নীতি বনাম দুর্নীতি

8

 

বর্তমান সমাজে নীতির চেয়ে দুর্নীতি নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে। প্রায় সবাই একবাক্যে সমাজের সবক্ষেত্রে দুর্নীতির শিকড় বহু গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে বলে গলা ফাটিয়ে বক্তব্য দিয়ে চলছেন। টিভির টক-শো, আলোচনা অনুষ্ঠান বা ফেসবুকের মতো ডিজিটাল প্লাটফর্মে দুর্নীতি বিরোধী কথাবার্তা হরহামেশা শোনা যায়। লক্ষণীয় যে সবাই নিজে কতো সৎ, উদার, পরোপকারী, ধার্মিক তা প্রমাণ করার চেষ্টায় সুন্দর সুন্দর উদাহরণ তুলে ধরেন আর অসাধুদের জন্য দেশ রসাতলে যাচ্ছে বলে উচ্চকণ্ঠ হন। কিন্তু সবাই যদি আমরা সৎ হই তাহলে অসৎ কে ? আর চারিদিকে যদি দুর্নীতি চলে, তবে কারা নীতিবান! কাদের জন্য দুর্নীতির বটবৃক্ষ বেড়েই চলছে ? উদাহরণ হিসেবে আমরা শুধু একটা জায়গায় নজর দিই, তবে কিছুটা হয়তো বোধগম্য হবে। যদি প্রশ্ন করি, আপনি কি একজন সরকারি চাকুরিজীবী ? আপনি কোন গ্রেডে বেতন পান ? সব মিলিয়ে আপনার মাসিক আয় কতো ?
এবার আসুন আপনার খরচের দিকটা দেখি। আপনার হাতের বেনসন সিগারেটের দাম কতো? আপনি কি পানাসক্ত ! তাহলে আপনার এক বোতল মদের দাম কতো ? আপনি কি চাকরি করার মাঝেই বাড়ি, গাড়ি, ফ্লাটের মালিক হয়েছেন ! এক না একাধিক ? সবার পারিবারিক অবস্থা নিশ্চয়ই এমন নয় যে পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগ দিয়ে কোটি টাকার জমি- বাড়ি/ ফ্লাট আর তিরিশ/ চল্লিশ লাখ টাকার গাড়ি কেনা যায়। আপনার ছাদবাগানের গাছগুলো নিয়ে যে ফেসবুক লাইভ করেন, ঐ বাড়িটি কি আপনার বেতনে বানানো সম্ভব? রোজ যে ধর্মের বাণী পোস্ট করেন তা কি আপনার ফাইল আটকে রেখে ঘুষ নেয়া, চাকরি দেবার প্রলোভন দেখিয়ে বা ট্রান্সফার বাণিজ্য করে আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
ফেসবুকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তরুণদের নিয়ে গ্রুপ বানিয়ে, তাদের দিয়ে নিজের স্বার্থহাসিল করা কি আপনার নীতি? নিয়মিত দামী রেস্তোরাঁয় খাবারের বিল কোন টাকা দিয়ে মেটান ? দেশ- বিদেশে ভ্রমণের টাকা কি ভুতে জোগায়! আমরা সবাই দুর্নীতি নিয়ে কথা বলি, কিন্তু নিজের নীতি কী, আর তা আদৌ পালন করি কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। নিজের ক্ষেত্রে দুর্নীতিই করাই যে নীতি হয়ে গিয়েছে তা ভুলে বসে আছি। আমরা দুর্নীতিকে অধিকার হিসেবে মনে করতে শিখেছি। আমরা অন্যকে দোষারোপ করি কিন্তু নিজের মধ্যে কোন দোষ খুঁজে পাইনা। শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, সব পেশাতে এই চিত্রের দেখা পাওয়া যায়, কম বা বেশি। ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লোপাট, প্রজেক্টগুলোয় চুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা, আমদানি- রফতানি, আয়কর, ভ্যাট কোনটা রেখে কোনটা বলি ! এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়। আমরা যে অসততায় আকন্ঠ ডুবে আছি।
দুর্নীতি দূর করতে হলে আগে নিজের নীতি সম্পর্কে জানতে হবে, মানতে হবে। নিজে চোর হয়ে অন্যকে সাধু হবার উপদেশ বিলানো হাস্যকর। যে যতো বড় চোর, দুর্নীতিবাজ, তার গলার আওয়াজ এখন ততই চড়া। চারপাশে তার প্রমান অহরহ। সহসা এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় দেখা যায় না। কারণ ভোগবাদী অর্থনীতি মানুষের ভোগের চাহিদাই বাড়ায়। সম্পদ কখনও স্থির থাকে না, হাতবদল হয়।
সমাজে যারা এখনো নীতিবান, সৎ, আত্মীয়-স্বজনের কাছে, নিজের সংসারের চোখে আজ তারা বোকা, অথর্ব। সবাই উপরে ওঠে কিন্তু সে পারে না। বর্তমান সমাজে তারা অচল মাল। কিন্তু কে- যে প্রকৃত মানুষ তার সন্ধান কে করে ! অসীম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পাওয়া এই দেশ তো ক’জন চোরের জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে না। একথা অনস্বীকার্য যে, অন্য কোন দেশ থেকে কেউ এসে দুর্নীতি করছে না, করছি আমরা, এই বাঙালিরা যারা একদিন হাতে অস্ত্র নিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছিল।
দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে আরও সমৃদ্ধ করতে হলে, উন্নত দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিতে হলে, দুর্নীতি কমাতেই হবে। সমাজে নতুন এক যুদ্ধ চাই, আর তা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, চোরদের বিরুদ্ধে। চোরদের মুখোশ খুলে দিতে হবে, না হলে দেশে মুষ্টিমেয় মানুষের সম্পদের পাহাড় উঁচু হবে কিন্তু গরিব হবে আরও গরিব। যা কখনোই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলো না। সেই সাহসী তরুণদের অপেক্ষায় রইলাম যারা দুর্নীতিবাজদের হটিয়ে জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ে তুলবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট