পেট্রোদাসী

495

কুয়াশাকাতর উষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আসমানের নীলিমায়। আজ তার কাছে ভোরের আসমান বর্ণময় রঙিন-বিষাদ চেতনার নীলে ছাওয়া। আলো-আঁধার লুকোচুরি খেলতে-খেলতে বাহিরবাড়ি এসে বসে পড়ে, কদমতলে সবুজ গালিচায়। উদাস চোখে সে তাকায় সবুজ বনভ‚মিতে। কানের ভেতর বেজে ওঠে নির্ঘুম বাঁশির সুর। আকাশের আঙিনায় উড়ছে অসহায় গাঙচিলটি। সবুজ বনভ‚মি থেকে নীল আসমানে উঁকি মারে পানসির দুটি চোখ। খাড়া হয়ে ওঠে কান দুটি। আরো গভীর হয়ে কানে বাজতে থাকে বাঁশির সুর। নিরাপদ আশ্রয়ের তৃষ্ণায় চোখ মেলে, তন্ন-তন্ন করে খুঁজে ফেরে গাংচিলটি। আসমানে ঠোঁট রেখে বলে, খড়কুটো বিছানো একটুখানি ঘর দাও, আমার নির্ঘুম রাতের অবসান করো। রোদে পোড়া মনটা জুড়িয়ে দাও, নির্জন ঘরের সুশীতল ছায়াতলে। আরো মায়াবী ও গভীর হয়ে ভেসে আসে বাঁশির সুর। পানসির দৃষ্টি আসমান থেকে প্রতিফলিত হয়, দক্ষিণের খোলা মাঠে। একি! বাঁশিওয়ালা আর কেউ নয়, তার স্বপ্নের মানুষ, গহর।
গহরের নির্ঘুম রাতের না-বলা কথাগুলো সুর হয়ে আছড়ে পড়ে পানসির হৃদয়গাঙে। দুটি হৃদয় যেন জড়াজড়ি করে বলছে, দিঘল রাতের না-বলা সমস্ত কথা, উষ্ণ সুন্দর সকালে। গুতু ফকির ফজরের নামাজ পড়ে এসে পানসির পাশে বসে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘মা রে, তোর মুখটা কেমুন শুকনা হইয়া গেছে। শরীরডা কাহিল। কাইল তো কিছু খাওয়া হয় নাই।’
পানসি বাপের মাথায় রেখে বলে, ‘বাজান, আমি ভালা আছি। জোয়ান মানুষ। এক দিন না খাইলে কী হয়? তুমি চিন্তা কইরো না।’
এ সময় জাগিরা উঠানে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘গুতুচাচা, ও গুতুচাচা, বাড়ি আছো?’
গুতু ওখান থেকেই জবাব দেয়, ‘কারা? এই দিকে আয়।’
‘চাচা, আমি।’ এক হাতে কলাপাতায় লবণ আর ফালি-ফালি করে কাটা আদা, আরেক হাতে এক কোষ্ঠা পাট।
‘চাচা, কাইল রাইতে সাপের বাতাস লাগছে। মাথা ঠিক রাখতে পারি না। ঘুইরা পইড়া যাই। বমিও হইছে কয়েকবার।’
গুতু পাটের কোষ্ঠায় ফুঁক দিয়ে গলায় পড়িয়ে দেয়। আদা ও লবণে ফুঁক দেয়। জাগিরার মাথাটা ধরে ঝাড়ফুঁক দিয়ে বলে, ‘লবণ-আদা যতটুকু পারো খাও। আর বাকিটুকু পরে খাইবা। যাও, ঠিক হইয়া যাইবো।’
দুধজান উদাস হয়ে বসে থাকে ছায়লাঘরে। হাতে শূন্য ভাতের হাঁড়ি। বেদনায় নড়ে ওঠে জাগিরার ভেতরটা। গুতুর সংসারে ঠিকমতো খাবার জোটে না, তা জাগিরার অজানা নয়। জাগিরার আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে-শাদিও করেনি। খুব সাদাসিদে সে। সবাই নানাভাবে তার সঙ্গে দুষ্টুমি করে। তার উপাধি পাগলা জাগির।
এতে সে খ্যাপে না কখনো। দুধজানের করুণ মুখটা শেলের মতো আঘাত হানে তার হৃদয়ে। জাগিরা চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। হাতে গামছার পুঁটুলি। ‘চাচি, ধরো, চাইল। ভাত পাক কইরা খাও। তোমার মুখ দেইখা বুঝছি। কাইল রাইতে খাওন হয় নাই।’
দুধজান জাগিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাজান, তোরে মানুষ পাগল কয়। তোর ভিতরে যে এত দরদ, এইডা কেউ জানে না।’ বন্যায় ভেসে যায় দুধজানের শুকনো চোখ দুটো।
‘চাচি, তুমি তো আমার মায়ের মুতন। আমার মা নাই। তুমিই আমার মা। তোমার কোনো সমস্যা হইলে নিজের পোলা মুনে কইরা কইবা।’
পাতা ঘর থেকে বের হয়ে বলে, ‘জাগিরাভাই, খোদা তোমায় ভালা করব। কাইল সারা দিন পরে রাইতে এক লুকমা ভাত খাইছি। অখন নড়াচড়া করতে পারি না।’ মাকে বলে, ‘মাথা ঘুরতাছে মাইয়া, তাড়াতাড়ি ভাত পাক করো।’
‘চাচি যাই। মনু মিয়ার বাড়ি যাইমু।’ বলে জাগিরা চলে যায়।
মনু মিয়ার ছোট্ট ছনের ঘর। একচিলতে ভিটে। এই ভিটেটুক ছাড়া আর কিছুই নেই তার। পরের জমিতে শ্রম বিক্রি করে। তবে সে জন্মের অলস। এক দিন কাজ করবে তো অন্যদিন করবে না। স্বভাবটা উড়–উড়–। খেয়ে-না-খেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় আর তাস খেলে দিন পার করে। তাই সংসারে অভাব-অনটন লেগেই আছে তার। একদিকে অভাব, অন্যদিকে সন্তান না হওয়ার কষ্ট। এর জন্য ঘরে এসে বউকে বকাঝকা করে। এমনকি মারধরও করে। এভাবেই কাটছে মনু মিয়া ও জয়তুনের সংসার। মনু মিয়া বলে, ‘জয়তুন, বিদেশি কুটুম রূপী আইবো। তোর আন্ডা পাড়া কালা কুরকাডা (মুরগি) জবাই কইরা পাক (রান্না) কর।’ জয়তুনের মুখটা কালো হয়ে যায়। তবু সে মুরগিটা ধরে। বলে, ‘জবাই কইরা দেন। কতগুনা আন্ডা বেইচা সদাই কিনা খাইছি। কুরকাডা লক্ষী আছাল।’
মনু মিয়া ভেংচি দিয়ে বলে, ‘রাখ তোর লক্ষী। তোর ঘরে তুই নিজেই তো পোড়াকপাইলা অলক্ষী। কুরকা লক্ষী হইলে তোর লাভ কী? লক্ষী কুরকা কি তোরে সন্তান দিব? নিজের মুরাদ হইল না একটা বাচ্চা দেওয়ার। আঁটকুড়া ম্যায়ালোকের মুখে আবার কথা।’
জাগিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনু মিয়ার কথা শোনে। জয়তুনের জন্য ভেতরটা কেঁপে ওঠে তার। মন খারাপ করে ফিরে আসে সে। মনু মিয়ার ঘরে প্রবেশ করতে তার রুচিতে বাধে। মানুষ এত জঘন্য হয় কী করে! জয়তুন মুরগি কাটছে। দুচোখে তার শ্রাবণের ধারা। মাঝেমধ্যে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছে, নাক মোছে আর মুরগি কাটে।
মনু মিয়া জয়তুনের গালে থুকনা মেরে বলে, ‘এই আটকুঁড়া অলক্ষী, কান্দন মারাও ক্যা? কাম কর। চোখের আলুনি (আহ্লাদি) পানি দেখার সুময় নাই আমার। পাক যান ভালা হয়। না হইলে খবর আছে।’
মনু মিয়া উঠানে পায়চারি করতে থাকে। জয়তুন ছায়লাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। মনের ভেতর তার ভয়। পাক ভালো না হলে তুলকালাম কান্ড ঘটাবে। হঠাৎ মনু মিয়ার হৃদয়ের ঘুঘুটা খুশিতে নেচে ওঠে। মনু ও জয়তুনের মধ্যে এতক্ষণ যেন কিছুই হয়নি, মনু এমনভাবে দরদ মাখানো গলায় বলে, ‘জয়তুন দেখো, কারা আইতাছে!’
জয়তুন ছায়লাঘর থেকে বের হয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। ‘আল্লা, ওডা কী? অমুন ক্যান? গায়ে পোলাগো গেঞ্জি আর পিন্দিছেও পোলাগো ফুলপ্যান্ট।’
‘আরে, তুই কী বুঝবি? হে তো বিদেশি মেম। বিদেশে ম্যায়ারা অমন পোশাক পিন্দে।’ দুজনের আলাপচারিতার মধ্যে রূপী এসে হাজির হয়।
‘কি মনুভাইয়া, খুব রোমান্টিক গল্প হচ্ছে বুঝি?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই, প্রশ্ন করে, ‘এটা ভাবি?’
‘হ, আমার বউ, জয়তুন।’
‘বাহ্, নামটা বেশ সুন্দর। ভাবি দেখতেও কিন্তু চমৎকার।’
জয়তুন লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে দেয়। মনু বলে, ‘বসেন, মেম সাহেব।’
রূপী টুলের ওপর বসে। জয়তুন খাবার তৈরি করতে করতে রূপীর বেশভ‚ষা দেখে আর ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়।
রূপী বলে, ‘মনুভাইয়া, আমাকে তুমি সন্বোধন করবেন। আপনে বললে, পরপর লাগে।’
মনুর পালটা প্রশ্ন, ‘আমার বেলায়ও তাই।’
মুচকি হেসে রূপী বলে, ‘ঠিক আছে। তা-ই হবে।’
‘রূপী, আমার বিদেশ যাওয়ার খুব শখ। তুমি যেভাবেই পারো আমার জুন্যে চেষ্টা করো।’
‘মনুভাইয়া, শোনো। এখন পুরুষদের বিদেশ যেতে লাগে ২ লক্ষ টাকা। আর বেতন ৮-১০ হাজার টাকা। তার মধ্যে নিজের থাকা-খাওয়া। শেষে দেখা যাবে মাস শেষে ৫-৬ হাজার টাকা থাকবে। তবে ভালো কাজ শিখে যেতে পারলে ভালো বেতনে চাকরি পাবে। তুমি ড্রাইভিং শেখো। আমি তোমার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা করব।’
একটু থেমে রূপী আবার বলে, ‘মনুভাইয়া, তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকে মনে হয় কত আপন। কত যুগের পরিচিত আমরা। তোমার চেহারাটাও আকর্ষণীয়!’ মনুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘তোমার হাত দুটো কত সুন্দর!’ মনু মিয়ার চোখ-মুখ ঝিলমিলিয়ে ওঠে রংধনুর সাত রঙে। মনুর কাছে এটা বিশাল স্বপ্ন। রূপীর মতো মেয়ে তাকে এত…!
জয়তুন খাবার নিয়ে আসে।
‘ভাবি, এত লাজুক কেন? বসুন। একসাথে খাব।’
জয়তুন জড়সড়ো হয়ে বলে, ‘আপনে খান। আমি পরে খাইমু।’
‘ভাবি, আপনাকে বসতেই হবে। খাব আর বিদেশের গল্প করব।’
মনু মিয়াও ভদ্রলোকের মতো সুন্দর করে বলে, ‘জয়তুন বসো। বিদেশি কুটুম তোমারে পছন্দ করছে। এইটা তোমার জুন্যে সৌভাগ্য।’
রূপী শুরু করে বিদেশের গল্প। ‘ভাবি, আমাদের দেশ বড়ো বড়ো গাছপালা ঘেরা সবুজ। কিন্তু আরবে তেমন বড়ো গাছ নেই। কোনো-কোনো জায়গায় ছোটো-ছোটো কাঁটাবন। বালি আর পাথর দিয়ে ঘেরা রুক্ষ ভূমি। আকাশ ধূসর বর্ণের। ধূসর আকাশের তলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষহীন উলঙ্গ ভূমি। অথচ ওই রুক্ষ মরু দেশ, স্বর্গের দেশ। কী আরামে সেখানে থাকা যায়। গরমের দিনে সব সময় ঠান্ডা থাকে এসির কারণে। আর শীতের দিনে গরম থাকে, রুমহিটারের কারণে। ভাবি, আপনি কষ্ট করে পাটায় মসলা পিষলেন, চুলায় খড়ি দিয়ে ভাত রান্না করলেন, চোখমুখে ধোঁয়া লাগিয়ে এই পাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছেন। এগুলি সব কাজ সেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়।’

