউ কেউ। মাঠের পূর্বদিকে গড়ে তোলা হয়েছে টিন দিয়ে তৈরি একটা ঘর। ঘরটি বেশ বড়। যার একপাশে ছোট একটি দোকান আছে, যাতে বিক্রি করে গাঁজা, সিগারেট, চানাচুর আর ঝালমুড়ি। যাতে মদ দিয়ে খাওয়া যায়। ঘরের ভেতরে বসেছে চারটি জুয়ার টিম। চারজনের পাশে রয়েছে আরও ৬-৭ জন করে। কেউ কেউ আবার খেলোয়াড়দের দিক নির্দেশনা প্রদান করছেন। প্রতি টিমে সদস্য রয়েছেন চারজন করে। তাদের সবার হাতে রয়েছে তাসের কার্ড এবং মাঝখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি হাজার টাকার নোট। চারটি বোর্ডে হাজার টাকার নোট দিয়ে চলছে খেলা এবং সিগারেট-গাঁজা সেবন। দুই বোর্ডে চলছে ফ্ল্যাশ তথা তিন পাত্তি খেলা আর দুই বোর্ডে চলছে কাইট খেলা (হিন্দিতে যেটাকে আঁন্দার-বাহার খেলা বলে)। বেশ কিছুক্ষণ খেলা দেখার পর টিমের এক সদস্য দুই হাজার টাকায় খেলতে এসে ২৫ হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। অন্য সদস্যরা হেরে গেলেন। যারা হেরে গেছেন তাদের কেউ কেউ সিগারেট আর গাঁজা সেবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে সকাল থেকে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত খেলা চলে আর খেলার টার্নওভার ৫-৬ লাখ টাকা পর্যন্ত হয় বলে জানালেন খেলতে থাকা কয়েক ব্যক্তি।
পুরো আসরটি নিয়ন্ত্রণ করছেন মো. ইসমাঈল ও জিয়া নামে দুই ব্যক্তি। তারা প্রতি খেলার শুরুতে ২০ টাকা করে নিয়ে নেন। নিজেরাও জুয়া খেলেন। মজার বিষয় হচ্ছে প্রতিদিন গভীর রাতে খেলার শেষ পর্যায়ে চলে একটি লটারি। আর এ লটারি পরিচালনা করেন জিয়া। লটারির দাম ১০ হাজার টাকা। ভাগ্যবান ব্যক্তি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে পেতে পারেন দুই লাখ টাকা পর্যন্ত।
নাম পরিচয় গোপন রেখে খেলতে আসা এক সদস্য বলেন, এখানে যারা আসেন সকলেই মধ্যবিত্ত। তার মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ-যুবক। তাদের মধ্যে কেউ নিতে আসে আবার কেউ দিতে আসে। জুয়া খেলাটাই এমন।পুলিশ কোন সমস্যা করে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব মহলে ম্যানেজ করেই এসব চালানো হচ্ছে। তা না হলে এতজন দিয়ে এত বড় পরিসরে জুয়া পরিচালনা করতে পারত? আবার এখানে রাত হলে জুয়ার পাশাপাশি ইয়াবা-মদের আসর চলে। তাদের সিন্ডিকেটটা তো অনেক বড়। বাস্তুহারা ও রাজাখালী মিলে ১৩ জনের সিন্ডিকেট এখানে। জায়গা দখল, মাদক ব্যবসা, দেহ ব্যবসা, জুয়ার আসর সবই পাবেন এখানে।
সিন্ডিকেটে কে কে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মো. সালাউদ্দিন (প্রকাশ টোকাই সালাউদ্দিন), বাস্তুহারা সমিতির সভাপতি উত্তম কুমার শীল, সেক্রেটারি মো. সালাউদ্দিন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অরুণ কান্তি দাশ, সদস্য মো. ফারুক, মো. ইসমাঈল, মো. জিয়া, বাপ্পী, মো. আরমান, মো. জামাল, মো. রুবেল বাকি একজনের নাম বলতে পারছি না। এদের মধ্যে টোকাই সালাউদ্দিনের বেশ কয়েকটি মামলা থাকলেও পুলিশ তাকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
জুয়ায় আসা আরেকজন বলেন, এখানে প্রতিদিন ৫-৬ লাখ টাকার জুয়া, লাখ টাকার মত ইয়াবা-মদ সেবন হয়। আর কিছু চাইলে, তাও পাবেন। দিন-রাত খেলা চলে। পরিচালনাকারীরা দৈনিক পায় ৩০ হাজার টাকারও বেশি। যার একটা অংশ সিন্ডিকেট মেম্বার, পুলিশ ফাঁড়ি, থানায় দিয়ে আসতে হয়। প্রতিদিন জিয়া টাকা তুলে আর জামাল গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দিয়ে আসে যাতে ডিস্টার্ব না করে।
পুলিশ ফাাঁড়ির টাকা ও থানার টাকা কে নেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামালে সরাসরি পুলিশ ফাঁড়ির এসআই করিমুজ্জামানকে পাঁচহাজার টাকা দিয়ে দেন এবং থানার ক্যাশিয়ার মো. শফিকে (পুলিশের কেউ নন) সাতহাজার টাকা দেন। ছয়হাজার টাকা দিতে হয় বাস্তুহারা সমিতির সদস্যদের (যারা সিন্ডিকেটে আছেন)। বাকিগুলো ইসমাঈল-জিয়া ভাগবাটোয়ারা করে রেখে দেন।
নিয়ন্ত্রক মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘জুয়ার আসর কে পরিচালনা করে আমি আপনাকে জানাব। তবে আমি এসব করি না।’
বাস্তুহারা সমিতির সভাপতি উত্তম কুমার শীল বলেন, ‘মাঝখানে একবার পুলিশ এসে অভিযান দিয়েছিল, তবে বাস্তুহারা সমিতির কেউ নেই। সব রাজাখালির মানুষ। আমার বিরুদ্ধে বার্মা জসিম ও সোহেল হোসেন তালুকদার ষড়যন্ত্র করছে। আমি এসবের মধ্যে নেই।’
স্থানীয় এক দোকানদার জানান, এখানে নিয়মিত পুলিশ এসে টহল দিয়ে যায়। তারপরও জুয়া ও মাদকের আসর বন্ধ হয় না। কিছুদিন আগে ব্রিক ফিল্ডের পাশে জুয়ার আসর পরিচালনা হলেও এখন আঁখ ক্ষেতে (শুঁটকি মাঠের পাশে) চলে এসেছে। এতে করে তরুণ-যুবকরা সর্বস্ব হারাতে বসছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এসব বিষয়ে জানতে বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাশেদুল হককে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি সাড়া দেননি। তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (চকবাজার জোন) কামরুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জুয়া, মাদকসহ নানা অপকর্মে কেউ জড়িত থাকলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিব। এতে যদি আমাদের ইউনিটের কেউ জড়িত থাকে তাকেও আমরা ছাড় দিব না।’