ফররুখের কবিতার শব্দাবলি : আশাবাদী জাগরণ

183

কবি ফররুখ আহমদের প্রায় সমগ্র সৃষ্টিতেই শব্দের পরতে পরতে জাগরণ, স্বপ্ন, আশাবাদ, উত্তরণ, নিশাশেষে সবার আগে জেগেওঠা, দূরের কুয়াশার প্রচ্ছন্নতা ভেদকরে আলোকশিখার আভাস পরিলক্ষিত হয়। অল্পকথায় বললে, স্বপ্ন আর জাগরণের আশাবাদ প্রভাববিস্তার করার মত বলিষ্টতা নিয়ে প্রকাশপায়। অনন্তস্বপ্নের কথা, কবির অভিযাত্রিক মানসের এক শুভসূচনার কথা, এক অসম্ভব গতিময়তার কথা, প্রবল আত্মবিশ্বাসের কথাও দেখতে পাই।
“ওরে পাখি, জেগে ওঠ, জেগে ওঠ রাত্রি এল বুঝি,
ঘুমাবার কাল এল জাগিবার সময় যে যায়
ওরে জাগ্ জাগ্ তবু অকারণে। রাত্রির ভেলায়
কোন অন্ধ তিমিরের স্রোত আশা নিরুদ্দেশে যূঝি
হে বিহঙ্গ, দিকভ্রষ্ট নাহি হোয়া যেন পথ খুঁজি অবেলায়।
এখনো সম্মুখে আছে ঝড় আছে ভয়
এখনো আনন্দ আছে খুঁজিবার দূরন্ত বিস্ময়”
কবি ফররুখ আহমদের প্রথম প্রকাশিত এই ‘রাত্রি’ কবিতায়ও প্রথমোক্ত শব্দগুলো সত্য। কবির এই ‘রাত্রি’ কবিতায় যে স্বপ্নের উদ্দামতা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাঁর শেষ লেখার ভেতর সেই স্বপ্নের বন্ধন ছিঁড়ে স্বপ্নভঙ্গের হতাশাও প্রকাশিত হতে দেখি। আর জীবনের শেষ লেখা ‘স্বপ্নের অধ্যায় শেষ’ কবিতাটিতে দরিয়ার মাঝি, সাহসের তেজ, স্বপ্নের মিছিল নেই। এ যেন অন্যলোকের অন্য এক কবি। তিনি ভিন্ন জগতের বিষন্নতায় ক্লান্ত এক কবি। কবিতাটি এখানে তুলে ধরছি :
“স্বপ্নের অধ্যায় শেষ। দু:স্বপ্নের এ বন্দী শিবির
সাত কোটি মানুষের বধ্যভূমি! দেখ এ বাংলার
প্রতি গৃহে অপমৃত্যু ফেলে ছায়া তিক্ত হতাশার,
দুর্ভিক্ষের বার্তা আসে, আসে বার্তা নিরন্ধ্র রাত্রির।
বাষট্টি হাজার গ্রাম উৎকন্ঠিত, নিভৃত পল্লীর
প্রতি পথে ওঠে আজ হাহাকার তীব্র বুভূক্ষার
চোখে ভাসে চারদিকে অন্ধকার-কাল অন্ধকার;
ক্ষুধা, মৃত্যু ভাগ্য আজ স্তিমিত এ ভ্রান্ত জাতির!
এ মুহূর্তে কী উজ্জ্বল রাজধানী! নতুন শহর
অতুগ্র যৌবন মদে মত্তা যেন নটিনী-চঞ্চল,
কাটায় উল্লাসে তার জীবনের উদ্দাম প্রহর।
উপচিয়া পড়ে যায় পানপাত্র ফেনিল, উচ্ছল
নির্লজ্জের রঙ্গমঞ্চে অকল্পিত বিলাসের ঘর
দু’চোখ ধাঁধানো রূপে, নগ্ন মেকী ঐশ্বর্য্যে উজ্জ্বল।”
এই কবিতাটির মাধ্যমে কবি ফররুখ আহমদ দেশের সমকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির একটি উজ্জ্বল সময়চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। কবিতাটি লেখার কিছুদিন পরেই অর্থাৎ আষাঢ় : ১৩৮১; অক্টোবর ১৯৭৪ এই অমিত অনন্ত স্বপ্নের কবি, প্রভাতজাগা কবির অকাল মৃত্যু হয়। এই প্রথম ও শেষ দুটো লেখা বিশ্লেষণ করলে পরস্পর বিপরীত প্রাপ্তি থাকলেও আকাঙ্খা হারিয়ে যায়নি। এই সমকালীন অপ্রাপ্তির সুরের মাঝেই এক ধরণের স্বপ্নের প্রচ্ছন্ন আশাবোধ নিহিত থাকতে পারে। কারণ, যেখানে যাকিছু মন্দ, যা কিছু অসুন্দর, যাকিছু অনুপস্থিত তার উপর ভর করেই জাতি আবার জাগবে। যেখানে নীতির পরাজয়, যেখানে অসাম্য, যেখানে নিপীড়িতের হাহাকার, সেখানেই দ্রোহের জন্ম হয়, জাতি জেগেওঠার, একমন্ত্রে দীক্ষিত হবার শপথ নেয়। তাই কবি তাঁর শেষ লেখায় হতাশার কথা জানিয়ে গেলেন।
কবি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৬ বছর। জীবনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁর সৃষ্টির সময়কাল প্রায় চার দশক। কৈশোর কাল থেকেই কবিতা লেখায় মগ্ন হন কবি অর্থাৎ ইংরেজী ১৯৩৭ সালে প্রথম সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ করেন। ফররুখ আহমদের প্রায় চার দশকের সাহিত্যজীবনের এক দশকের কিছু বেশি সময় কলকাতায় এবং তিন দশকের কিছু কম সময় ঢাকায় অতিবাহিত হয়।
তাঁর কবিতা সময়ের ব্যবধানে আরও বেশি সুদৃঢ় ও সুবিন্যস্ত হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর আপন সৃষ্টিধারা বা স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিলেন। তৎকালীন কলকাতা ও ঢাকায় তাঁর বিশাল এক প্রভাবশালী সাহিত্যিক বন্ধুবলয় ছিল কিন্তু তাঁর স্বকীয়তায় ও আত্মবিশ্বাসে তাদের বৈশিষ্টের ধুলিসম স্পর্শও লাগেনি।
তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝি’তে যদি যাই:
“আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি
তবুও জাহাহ আজ ছোটাতেই হবে।”
কিংবা,
“হালে পানি নাই, পাল তার ওড়ে নাকো,
হে নাবিক! তুমি মিনতি আমার রাখো;
তুমি উঠে এসো মাঝি মাল্লার দলে
দেখবে তোমার কিশতি আবার ভেসেছে সাগর জলে।
নীল দরিয়ায় যেন সে পূর্ণ চাঁদ
মেঘ-তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙ্গে চলে সব বাঁধ।
তবে তুমি জাগো, কখন সকালে ঝরেছে হাসনাহেনা
এখনো তোমর ঘুম ভাঙলো না?
তবু তুমি জাগলে না?”
কবিতায় ‘ওঠাতেই হবে’, ‘জুড়তেই হবে’, ‘ছোটাতেই হবে’- এখানে তাঁর আত্মপ্রত্যয়ী, অমিত তেজ আর স্বপ্নের রূপায়নের দৃঢ়তা জাগ্রত। ‘ছেড়াপাল’ আর ভাঙ্গামাস্তুল’এ কোনো কোনো দু:স্বপ্ন নেই। ‘মেঘ-তরঙ্গ কেটে কেটে চলে ভেঙ্গে চলে সব বাঁধ।’ এখানেও বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে নেয়ার প্রত্যয় আছে, জাগরণের ডাক আছে। ‘এখনো তোমর ঘুম ভাঙলো না? তবু তুমি জাগলে না?’ এতেও কোনো হতাশা নেই বরং জাগাবার দৃঢ়তা আছে, গন্তব্য ছোঁয়ার স্বপ্ন আছে, স্ব-শক্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার আহব্বান আছে।
“হে মাঝি! এবার তুমিও পেয়ো না ভয়,
তুমিও কুড়াও হেরার পথিক-তারকার বিস্ময়,
ঝরুক এ ঝড়ে নারঙ্গী পাতা, তবু পাতা অগণন, ভিড় করে-যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজতোরণ।”
‘তুমিও পেয়ো না ভয়’- অভয়বাণীতে মনথেকে ভয়কে ক্ষয়করে জাগরণ প্রত্যাশী কবির প্রত্যয়ী আহব্বান।
আগেই বলেছি প্রভাতজাগা ডাক আর অনন্তের স্বপ্ন বিষয়ে গভীর বিশ্লেষণ করলে তাঁর কাব্যের একটি মূল সুর ও অনন্ত গন্তব্যের সুনির্দিষ্ট গতিধারা ও স্বাধীনতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। যে পরিচয়ে তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্নকে বারবার আমরা স্পূরণ ছড়াতে দেখি। তেমনি সিন্দাবাদ; বার দরিয়ায়; দরিয়ায় শেষ রাত্রি; ডাহুক; পাঞ্জেরী; স্বর্ণ ঈগল প্রভৃতি কবিতায় কবি ফররুখ প্রতীকের মধ্য দিয়ে, রূপকল্প বা উপমায়, চিত্রকল্পে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তাঁর চূড়ান্ত স্বপ্নের কথা, জাগরণের কথা গেয়ে গেছেন।
“ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ;
ছিড়ে ফেলে আজ আয়েশী রাতের মখমল অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও, হে মাঝি সিন্দাবাদ!”