গল্প শুনতে শুনতে জয়তুনের জড়তা কমে আসে। প্রশ্ন করে, ‘বুজি, তাইলে তো বিদেশ আরামের জীবন।’
‘ভাবি, ঠিক বলেছেন। বিদেশ তো স্বর্গরাজ্য। তিন মাসের ছুটিতে এসেছি। এক মাস হয়ে গেল। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। কী গরম!’
‘বুজি, একটা কথা জিগাই?’
‘বলেন, ভাবি।’
‘আপনের বিয়া হয় নাই?’
‘না ভাবি। দেশে আসার পর বিয়ের জন্যে সবাই পাগল হয়ে গেছে। অনেকগুলি বিয়ের প্রস্তাবও এসেছে। কিন্তু আমার পছন্দ হয়নি।’ মনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলে, ‘একজনকে মনের ভিতর পুরেছি। দেখা যাক কী হয়।’
‘বুজি, আপনে তো বিদেশি মেম হইছেন। তাই তো দেশের পোলা পছন্দ হওয়ার কথা না। তয় বিদেশের পোলা একটা ধইরা নিয়া আসলেই হইতো।’ রূপী খিলখিল করে হেসে ওঠে। ‘ভাবি, আপনি তো বেশ মজার। ভাবি, চলেন, আপনাকে বিদেশ নিয়ে যাই।’
‘বুজি, কী যে কেন! আমার মুতন পোড়াকপাইলা অলক্ষীরে বিদেশে নিবো, কারা?’ ‘আমি নিয়ে যাব। কে বলেছে আপনি পোড়াকপাইলা, আপনি তো রাজকপালী।’
‘বুজি, আমি বিদেশে কী করমু? আমি তো লেখাপড়া জানি না।’
‘কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বাসাবাড়িতে চাকরি করবেন। আমি শিখিয়ে দেব তাহলেই পারবেন।’ ‘বুজি, আপনের মাথা কি ঠিক আছে? সংসারের কামকাজ করলেই আমারে টাহা দিব?’
‘ভাবি, বিদেশ হলো স্বপ্নরাজ্য। ওই দেশে গেলে সব স্বপ্ন পূরণ হবে। বিদেশে সংসারের কাজের অনেক দাম। আমাদের দেশে সংসারের কাজ কোনো কাজই না।’
মনুকে লক্ষ্য করে রূপী বলে, ‘মনুভাইয়া, তোমার বউকে বিদেশ পাঠাবে? ভাবি বিদেশ থেকে টাকা পাঠাবে। সেই টাকা দিয়ে ড্রাইভিং শিখে তুমিও চলে আসবে।’ রূপী কথাগুলি বলে আর মিটিমিটি রহস্যময় হাসি দিয়ে মনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রূপীর চোখের রহস্যময় তির্যক রশ্মিতে মনুর হৃদয়ে সুনামি বয়ে যায়। সুনামির আঘাতে মনুর শিরা-উপশিরা পর্যন্ত নড়ে ওঠে। তার পরান জুড়ে বিচরণ করে রূপীর ঘ্রাণ। সেটা লক্ষ করে রূপীর কঠিন বাঁকা ঠোঁটে বিজয়ের হাসি ফুটে ওঠে। একটু আহ্লাদের সুরে জয়তুনের চিবুক ধরে সে বলে, ‘ভাবি, সোনা ভাবি, আসি। কথা দিলাম তোমাকে বিদেশ নিয়ে যাবই যাব। ভাইয়া, যাই।’ মনু ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভেতরে এখন বইছে উথাল-পাথাল ঢেউ। জয়তুনের মনের যত কথা পানসি ও দুধজানের কাছে প্রকাশ করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। না বলতে পারলে পেটের ভাত হজম হয় না তার। তাই তো রূপীর কথা বলার জন্য সে পাগল হয়ে ওঠে। বিদেশি মেম বলে কথা। সেই মেম স্বয়ং তার বাড়ি এসেছে। এটা আশ্চর্য ঘটনা। এটা বলার জন্য মন তার আনচান করছে। তাই ফাঁক খুঁজে দুধজানের কাছে যাওয়া।
দুধজান রান্না করছিল। মুখটা উচ্ছিষ্ট হাঁড়ির মতো রুক্ষ বিষন্ন। তার ভেতরে ভাবনা, জাগিরা তাকে ঋণী করে গেল। এ ঋণ শোধ দেবে কীভাবে? সামনের দিনগুলোই-বা চলবে কেমন করে? অনাহারী বিধ্বস্ত করুণ তিনটি মুখ মায়াবী চোখে চেয়ে আছে দুধজানের দিকে। মনে হচ্ছে তার কাঁধে বোঝা হয়ে আছে তিনজন। এ বোঝা কাঁধে নিয়ে যেতে হবে কত হাজার মাইল! তা সে জানে না।
গুতু ফকির হাঁড়িতে ভাত দেখে অবাক হয়। ‘কি গো বড়ো গেদির মাও, ঘটনা কী? চাইল পাইলা কই?’
দুধজান চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দেয়, ‘আমার পেটে খোদা পোলা দেয় নাই। কিন্তু খোদা তার আরশ থিকা একটা পোলা পাঠাইছে। হেই পোলা অনাহারী মায়ের মুখে খাবার দিয়া গেছে। খাও আর আমার পোলার জুন্যে দোয়া করো।’
পাতা পট করে বলে ওঠে, ‘বাজান, জাগিরাভাই চাইল দিয়া গেছে।’
গুতু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে খেতে বসে, খাওয়া শেষ করে বলে, ‘বড়ো গেদির মাও, পান দেও।’ দুধজান পান বানিয়ে গুতুর হাতে দেয়। গুতু পান খেতে-খেতে বলে, একটা কথা শুনো।’
‘বলো।’
‘বইলামপুরের কাশির নাম শুনছ?’
‘শুনমু না কেন? কাশি যে চোর, তা তো সবাই জানে। হে নাকি বিড়াল হইয়া ঘরে ঢুইকা চুরি করতো। আমাগো ঘরের পাছ দিয়াই তো কালিহাতী যাতায়াত করছে, কালা কুচকুচে শুকনা ছোটোখাটো মানুষটা।’
‘দুই বছর হইল কাশি চোর মরছে। তার একটা পোলা আছে। নাম জইনদালি। সবাই ডাকে জইন। ঝারমুনির গয়না বানাইয়া বেচে। দস্তা দিয়ে বিভিন্ন রকমের গয়না তৈরি করা হয়, গ্রামের মানুষ বলে ঝারমুনির গয়না। আমিও জইনের কাছ থিকা ঝারমুনির গয়না আইনা গাওয়াল করি। ধলাবুড়ি প্রস্তাবডা দিচ্ছে। বড়ো গেদির সাথে মানাইবো ভালা। বড়ো গেদির মাও, কথাডা ভাইবা দেখো।’
‘ভাবার কী আছে, একে তো চোরের পোলা। আবার জাতে মিশিগারি!’
বইলামপুর গ্রামে মিশিগারি নামে এক শ্রেণির ছোটো জাতের বাস। এদের পেশা ঝারমুনির গয়না তৈরি করা এবং গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ধান-চালের বিনিময়ে বিক্রি করা। এরা খুব দরিদ্র। কারো ঘরে দিনান্তে খাবার জোটে। কারো জোটে না। গ্রামের অন্য জাতের লোকেরা এদের ঘৃণার চোখে দেখে। তাই তো দুধজানও বিষয়টা মেনে নিতে চাইছে না।
‘বড়ো গেদির মাও, তোমার কথা ঠিক। তয় জইন খুব ভালা। কোনো এলেমেলে নাই। কাম করে ভাত খায়। আর জাতের কথা কস, আমাগো মতো গরিব মানুষের আবার জাত কী? এখানে ম্যায়াডা পেট ভইরা ভাত পাইবো।’
‘বড়ো গেদির বাপ, ঠিকই কইছেন, গরিবের আবার জাত! আপনে তো তালুকদার বংশের পোলা। সেই তালুকদারের পোলার দিন কাটে আনাহারে! আপনি দেখেন। তারপর বুইঝা-শুইনা ঠিক করেন, কী করবেন। ম্যায়াগুনা না খাইয়া আর কত থাকব? আর কিছু দেখার নাই। পেট ভইরা ভাত খাইতে পারলেই যথেষ্ট। চোখের সামনে আর সহ্য হয় না। পরেরগুনাও চোখের সামনে ডাঙর হইয়া উঠতাছে। বড়্ডা বিদায় করতে পারলে মাথাডা একটু পাতলা আইবো।’
‘আমাগো ঘরের পাছে হালট দিয়া যাওনের সময় বড়ো গেদিরে দেখছে। জইনের পছন্দও হইছে।’ উচ্ছ¡াসের সঙ্গে বলে গুতু।
‘খোঁজখবর নেন। পাওনাদাওনা কী? আমাগো তো কিছু দেওয়ার খ্যামতা নাই।’
‘বড়ো গেদির মাও, আরেক খিলি পান দেও।’ গুতু পান মুখে দিতে দিতে বলে, ‘ধলাবুড়ির কাছে যাই। কথা কইয়া দেখি।’

