বঙ্গোপসাগরে ১০ ট্রলারে ডাকাতি কোটি টাকার মাছ লুট

12

তুষার দেব

ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুমে সাগরে টানা ৬৫ দিন সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়ে মাছ আহরণ শুরু হতে না হতেই সাগরে দেখা দিয়েছে ডাকাতের উৎপাত। জেলেদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকাকালে মৎস্য আহরণ ঠেকাতে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী যে তৎপরতা প্রদর্শন করে সাগরে জেলেদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকে। এতে অরক্ষিত সাগরে মাছ আহরণ করতে গিয়ে জেলেদের চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হচ্ছে।
সাগরে ইলিশের প্রজনন মৌসুমের নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ আহরণ শুরু হওয়ার পর গত ২৮ জুলাই বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ১০টি ট্রলারে ডাকাতিন খবর মিলেছে। ওইদিন দিবাগত রাত সাড়ে দশটার দিকে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে ফিরে আসার সময় ৩০ থেকে ৩৫ জনের সশস্ত্র ডাকাত দল অন্তত দশটি ট্রলারে লুটতরাজ চালিয়েছে। জলদস্যুরা এ সময় আহরিত মাছ, ট্রলারের মূল্যবান যন্ত্রাংশ ও মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়। শেষে ট্রলারের ইঞ্জিনে ভাঙচুর চালায়। জেলেরা বাধা দিলে তাদের মারধর করা হয়।
পাথরঘাটা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, সাগরে মাছ আহরণ শুরু হতে না হতেই জলদস্যুদের উৎপাতও সমানে বাড়তে শুরু করেছে। প্রশাসন নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় যতটা উৎসাহ দেখায় সাগরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ততটা উদাসীনতার পরিচয় দেয়। জীবন বাজি রেখে আমিষের যোগান দেয়া জেলেদের নিরাপত্তা বিধানের কেউ নেই। মাছ আহরণ শুরু হতে না হতেই এফবি জুনায়েদ ও এফবি শাহ মোহছেন আউলিয়া-৩ নামে দুটি ট্রলারসহ অন্তত দশটি ট্রলার ডাকাতের কবলে পড়েছে। বিষয়টি র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশকে জানানো হয়েছে। জেলেরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
কোস্টগার্ড পূর্বাঞ্চলের গোয়েন্দা শাখার ইনচার্জ ও জনসংযোগ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট আবদু রউফ পূর্বদেশকে বলেন, সাগরে নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ আহরণ সবেমাত্র মাছ শুরু হয়েছে। আমাদের সীমানায় এখন পর্যন্ত কোনো ধরণের দস্যুতার খবর পাওয়া যায়নি। কোস্টগার্ডের সদস্যরা সাগরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি সব ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
নৌ পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোমিনুল ইসলাম ভ‚ঁইয়া বলেন, বঙ্গোপসাগরের মতো বিশাল জলরাশিতে অভিযান পরিচালনার ক্ষেতেও হয়তোবা আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট ও সক্ষমতার এখনও অভাব রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন বাহিনীর সাথে সমন্বয় সাধন করে জলদস্যুদের অপতৎপরতা রুখে দিতে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। সাগরে আমাদের জলসীমা নিরাপদ রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীন কোম্পানি জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে কয়েকবছর ধরে জলদস্যু নিধনে র‌্যাবের সর্বাত্মক তৎপরতায় তা নিয়ন্ত্রণে এলেও একেবারে নিশ্চিহান হয়ে যায়নি। সে কারণে গত বছর সাগরে জলদস্যু চক্রের অপতৎপরতা পরিলক্ষিত হয়েছে। উপক‚লে সংঘবদ্ধ জলদস্যু চক্রের সদস্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ফিশিং ট্রলারসহ গভীর সাগরে অবস্থানরত বিদেশি জাহাজে হানা দিয়ে লুটপাট চালিয়েছে। গতবছর কেবল পূর্বাঞ্চলেই শতাধিক ফিশিং ট্রলারে লুটতরাজ চালানো হয়েছে। জলদস্যুরা কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জাল, মাছ ও জ্বালানি লুটপাট করেছে। বেশ কয়েকজন জেলেকে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। বিশেষ করে বাঁশখালী-আনোয়ারা এলাকার ফিশিং ট্রলারই সবচেয়ে বেশি ডাকাতের কবলে পড়েছে।
সাগরে জলদস্যুদের তান্ডব রুখে দিতে বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছে জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, জলদস্যুতা নির্মূলে সকল স্টেশনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কর্মপরিধি প্রণয়ন করা হচ্ছে। র‌্যাবের অভিযানের মুখে সাগরে জলদস্যু বাহিনীর উৎপাত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। জলদস্যু সর্দারের অনেকে কারাগারে আটক রয়েছে। যারা জামিনে বেরিয়ে এসেছে তাদের গতিবিধির উপর নজর রাখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বিগত ২০১২ সালে সুন্দরবনের জলদস্যুতা দমনের জন্য সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সদস্যরা ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি পর্যন্ত সুন্দরবনসহ উপক‚লীয় এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অর্ধশত জলদস্যু নিহত হয়। চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী এবং কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতেও চিহ্নিত কয়েকজন জলদস্যু সর্দার কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এ সময় বাঁশখালী ও কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় তৎপর পাঁচ শতাধিক জলদস্যু ৪৭০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও সাড়ে ২২ হাজার গুলিসহ র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে।