নিরাপদ খাদ্য কখন নিশ্চিত হবে?

16

নগরী কিংবা গ্রামে খাদ্যের দোকানের আলাদা কদর আছে। চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউড়ি, চকবাজার, প্রবর্তক মোড় থেকে ২নং গেইট, কিংবা ফাস্টফুডের ছোট-বড় দোকান যেখানেই আছে সেখানেই মানুষের জটলা, গ্রাহতের ভীড় আর খাদকের প্রতিযোগিতা যেন লেগেই আছে। এসব খাবার দোকানের বড় একটি অংশ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী। এসব তরুণরা রকমারি খাবার বা ফাস্টফুডের দোকান থেকে যা খাচ্ছে, তা কি নিরাপদ, স্বস্থ্যসম্মত? এসব প্রশ্নের উত্তরে এককথায় বলা যাবে না। আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল বিষয়টি একেবারে ওপেন সিক্রেট। সম্প্রতি নগরীর সুলতান কাচ্চি ডাইনিং নামক একটি খাবার দোকানে কাচ্চি পরিবেশন নামে বিড়ালের কিংবা কুকুরের মাংস পরিবেশন হয়েছে- এমন গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা গিয়েছে। যদিও মালিক পক্ষ তা অস্বীকার করছেন। তবে একথা সত্যিই যে, এ দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি। তারা খাদ্যপণ্যে অতিমাত্রায় ভেজাল মিশিয়ে অধিক মোনাফা করতে চাই। বিপরীতে এসব ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বলার আপেক্ষা রাখেনা যে, আমাদের নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি বড়ই উপেক্ষিত। অথচ এরজন্য সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কঠোর মাস্তির বিধানও রয়েছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন ভেজার বিরোধী অভিযান করে থাকে, তবে তা অনেকটা লৌকিক। এসব অভিযানে দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। সম্প্রতি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি টোল ফ্রি হটলাইন চালু করেছে। ১৬১৫৫ হটলাইন নম্বরে ফোন করে খাদ্য-সম্পর্কিত যে কোনো পরামর্শ বা অভিযোগ জানানো যাচ্ছে। এই টোল ফ্রি নম্বরে কেউ অভিযোগ করলে অভিযোগসমূহের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও বিশ্বেও সবচেয়ে জনবহুল দেশ সমূহের একটি। এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৬৫ জন মানুষ বসবাস করেন। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিগত ৫২ বছরে উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের গড় আয়ুও তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের প্রয়াস অব্যাহত রাখা হয়েছে। এর জন্য দক্ষ মানবসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই মানবসম্পদ গড়তে প্রয়োজন সুস্থ দেহ, সুস্থ মন। এই ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি পুষ্টি-নিরাপত্তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যনিরাপত্তা-সংক্রান্ত সরকারি নজরদারি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও নিয়মতান্ত্রিক বলে বিবেচনা করা হয়। এটি কিন্তু রাতারাতি হয় নাই। ১৯০৫ সালে আপ্টন সিনক্লেয়ার নামের একজন লেখক প্রকাশ করেন ‘দ্য জাঙ্গাল’ নামের একটি গ্রন্থ। প্রকাশিত বইটি লেখা হয়েছিল অভিবাসীদের নিয়ে, যারা শিল্পাঞ্চলে বসবাস করত। বইটির লেখক ছদ্মবেশে শিকাগোর একটি মাংসের খামারে কর্মচারী হিসেবে কাজ করে দেখেছিলেন সেখানে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও বিপণন করা হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা হতেই তিনি লেখেন ‘দ্য জাঙ্গাল’ বইটি। বইটি একসময় নজরে আসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের। এর পরই রুজভেল্ট উদ্যোগ নিয়ে ‘পিওর ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাক্ট’ এবং ‘ফেডারেল মিট ইন্সপেকশন অ্যাক্ট’ আইন সভায় পাশ করিয়ে নেন। এর পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদ খাদ্যের জন্য আলাদা কোনো আইন ছিল না। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছে আরো বিবিধ আইন। সর্বশেষ ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকার নিরাপদ খাদ্যের জন্য আরেকটি আইন পাশ করে ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড মডার্নাইজেশন অ্যাক্ট’ নামে। এই আইনসমূহের সঠিক প্রয়োগের কারণেই সে দেশটিতে খাদ্য তুলনামূলক নিরাপদ।
আমাদের দেশেও ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ রয়েছে। তবে আইন থাকলেই কিংবা নূতন হটলাইন চালু করলেই আমাদের খাদ্য নিরাপদ হয়ে যাবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন অর্ধকোটি মানুষ রাস্তার খাবার গ্রহণ করেন। অথচ ইতোপূর্বে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারে ক্ষতিকর জীবাণুর উপস্থিতি রয়েছে। চট্টগ্রামের অবস্থাও প্রায় একই। বিশ্বের অনেক দেশেই রাস্তার খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে; কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ রাস্তার খাবার প্রস্তুত ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো বালাই নাই। কালো তেল, রাসায়নিক রঙ, দূষিত পানি, ধুলাবালি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অধিকাংশ রাস্তার খাবারকে করে তুলেছে অনিরাপদ। ফলে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন এই সকল খাবার খাচ্ছেন, তারা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। মনে রাখতে হবে, একটি খাদ্য তখনই নিরাপদ হইবে যখন এর উৎপাদন প্রক্রিয়া হতে শুরু করে বিপণন, রান্না, পরিবেশন এবং খাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পদে তা নিরাপদ থাকবে। স্পষ্টতই, অসাধু বা অসচেতন উৎপাদক বা ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছাড়াও নানা কারণে খাদ্য দূষিত বা অনিরাপদ হতে পারে। অন্যদিকে, রাস্তার খাবার অনিরাপদ হওয়ার উল্লেখযোগ্য বড় কারণ ক্রেতাদের অসচেতনতাও। চোখের সম্মুখে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে খাবার তৈরি হচ্ছ দেখেও মানুষ এই ধরনের খাবার গ্রহণ করছেন। সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অবশ্যই কাযকর হলে ভালো ফল দিতে পারে। তবে সবকিছুর আগে জনগণকে সচেতন হতে হবে, আইনের সঠিক প্রয়েগ নিশ্চিত করতে হবে।