পানসির পেটের ক্ষুধার রাক্ষসটা এখন নীরব। মুখটাও সবুজে মাখামাখি। আয়নায় নেড়েচেড়ে দেখে। মুখটা যেন রোদে পোড়া বাঁশিওয়ালার জন্য আকুল। সবুজ মুখটির স্বপ্নিল আভা, এক টুকরো ছায়াসুশীতল আদরের অপেক্ষায় উন্মুখ। সেই ভরা কণ্ঠের মানুষটি যেন বলছে, দরজা-জানালা খোলা। তুমি নির্জন ছায়াতলে আসো। শীতল পবনের তলে চুল ছড়িয়ে বসো। সেই মেঘের কালো পাড়ের ভেতর আঙুল চালিয়ে আদর মাখাব। গল্পে-গল্পে দিন পার করব।
পানসি যার ধ্যানে আয়নার মগ্ন, সেই স্বপ্ন চোখের সামনে। অন্তরে শুরু হয় কালবৈশাখীর দাপাদাপি। হৃদয়ের ঘোর অবসাদে শরীরটা যেন নুয়ে আসছে তার। অন্তরের অবরুদ্ধ দ্বার দাপাদাপি করছে মুক্ত হওয়ার জন্য। মুক্ত দ্বার বেয়ে আশ্রয় নেবে সুশীতল ছাড়ানীড়ে।
গহরের হাতে আমের আঁটির বাঁশি। গায়ে সাদা গেঞ্জি, পরনে সবুজ লুঙ্গি, লাল চেক গামছাটা কাঁধে, মাথায় মাথাল। গামছায় বাঁধা মুড়ি। আঙুলের চিপায় বিড়ি। চোখ দুটো বেশ সুন্দর গোটা গোটা! নাকটা চওড়া, শ্যামল বর্ণটা রোদে পুড়ে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। বেশ লম্বা-চওড়া। স্বপ্নের পুরুষটি যেন পানসির মনের মতো করে বিধাতা গড়েছে। ‘পানসি, একটু আগুনের জুন্যে আইছি।’ পানসি দৌড়ে মাটির হাতায় আগুনের ছাই এনে গহরের হাতে দেয়। পানসির ভেতরে লজ্জা ভয়-জড়তা। কিন্তু সারা মুখে ঝিলমিল খুশির আভা। গহর বিড়িতে টান দেয় আর পানসির দিকে তাকায় মায়ভরা চোখে। পানসির মুখটা মাটির দিকে। ‘এক গিলাস পানি দিবা?’
পানসি কুয়া থেকে ঠান্ডা পানি তোলে, ঘটি ভরে গহরের সামনে রাখে। গহর কাঁঠালতলে ছায়ায় বসে মুড়ি খায়। পানি খেয়ে বলে, ‘আর খাইমু না। তোমার আঁচল পাতো।’ পানসি লজ্জায় মোচড় দেয়। মুখে কথা নেই। আঁচল পাতে না, গহর নিজেই আঁচল ধরে মুড়ি ঢেলে দেয়, তারপর আমের আঁটির বাঁশিতে মায়াবী সুর তুলতে তুলতে চলে যায়। পানসি ওর গমনপথের দিকে চোরা চোখে তাকায়। ওর চোরা চাহনিতে যেন আসমানের দেহ থেকে নীলিমা ঝরে পড়ছে। ওর রাঙা ঠোঁট দুটো একা একাই ভালোবাসার কথা বলছে, চোখের কোণে নিঃশব্দ দেওয়াল ভেঙে আঁকছে স্বপ্নের ছবি। মৌনতার জালে বুনছে। কত গল্প, কত স্বপ্ন গাঁথা।
জয়তুনের ডাকে ধ্যান ভাঙে পানসির। বেশ আগ্রহ নিয়ে পানসি প্রশ্ন করে জয়তুনকে। ‘ভাবি, বিদেশি মেম তোমার বাড়ি আইছল?’
‘হু রে। হেই কথা কইবার জন্য মন আনচান করতাছে। চাচি আম্মা কই?’ পানসি ঘরের দিকে দেখিয়ে দেয়। দুধজানের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয় জয়তুন। পাশে পানসিও শ্রোতা।