অথবা:
“রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো উঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।”
এভাবে কবি রূপকল্প তৈরিকরে, উপমায় শব্দযোজনায়
ঘুমন্ত জাতিকে সংকটে উত্তরণের স্পৃহা জাগিয়ে গেছেন।
৪৭ শের দেশ-ভাগে কবি যতটা আশান্বিত ছিলেন, পাকিস্তান শাসনকালের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে ততটাই মর্মাহত করেছে। আশাভঙ্গে যে কতটা ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা তাঁর ‘আহব্বান’ কবিতার মধ্য দিয়ে তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে :
“আত্ম বঞ্চনার মাঠে অনুকারী দাসের জীবনে
সত্যের দিশারী কবি তোমার একান্ত প্রয়োজন।
আমরা পাইনি মুক্তি, শুনি নাই ঝড়ের স্পন্দন,
গোলামী জিঞ্জিরে তাই শোকাচ্ছ্বাস ওঠে প্রতিক্ষণে।
কতকাল মেনে নেবে মৌলিক প্রকাশ-হারা মন,
বন্দী রবে কতকাল দাসত্বের এ মৃত্যু-বন্ধনে।”
এখানে কবির স্বাধীন সত্ত্বার শিকলভাঙ্গার সুর আর দ্রোহ জাগাবার প্রয়াস লক্ষ্যকরা যায়।
১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার শ্রীরামপুর থানার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফররুখ আহমদ। ১৯৩৭ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে রিপন কলেজে ভর্তি হন। স্কুল জীবনেই সম্পর্ক স্থাপিত হয় কবি গোলাম মোস্তফা, কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল এবং কবি আবুল হাশিমের সাথে। বিখ্যাত সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় ছিলেন তার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের সহপাঠী। পরবরর্তীতে আহসান হাবীব, আবু রুশদ ও আবুল হোসেনের সঙ্গে মিত্রতা হয়।
রিপন কলেজে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, প্রমথনাথ বিশীর মতো প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের। ১৯৩৯ সালে সেখান থেকেই আইএ পাশ করেন। বন্ধু হিসেবে পান সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও ফতেহ লোহানীকে। স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন ও ইংরেজী সাহিত্যে বিএ ভর্তি হলেও অসমাপ্ত রেখেই নেমে পড়তে হয় কর্মজীবনে। ১৯৪৩ সালে কলকাতা আই.জি. প্রিজন অফিসে যোগদান করেন। একবছর পরেই সেখান থেকে সরে গিয়ে যোগ দেন সিভিল সাপ্লাই অফিসে। ১৯৪৫ সাল থেকে মোহাম্মদী পত্রিকাতে যোগ দেন। এই চাকরিতে ইস্তফা দিলে বেকার জীবনের শুরু।
দেশভাগের পর ঢাকায় রেডিও পাকিস্তানে যোগ দেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি তার ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে তার লেখা ছিল কঠোর। ১৯৬৬ সালে সিতারা-ই ইমতিয়াজ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও তার সমর্থন ছিল। ১৯৭৪ সালের ১৯শে অক্টোবর ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
রেনেসাঁর কবি, জাগরণের কবি, ইসলামী ঐতিহ্যের কবি, রোমান্টিক স্বপ্নবোধের কবি; যে যে-অভিধায় ডাকুক, তিনি এক শক্তিমান বাঙালি কবি। তিনি মাত্র ৫৬ বছরের জীবনে আমাদের সাহিত্যে, জাগরণে, স্বাধীনতাবোধে, আধুনিক ও আত্মপ্রত্যয়ী সমাজ নির্মাণে যে অমিত তেজ ছড়িয়ে গেছেন তা সূর্যের প্রখরতার মতো শাশ্বত। প্রভাববিস্তারকারি বহুকবিদের শক্তিময় বলয়বেষ্টনির মাঝেও পৃথকধারা তৈরিতে সফল একজন তিনি। যে ধারাকে অনায়াসেই আলাদাকরা যায়। পাঠকের মনোচিন্তনে যা সহজেই ধরা দেয়।