হৃদয়তট তছনছ করে গেছে যে সুনামি, সেই সুনামির স্বপ্ন দেখতে দেখতে দিন যায় মনুর। মনুর চোখে দুটো স্বপ্ন। রূপী আর স্বপ্নের দেশ। এখন খুব একটা বাইরে যায় না সে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় শরিক হয় না। বেশিরভাগ সময় পার করে ঘরে শুয়ে শুয়ে, আর স্বপ্ন দেখে। বেশ কয়েক দিন কেটে যায় এভাবে।
মনুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। নতুন শার্ট আর পরিষ্কার লুঙ্গি পরে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে আর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায়। জয়তুন পানসির বাড়ি থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই অবাক হয়। ‘কি গো সাইজা-গুইজা যাও কই? তাও আইজ শনিবার। শনিবারে যাত্রা ভালা না।’ গরমে শরীর ঘেমে ওঠে জয়তুনের। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলে জয়তুন।
‘জাহান্নামে যাই। তোর কাছে কৈফিয়ত দিতে অইবো!’
জয়তুন চুপ হয়ে যায়। এমনিতেই মনুকে সে ভয় পায়। তার ওপর কয়েক দিন যাবৎ সে বাইরে বের হয় না। ঘরে শুয়ে শুয়ে কী যেন ভাবে। জয়তুনের সঙ্গে কোনো কথাও বলে না। তারপর মনকে প্রবোধ দিতে পারে না। কী এক অজানা আশঙ্কায় আর্তনাদ করে ওঠে। তাই ভয়ে-ভয়ে আবার বলে, ‘শনিবাইরা দিনডা ভালা না। তাই কইছিলাম, আমার কাছে একটু কওন যায় না?’
মনুর অন্তরের কোথায় যেন জয়তুনের জন্য একটু কোমল ছায়া নড়ে ওঠে। নরম স্বরে বলে, ‘রোজগার না করলে তো সংসার চলব না। কুহপডরা যাইমু। রূপী বিয়াইন দেখা করতে কইছে। দেখি কী করা যায়? তুই ভালা থাকিস। আমার জুন্যে ভাবিস না।’

গুতু ফকির পান চিবাতে চিবাতে ধলাবুড়ির বাড়ি হাজির হয়। উঠানের কোণে বসে পাটের শিকা বুনছে ফটিকের মা। তার পাশেই অতীতের গল্পে মশগুল ধলাবুড়ি। অতীতের গল্প বলা তার প্রধান কাজ। সুযোগ পেলেই গল্পের ডালা খুলে বসে। গল্প শুনে সবাই সেসব নিয়ে ধলাবুড়ির সঙ্গে খুনশুটি করে। গুতু উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ডাকে, ‘ধলাচাচি, ধলাচাচি, এইদিকে আসো। তোমার সাথে কথা আছে।’
ধলাবুড়ি লাঠি ধরে ঠকঠক করে এগিয়ে এসে বলে, ‘গ্যাদা, ঘরে চলো। তারবাদে তোমার সাথে কথা কই।’
ধলাবুড়ি পিঁড়িটা এগিয়ে দেয়। গুতু ফকির পিঁড়িতে বসতে বসতে বলে, ‘চাচি, বড়ো গোদির মায়ের সাথে আলাপ করলাম।’
ধলাবুড়ি পান বানাতে বানাতে বলে, ‘গ্যাদা, জইন পোলাডা ভালা। কেমুন ডাকখোঁজা। হালটা দিয়ে যাওনর সুময় আমার সাথে দেখা করবই। জাতে মিশিগারিÑ এটুকু দোষ। তা ছাড়া আর কোনো দোষ নাই। খাওন-পিন্দনের অভাব অইবো না।’ পানের খিলিটা গুতুর হাতে দিতে দিতে বলে ধলাবুড়ি।
গুতু পানের খিলিটা মেলে ধরে বলে, ‘চাচি, আরেকটু গুয়াপাতা (তামাকপাতা) দেও।’ বুড়ি তামাকপাতা ছিঁড়ে দেয়। গুতু আয়েশ করে পান চিবায় আর কথা বলে। ‘চাচি আমার অবস্থা কী, তা তো জানো। কিছু দেওনের ক্ষমতা নাই। শরীরডা যদি পাইড়া যায়, তাইলে ভিক্ষা ছাড়া উপায় নাই,’ বলে গুতু ফকির।
‘গ্যাদা, আমি তো জানি। জইনরে সবকিছু খুইলা কইছি, হে কইছে, দেওন-থুয়ন নিয়া বাজব না। গ্যাদা, তুমি একটা তারিখ দেও। হেইদিন ময়মুরুব্বিরা থাকব। কথাবার্তাও পাকা অইবো।’
‘চাচি, আগামী শুক্করবার জুমার নামাজ বাদে। তাখিটা জানাইবা। তারা কয়জন আইব হেই খবরডাও আমারে জানাইবা। বেশি মানুষ আসলে তো আমি পারমু না।’
‘তুমি চিন্তা কইরো না। তোমার খবর আমার চাইয়া তো কেউ বেশি জানে না। জইন ভালা পোলা। আমি বুঝাইয়া কইমু। হেও তোমার খবর জানে। আইজ বৈকালেই খবর পাইবা।’
গুতু বাড়ি ফিরে দুধজানকে বিস্তারিত জানায়। দুধজান মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘ঘরে নাই খাবার। এখন কী করবেন? আমি তো চোখে অন্ধাইর দেখতাছি!’
গুতু বাড়ি থেকে বের হতে হতে বলে, ‘দেকি কী করন যায়? খোদার উপর ভরসা কইরা বাইর হইতাছি।’ গুতু পথ দিয়ে হাঁটে আর ভাবে, কী করা যায়। ভাবতে ভাবতে একসময় গেটু মাতবরের বাড়ি এসে হাজির হয়।
গেটু হরিপুর গ্রামের মাতবর। এ গাঁয়ে তার কাথার ওপর কথা বলার সাহস কারো নেই। কারণ গ্রাম্য পলিটিকসের প্রধান নায়ক সে। গুতু ফকির মুখটা কাঁচুমাচু করে মাতবরের সামনে দাঁড়ায়। ‘চাচা, একটা বিষয়ে কথা কইতে আইলাম আপনের কাছে।’
‘বাজান, কী কথা গো? কও।’
‘চাচা, আগামী শুক্করবার আমাগো বড়ো গেদিরে দেখতে আইবো। বৈলামপুরের কাশির পোলা জইনদালি। আমার খবর তো জানেন। ঘরে নাই খাবার। আমি মহা চিন্তায় পইড়া গেছি। চাচা, আমারে পরামর্শ দেন কী করমু? আপনে ছাড়া আর আমার আপন কেউ নাই।’
‘বাজান, এক কাম করো। আইজ রাইতে আসো। দেখি কী করন যায়!’
গুতু ফকিরকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে একদল ছেলেমেয়ে উল্লাস করতে থাকে আর সুর করে বলতে থাকে-
‘আয় আয়-বুলু-বুল-বুল।
ঘুমায় না ঘুমায় না। ঘুমায় না।
গুতুদাদার ঝোলায় কুল-কুল-কুল \
গুতু এসব শুনে অভ্যস্ত। কাজল, আলতা, চুরি, ফিতা বিক্রি করে বাচ্চাদের আকৃষ্ট করার জন্য সে চোখে কাজল দেয়। আর ছড়াটি সুর করে আবৃত্তি করে।
কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো হঠাৎ গুতু ফকিরকে নিয়ে ছড়া বলা বন্ধ করে দেয়। তারা গাঁয়ের মেয়ে আমেনাকে দেখে তার পেছনে লাগে। হইহই করে বলতে থাকে-
‘এক কলমে দুই ননার পানি
আমিনা তুমি স্বীকার করো
গেটু তোমার স্বামী।’
আমিনা বকা দেয় আর ওদের ধাওয়া করে। দুষ্টু ছেলের দলও দৌড়াতে থাকে আর ব্যঙ্গ করে ছড়া কাটতে থাকে। গুতু ফকির আমেনাকে থামায়। তার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘দিদি, খ্যাপো ক্যা? তুমি খ্যাপো, তাই ওরা মজা পায়। তুমি যদি না খ্যাপো ওরা আর কইবো না।’
‘দাদা, তুমি তো শুনলা। ওরা কী পচা কথা কয়।’ আমেনার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে।
‘দিদি, বাড়ি যাও। কাইন্দো না।’
দুষ্টুর দল আবার ছড়া বদল করে করে বলতে থাকে-
‘ওই ছেড়িরে ধর, ঘটির মধ্যে ভর
ঘটি গেল ভাইঙা, ছেড়ি গেল কাইন্দা।’
আমেনা এবার জোরে কাঁদতে থাকে আর বকাবকি করতে থাকে। গুতু আমেনাকে আগলে ধরে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘যা দিদি, বাড়ি যা।’

গুতুর বাড়িতে নতুন অতিথির আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত সবাই। গুতু এক বস্তা চাল এনে ঘরে রাখে। দুধজান চমকে যায়। বলে, ‘এত চাইল? ট্যাহা পাইলান কই?’
‘কাইল রাইতে গেটু মাতবরের বাড়ি গেলাম না? তখন মাতবর চাচা, পংকু, গেদু ও ফটুরে কইল, আমারে যান সাহায্য করে। আইজ গেছিলাম। সবাই সাহায্য করল। যে যা পারছে, কেউ ট্যাহা দিছে, কেউ দিছে চাইল। যাউক, দেখাদেখির দাবার পার করতে পারমু।’
‘এই ধাক্কা না হয় সামাল দিলেন। তার বাদে কী অইবো?’ জানতে চায় দুধজান।
‘পরের কথা পরে। খোদা একটা ব্যবস্থা করবই। কোনো উপায় না হইলে সুদে ট্যাহা পাওন যায়। বাদ দে পরেরডা নিয়া এখন ভাবিস না। পান দে।’

পানসির কোলে একটা ছাগলছানা। সামনে উন্মুক্ত দক্ষিণের সবুজ মাঠ। পুতি কোথা থেকে এসে পানসির গলা জড়িয়ে বলে, ‘বড়ো বু, তোরে দেখতে আইবো। যে দুলাভাই আইবো, হে তোরে পছন্দ করছে। শুক্কুরবার মুরব্বিরা আইবো। হেগো পছন্দ হইলে ঐদিনই বিয়া। বড়ো বু, তোর বিয়ার মধ্যে কী যে মজা করমু!’
পানসির কলজের মধ্যে চিড়িক দিয়ে ওঠে। বেদনার নীলে ছেয়ে যায় সমস্ত মুখ। তার অন্তরে লুকানো সুন্দর দ্বীপটা বিষণœতায় ঢাকা পড়ে যায়। বুকের মধ্যে ঠাঁই নিয়েছে যে মনপোড়া দেবতা, তাকে কোন রঙের তুলি দিয়ে মুছবে সে?
‘বড়ো বু, তুমি এমন বেজার ক্যা?’ এরই মধ্যে পাতা এসে হাজির হয়। পুতি বলে, ‘বড়ো বু, বাড়িডা কেমুন খুশি খুশি লাগতাছে। পাতা দেখ, বড়ো বু মুখটা কেমুন প্যাঁচার মুতন কইরা রাখছে।’
পানসি নির্লিপ্ত। নোনা পানিতে চোখ দুটো টলমল করছে তার। পুতি বলে, ‘বড়ো বু শরম পাইছে। পাতা, আয় চইলা যাই। বড়ো বু, তুমি দুলাভাইরে নিয়া খোয়াব দেখো।’ সত্যি, পুতি ও পাতার কথায় পানসির স্বপ্ন ভাঙতে হানা দেয় অসুর। তার ভেতরের সুন্দর স্বপ্নটি ভাঙন ধরে।

মনু মিয়া কুহপডরায় রূপির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। রূপী মাচানের ওপর বসে ছিল। উদাস দুপুরের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় উড়ছে তার কুঞ্চিত কেশ। মনু পেছনে থেকে ছাতা দিয়ে রূপির ঘাড়ে আলতো খোঁচা দেয়। রূপী পেছনে ফিরে অবাক হয়! ‘আরে তুমি? তোমাকেই ভাবছিলাম। আশ্চর্য! ভাবনাটা এভাবে বাস্তব হবে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’
মনুর হৃদয়গাঙে ভালোবাসার দাপাদাপি শুরু হয়। সাপের নীলচে বিষের ছোবল খেয়ে যেন নিষিদ্ধ গন্ধমের আকর্ষণে দাউদাউ জ্বলে ওঠে সে। মনুর হাত ধরে রূপী হ্যান্ডশেক করতেই সে যেন কেমন করে ওঠে। মনু স্তব্ধ! রূপী মুচকি হেসে বলে, ‘এই কী ভাবছ? বসো, পানি নিয়ে আসি।’ মনু মনে মনে ভাবে, রূপীর শরীরও কি থরো থরো কাঁপছে। নিষিদ্ধ তৃষ্ণার তার সারা অঙ্গ হাহাকার করে ওঠে।
‘মেমসাব, তৃষ্ণা কি পানিতে মিটবো?’
রূপী প্রহসনের কৃত্রিম হাসি হেসে বলে, ‘ইস! তাই বুঝি? আপাতত শরবত খাও। তোমাকে গাঙের গভীর জলের কাছে নিয়ে যাব। সেই গহিন জলে দুজনে ডুবসাঁতার খেলব। দেখবে সমস্ত তৃষ্ণা মিটে গেছে সুখসায়রে, শুধু ভাসবে আর ভাসবে।’
রূপীর কথাগুলি মনুর হৃদয় রাঙিয়ে দেয় কৃষ্ণচ‚ড়ার রঙে। দুজনের মধ্যে কত কথা, হাসিঠাট্টা চলে অনেকক্ষণ। রূপী মনুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘মনু, তোমাকে হৃদয় গহিনে ঠাঁই দিয়েছি। তুমি আমার ভালোবাসার সবুজ ভ‚মি। তোমার ভালোবাসার ছোঁয়ার বুকের তিমির ঠেলে গড়ে উঠেছে স্বপ্নের দ্বীপ।’
মনু মনে মনে ভাবে, সেই ভালোবাসার সুখদ্বীপে বসে দুজনে স্বর্ণলতার মতো গায়ে প্যাঁচাব হৃদয়ের কথামালা আর রঙিন স্বপ্ন দেখব।
‘মনু একটা কথা বলি। শুনবে?’
‘রূপী, কী যে কও, তুমি কথা বলবা আর আমি শুনমু না? এইটা ভাবলা কী কইরা? তাড়াতাড়ি কও, তর সইতাছে না।’
‘মনু, একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে খেয়ে-না-খেয়ে বাস করো তুমি, তোমার কষ্ট আমার বুকেও যন্ত্রণা দেয়। আমি চাই, তোমার ভিটায় দালান উঠুক। তোমার জীবন সুখের হোক, তোমার বউকে আমার সাথে বিদেশ পাঠাও, সে চাকরি করে টাকা পাঠাবে। সেই টাকা দিয়ে তুমি ড্রাইভিং শিখবে। পরে সুযোগমতো তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। তুমি আমার কাছে গেলে খুশি হবে না?’
‘রূপী, কী যে কও? এইটা তো খোয়াব, হেই খোয়াব তুমি পুরা করবা? আমার তো নাচতে ইচ্ছা করতাছে।’ মুখের সজল হাসিটি হঠাৎ স্তিমিত হয়ে আসে মনুর। সমস্ত মুখমÐলে পতিত হয় মেঘের কালো ছায়া। ‘রূপী, জয়তুনেরে বিদেশ পাঠাইতে ট্যাহা লাগবো না?’
‘হ্যাঁ। টাকা ছাড়া কি বিদেশ যাওয়া যাবে।’
‘খোয়াব দেখাও রূপী?’
মনুর মাথায় হাত দিয়ে রূপী মুচকি হেসে বলে, ‘আরে, মাথা ঠান্ডা করো। জয়তুনকে নিতে এক লক্ষ টাকা লাগবে। তুমি শুধু বিমানভাড়াটা জোগাড় করবে। বাকি টাকা আমি দেব। বিমানভাড়াটা তোমার থেকে নিতাম না। যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম তা খরচ হয়ে গেছে। তাই তো তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে, সোনা। আমার পরিচিত মালিকের বাসায় চাকরি দেব। বেতন ১০ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া ফ্রি। পুরো টাকাটাই দেশে পাঠাতে পারবে।’
‘বিমান ভাড়া কত?’
‘৫০ হাজার টাকা দিলেই হবে। বাকিটা যেভাবেই হোক আমি ম্যানেজ করব। এইটুকু পারবে না? কত লোক টাকা নিয়ে আমার পিছে পিছে ঘুরছে। তোমার সাথে তো সবার তুলনা হয় না। তুমি তো আমার পরানপাখি। শুধু তোমার জন্য এই সুযোগ, এখন তুমি যদি হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলে দাও, তাহলে আমার কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।’
হতাশ কণ্ঠে মনু বলে, ‘রূপী, বাড়ি যাই। দেখি কী করন যায়?’
‘মনু, মনোবল শক্ত করে চেষ্টা করো, হয়ে যাবে। এদিক-সেদিক থেকে ধার নিতে পারো। জয়তুন বিদেশ গেলেই তো টাকা পাঠাবে। তখন ধারদেনা শোধ করে দেবে।’
মনু নিজের ঘরে এসে ঢোকে। মনটা তার ভার। জয়তুন সেদিকে তোয়াক্কা না করে, উচ্ছ¡াসভরা কণ্ঠে জানায় যে পানসির বিয়ে হয়ে গেছে। এ কথা শুনে মনুর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। এবার জয়তুন খেয়াল করে, মনুর মনটা খারাপ। জয়তুন ভয়ে চুপসে যায়। কিছু জানতে চাওয়ার সাহস জয়তুনের নেই। এমনও হতে পারে, কিছু বললে হয়তো খেপে গিয়ে মার দেবে।

পানসিকে দেখতে এসে বিয়ে হয়ে যায়, এই শর্তেÑ জামাইকে ১০ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হবে। পানসির ভেতরে উথাল-পাথাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কেউ জানে না। শুধু পানসি জানে, তার ভেতরে কী হচ্ছে। পাতা এসে পানসির পাশে বসে বলে, ‘বড়ো বু, তোর বিয়াতে অনেক মজা করবার চাইছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম ট্যাহা দিতে অইবো। তখন থিকা নতুন জামাইডারে দেইখা ঘিন্না করতাছে, এডা পুরুষ হইল! এত সুন্দর বুবুরে পাইল ঐ কালা ছাগলডায়। আমি কুনোদিন দুলাভাই ডাকুম না তারে।’
দুধজান ধমক দিয়ে ওঠে, ‘বেশি পাকছো? এই জামানায় ১০ হাজার ট্যাহায় কোনো পোলা বিয়া করব? পোলাডা ভালা। তোর বাজানের অবস্থা বুঝছে। ট্যাহাডা দাবি করছে মুরুব্বিরা। জইন কত ভালা, যাওনের সময় কইছে তাড়াহুড়ার দরকার নাই। আপনি সময়-সুযোগমতো ট্যাহাডা দিবেন। বড়ো গেদিরে সাথে নিয়াও যাইবার চাইল। বাধা দেয় গেটু মাতবর। এই গাঁয়ের মান আছে না? পাওনা ট্যাহা ছাড়া ম্যায়া নিলে শ্বশুরবাড়ির মানুষ কি ভালা চোখে দেখবো। গেটু মাতবর তোর বাজানরে রাইতে যাইবার কইছে।’
গুতু ফকির মাতবর বাড়িতে হাজির হয়। মাতবর ঘরের বারান্দায় বসে পাট দিয়ে দড়ি পাকাচ্ছিল। গুতু সালাম দিলে মাতবর ওর দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দেয়, ‘বাজান, বস্। মন খারাপ ক্যা? শুভ কাম শেষ হইছে। ঘাড়ের বোঝা নামছে। এখন তো খুশি থাকবা।’
‘হু চাচা, কিন্তু টাহার সমস্যা তো রয়ে গেছে।’
‘ওহ্, যা দিনকাল পড়ছে। ১০ হাজার ট্যাহা যৌতুকে আইজ-কাইল কেউ বিয়া দিবার পারে? তোমার কপাল ভালা। তাই তো পারছ। পোলাডাও ভালো। একটু দোষ, বাপ চোর আছাল আর জাতে মিশিগারি। কিন্তু পোলাডা হইছে মাশাল্লাহ। একটা কতা আছে না, “কমিনের ঘরে মুমিন হয়”।’
‘চাচা দোয়া করবেন। আমার পক্ষে তো ঐ ট্যাহা জোগাড় করা সম্ভব হইতাছে না। এখন কী করমু। একটা পরামর্শ দেন। আপনের জুন্যেই বিয়াটা সম্ভব হইছে।’
‘তোমার কি জমি একটুও নাই?’
‘কুষ্টার আটায় একটু আছে। ২০ শতাংশ।’
‘বাজান গো, কুষ্ঠার আটায়, তাও আবার ডাবায়। তাইলে জমির গায়েক (গ্রাহক) তো পাওন যাইব না, কারণ জমি তো পতিত পাইড়া থাকে ডোবায়, আর কী ফসল হয়? এই জমি কারা ট্যাহা দিয়া কিনব?’
‘চাচা, আপনি আমার বাপের সুমান। বিয়ার ইষ্টির খাওনদাওন আপনের সাহায্যেই হইছে। এখনো আপনেই আমারে বাঁচাইতে পারেন।’
‘গুতু, মানুষের দুঃখ সহ্য হয় না, তাই সবার বিপদ-আপদে ঝাঁপাইয়া পড়ি। আর তোমার ম্যায়া এই গাঁয়ের ম্যায়া। ম্যায়াডা সুখে থাকুক, এই দোয়া করি। মাইয়া কষ্ট পাইবো ট্যাহার জুন্যে। বাঁইচা থাকতে তা হইতে দিমু না। ১০ হাজার আমিই দেই। কী আর করমু? তোমার ম্যায়া আমার ম্যায়া এক কথা, কাইল কালিহাতী রেজিস্টার অফিসে যাইবা। তুমি দলিল কইরা দিবা। ট্যাহা চাইলে নিয়া যাও। জামাইরে ট্যাহা দিয়া ম্যায়াডা পাঠাও স্বামীর ঘরে।’
যদিও এতে গুতু ফকিরের কিছুটা স্বস্তি আসে, আবার মনটাও বিষাদে ছেয়ে যায়। বাপ-দাদার শেষ সম্বল এক টুকরো জমি চিরদিনের জন্য হারাতে হলো। ঘরে ফিরে ধপাস করে দাওয়ায় বসে পড়ে গুতু।
‘কী ব্যাপার? কিছু হইল না?’
‘ব্যবস্থা একটা হইছে। তয় সব শেষ কইরা।’ গুতুর কথা শুনে দুধজানের ওপর মেঘের বুরুজ ভেঙে পড়ে।
গুতু ফকির দুধজানকে বলে, ‘পান দাও।’
দুধজান পানের খিলি তুলে দেয় গুতু ফকিরের হাতে। পান মুখে দিয়ে গুতু বলে, ‘ট্যাহা রাখো। জামাইরে খবর দিতে অইবো। কাইল জমিডা দলিল কইরা দিই।’
দুধজান বলে, ‘দলিল পরে কইরেন। আগে ম্যায়াডা বিদায় করেন।’
‘না। মাতবর কইছে দলিল কইরা দিতে। সে আমার উপকার করছে। কাজেই তার কথাও শুনতে অইবো। কাইল জমি দলিল দেবার পর ম্যায়া পাঠাইমু। বড়ো গেদির মাও, আমি একটা বিষয় খেয়াল করলাম। বিয়ের পর থন বড়ো গেদির মুখটা বেজার। জামাই যে দুই দিন আছাল, তার সাথেও তেমন কথাবার্তা কইতে দেখি নাই। তাইলে কি গেদির জামাই পছন্দ হয় নাই?’
দুধজান ঝনাৎ করে ওঠে, ‘কী কয়? ম্যায়াগো আবার পছন্দ। পোলা কালা। তাতে কী? হাতের আঙুট বাঁকাও ভালা। মাইয়ার কপাল ভালা। আমাগো মানুষের মুতন গরিবের ম্যায়া যে জইন বিয়া করছে, এইডাই মাথাসমান। আরে রাখেন তো, সব ঠিক হইয়া যাইবো। বড়ো গেদি বেশ শরমিন্দা (লাজুক), তাই জামাইয়ের সাথে কথা কইতে শরম পায়।’
বেদনার দীর্ঘ রাত্রি শেষে পানসির হৃদয়ের মন্দিরে ব্যথার প্রবালদ্বীপ জেগে ওঠে। তার বুকের ভেতর অনবরত বেজে চলছে অস্ফুট কান্নার মতো একটা সুর। পানসির বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই খুশি। কেউ বলেছে, ‘ফকিরের মাইয়া ভালা পোলার হাতেই পড়ছে।’ কেউ বলছে, ‘জইন ভালা পোলা। কামাই রোজগার ভালা।’ এমন সব বিক্ষিপ্ত কথার মধ্যে পানসির হৃদয়ে বয়ে যাচ্ছে হু-হু বাতাস। কেউ জানল না তার আকুল হৃদয়ের খবর।

পানসির বিয়ের খবর গভীর রাতে গহরের কানে পৌঁছায়। রাতের বাতাসে ভেসে আসে পানসির চুলের সুগন্ধি। মেহেদিরাঙা হাতে লাল বেনারসিতে ঘোমটা টেনে বিয়ের পিঁড়িতে বসে বেদনায় ভরা প্লাবন জলে ভাসছে পানসি। আর কেউ না জানুক, আর কেউ না দেখুকÑ গহরের চোখে ভাসেÑ পানসির হৃদয়ে আর্তনাদ করছে নিষ্ঠুর হাহাকার।
দুটি হিয়ার দীর্ঘশ্বাস এসে নোঙর ফেলে বিষন্ন বন্দরে। দস্যুর তাÐবে যেন লুট হয়ে গেছে তাদের ছোট্ট স্বপ্নের ঘর।
উদাস দুপুরে কদমতলে বসে আছে পানসি। তার দুটি ব্যথাতুর চোখ তাকিয়ে আছে নীল আসমানের চ‚ড়ায়। কানের ভেতর উদাস দুপুরে ভেসে আসে বিয়োগব্যথায় সুর। যে বাঁশিতে সুবাস ছড়াত, যে বাঁশি স্বপ্নে রং ছড়াত, সে বাঁশিতে আজ শুধুই বিষাদের ধ্বনি। সে বাঁশিতে গোধূলির ক্লান্ত রাগ ডুকরে কাঁদে। সবুজ মাঠে আজ শুধুই বিষণœ সুর। কোথা থেকে পাতা হন্তদন্ত হয়ে এসে পানসির ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটায়। ‘বড়ো বু, জব্বর খবর আছে!’ পানসি অবাক চোখে তাকায় পাতার দিকে। ‘জানো, হেই বিদেশি মেম নাকি ম্যায়াগো বিদেশ নিয়ে যায়। মনুভাই বউরে বিদেশ পাঠাইবো।’ পানসি তবুও নির্বাক। পাতা পানসির সঙ্গে কথা বলে মজা পায় না। এত বড়ো একটি খবর পরিবেশনের পর পানসির কাছ থেকে সে অন্য কিছু শোনার আশা করছিল।

মনু জয়তুনকে পাশে বসিয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বলে, ‘জয়তুন তোরে অনেক কষ্ট দিছি। আসলে চারদিকে অভাব-অনটনের মধ্যে মাথা ঠিক থাকে না। যাক, এইবার একটা সুযোগ পাইছি। তোরে বিদেশ পাঠাইমু।’
মনুর ভালোবাসামাখা কথায় জয়তুন গলে যায়। আহ্লাদের স্বরে সে বলে, ‘তোমার মাথা ঠিক আছে?’
‘আমার মাথা ঠিক আছে। এই ভাঙা সংসারে আর কত জোড়াতালি দিমু? সংসারের অভাব দূর করবার চাই।’
জয়তুন আহ্লাদ করে মুখে ভেংচি কেটে বলে, ‘কামাই করবার মুরোদ নাই। সারাদিন তাস খেলো, সংসারে জুইড়া আইবো কেমনে? একটা কথা আছেÑ বিধি কৃপা কর তুমি একটু নচচর।’
‘জয়তুন শোন। আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দে। আমি যা কই, তাই কর। তোর ঘরে তো পোলাপান হইল না। অইবোও না। বিয়া শাদি আর করমু না আমি। তোরে নিয়াই সংসার করমু।’
মনুর কথায় জয়তুনের ভেতরটা তিড়িংবিড়িং করে নেচে ওঠে খুশিতে। বাচ্চা না হওয়ার জন্য অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয় তাকে। মার খেতে হয়। জয়তুন অবাক হয়ে মনুর দিকে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে ঝিলমিল করে হাসি।
‘জয়তুন, তোর সাথে অনেক খারাপ আচরণ করছি।’ জয়তুনের হাতটা নিজের হাতে পুরে নিয়ে মনু বলে, ‘আমারে মাপ কইরা দিস। আবার নতুন কইরা সুখের সংসার করবার চাই। তুই আমার কতা শুনবি?’
জয়তুন মনুর মুখে এমন কথা আগে কখনো শোনেনি। আকাশের চাঁদ যেন জয়তুনের ঘরে নেমে এসেছে। দীর্ঘ সাত বছরে বিবাহিত জীবনে এমন মুহূর্ত কল্পনাও করতেও পারেনি সে। তাই তো জয়তুন আহ্লাদে গলে যায়। ‘তুমি যা কইবা সব শুনমু।’
জয়তুনের ঘাড়ে হাত রেখে মনু বলে, ‘এত বড়ো একটা সুযোগ পাইছি। এইডা হাতছাড়া করন যাইবো না। সব ট্যাহা রূপী দিব। শুধু বিমানভাড়া আমায় দিতে অইবো। যদি বাপের বাড়ি থিকা হাজার তিরিশ ট্যাহা আনবার পারস। বাকি ট্যাহা আমি ঋণ করমু।’
এ কথা শুনে জয়তুন আলাভোলা হয়ে যায়। বলে, ‘বাজানের তো ট্যাহা দেওনের ক্ষমতা নাই। তাও বাজানের কাছে গিয়া কই।’
‘জয়তুন কাইল বাপের বাড়ি যাইবি।’

এককান-দুকান করে জয়তুনের বিদেশ যাওয়ার খবর সারা গ্রামে রটে যায়। গাঁয়ের মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে আজেবাজে কথাও বলতে থাকে।

জয়তুনের বাপের বাড়ি কয়েক গ্রাম পর। গ্রামের নাম, জগরমান। লাল টকটকে একটা শাড়ি পরে মাথায় প্রিন্টের ওড়না পেঁচিয়ে ছাতা মাথায় সে চলে জগরমানের উদ্দেশে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর, দুপুরের খাঁখাঁ রোদে এসে দাঁড়ায় বাবার বাড়ির উঠানে।
জয়তুনের মা ছালেতন মেয়েকে দেখে আঁতকে ওঠে, ‘আরে গেদি তুই? এই ভরা দুপুরে? রৌদে বাইরে পা দেওন যায় না। কোনো খবর দিলি না যে?’ জয়তুনকে ঘরের মেঝেতে বসিয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করে ছালেতন। ‘গেদি কোনো খারাপ খবর? মুনডা বেজার ক্যা?’
‘মা, বাজান কই?’
‘তোর বাজান পুব চহে গেছে। কিছু কইবি? আমার কাছে কইয়া ফালা। তোরে দেইখা আমার ভালো মুনে হইতাছে না।’
জয়তুন মায়ের গলা জড়িয়ে বলে, ‘মা আমার ঘর যদি ঠিক রাখবার চাও, তাইলে ৩০ হাজার ট্যাহা দিতে অইবো। তা না হইলে তোমাগো জামাই আমারে তালাক দিব।’
‘৩০ হাজার ট্যাহা? কই পাইমু? তোর বাজান কামলা খাটে। জমি-জিরাতও নাই। এই ভিটা ছাড়া আর তো আমগো কিছুই নাই।’
‘মা, তোমাগো জামাই আমারে বিদেশ পাঠাইবো। আমি বিদেশে চাকুরি কইরা অনেক ট্যাহা পাঠাইমু।’
‘তওবা-তওবা! কী কস? তওবা পড়। মরতে অইবো না? এই দুনিয়া কয় দিনের? এমুন নাফরমানি কাম তুই করবি? তুই শ্বশুরবাড়ি যাইবি না। আমরা বাঁইচা থাকতে তোরে বিদেশ যাইবার দিমু না। তোর বাজান আসুক। জামাইরে খবর দিবার কইমু। ম্যায়ামানুষ বিদেশ যায়? এমুন কথা তো আইজ পর্যন্ত শুনি নাই।’
ছালেতনের চিৎকার-চ্যাঁচামেচির মাঝেই নাটু হাজির। ‘জয়তুনের মাও, কী হইছে? চিল্লাচিল্লি করতাছ ক্যা?’
‘ও গেদির বাপ, এমুন সর্বনাইশা কতা তো কোনো দিন শুনি নাই। আপনার ম্যায়া কী কয়? শোনেন!’ হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় ছালেতন।
‘তুমি কান্দিতাছ ক্যা? কী হইছে? কও শুনি।’
ছালেতন চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘আপনের ম্যায়া আসচে। তার কাছেই শুনেন।’
নাটু গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে। জয়তুনের গাল বেয়ে নোনা পানির ঢল নামছে। নাটুর ভেতরটা আঁতকে ওঠে। মুখটা মুহূর্তে কালো হয়ে যায় তার। ভয়ে ভয়ে বলে, ‘গেদি কোন সুময় আইছো?’ জয়তুন উত্তর দিচ্ছে না। নাটু ভাবে, হয়তো মনু মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাচ্চা না-হওয়ায় অপরাধে মেয়েকে জামাই প্রায়ই মারধর করে, নাটু এটা জানে।
নাটু মেয়ের কাছে বসে মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘মা রে, আমার কাছে বল। জামাই কি তোরে খেদাই দিছে?’ জয়তুন মাথা নেড়ে না-সূচক জবাব দেয়। ‘তাইলে কী হইছে?’
জয়তুন আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সব বৃত্তান্ত বলে।
‘তা গেদি, ম্যায়ারা বিদেশ যায়? তারা বিদেশ গিয়া কী করব?’
‘কুহপডরার এক ম্যায়া বিদেশে থাকে, বাজান। হে বিদেশ থিকা ছুটিতে আইছে। আমাগো বাড়িও গেছাল। দেশে অনেক ট্যাহাও পাঠাইছে।’
‘কুহপডরা কার ম্যায়া?’
‘তা তো জানি না, বাজান। তোমাগো জামাই কইতে পারব।’
‘মা, আমি খবর নিয়া দেখি। তুই চিন্তা করিস না। তোর বাপ বাঁইচা আছে। ব্যবস্থা একটা অইবো।’
ছালেতন বলে, ‘আইচ্ছা তোগোর গাঁয়ের গুতু ফকির আইছল। বিহানের দিকে। অর ম্যায়ার কথা কইল। পানসির বিয়া হইছে। তয় ফকিরের শরীলডা ভালা না। তাই বই গেলো। কইলো আইজ আর গাওয়ার (ফেরি) করবো না।’

নাটু মেয়ের জামাইকে খবর দেয়। মনু এসে খুব ভক্তি সহকারে শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে।
‘জামাই, তোমার কতা আমি বুঝলাম। প্রথম কথা হইল। মানুষ কী কইবো, ম্যায়ামানুষ বিদাশ গেলে মান-ইজ্জত থাকবো? দ্বিতীয় কতা হইল, এই ট্যাহা পাইমু কই?’
মনু বলে, ‘আব্বা কুহপডরা রূপীর সাথে আমি কইছি। এদেশে মেলা ম্যায়্যরা বিদেশে গেছে। তারা ভালা চাকুরি করে। কোনো সমস্যা নাই। জয়তুন যাওনের কিছুদিন বাদে আমিও যাইমু।’
‘মনু মিয়া, তুমি তো আমার খবর জানো। তার পরও চেষ্টা কইরা দেখি।’ নাটু পান খেতে খেতে বাইরে বেরিয়ে যায়।
মনু জয়তুনকে ডেকে বলে, ‘আমি বাড়ি গেলাম। তুই ট্যাহা ছাড়া আস্লে বাড়ি উঠাইমু না।’

পানসি স্বামীর বাড়ি গেছে বেশ কিছুদিন হলো। পুতি আর পাতা উঠানে বসে আছে। ছাগলটা বাহিরবাড়ি নিমগাছের সঙ্গে বাঁধা। ম্যা-ম্যা করে ডাকছে। দুধজান কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে। বহিরবাড়ি বসে বাতাসে সে গা জুড়ায় কিছুক্ষণ। আষাঢ মাস। চারদিকে থইথই পানি। দুধজানের ভেতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগে। নিজে নিজেই ভাবতে থাকে, এমন লাগছে কেন? মেয়েটার কোনো সমস্যা হলো না তো? মাথার মধ্যে নানারকম দুশ্চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। এরই মধ্যে একটা নৌকা ঘাটে এসে থামে। নৌকা থেকে গুতু ফকির টালমাতাল অবস্থায় নেমে আসে।
‘কী ব্যাপার? আপনি? শরীর খারাপ? মুখটা অমন ক্যা?’ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে করতে দুধজান গুতুকে ধরে।
‘আমার ভালা লাগতাছে না, আমারে ঘরে নিয়া যাও।’
দুধজান ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে গুতুকে শুইয়ে দেয়। ভীষণ গরম। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। দুধজান পাখা দিয়ে বাতাস করে আর গুতু ফকিরের মাথার চুলগুলিতে আঙুল বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে গুতু ফকির।
দুধজান স্বামীর পাশে বসে বাতাস করতে থাকে, যাতে আরামে ঘুমাতে পারে তার স্বামী। পাতা এসে বলে, ‘মাইয়া, মনুভাইয়ের বউ বিদাশ যাইবো। বাপের বাড়ি গেছে ট্যাহার জুন্যে। মনুভাই শ্বশুরবাড়ি যাইতাছে। আমারে কইল, দোয়া করিস ট্যাহাডা জোগাড় হইলেই যাইতে পারবো।’
দুধজান নির্লিপ্ত। মেয়ের কথায় কোনো কর্ণপাত করে না সে। একা একা বকবক করে পাতা চলে যায়।

মাঝরাতে গুতু ফকিরের ঘুম ভেঙে যায়। দুধজানকে ডাকে, ‘ও বড়ো গেদির মাও, বড়ো গেদির মাও!’
দুধজান