জব্বারের বলীখেলা সযত্নে লালিত হোক লোকায়ত বাংলার এ ঐতিহ্য

9

গতকাল ১২ বৈশাখ ১৪৩০ বাংলা মঙ্গলবার ঐতিহাসিক লালদিঘী মাঠে চট্টগ্রামের চিরায়ত ঐতিহ্য আবদুল জব্বারের বলীখেলা সম্পন্ন হয়েছে। তবে বলী খেলাকে উপলক্ষ করে লালদিঘীর আশেপাশে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে বৈশাখী মেলা। এ মেলা চলবে আগামীকাল পর্যন্ত। সাধারণত, এ মেলার মেয়াদকাল বলীখেলার আগে পরে ৩দিন হলেও তা সপ্তাহজুড়েই অব্যাহত থাকে। এবারের বলীখেলা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত বা মহামারি জনিত কোন সংকটের সন্মুখীন না হলেও ঈদের পরপর হওয়ায় সাধারণ মানুষের সমাগম ছিল কম। এছাড়া মেলায় কেনাকাটাও তেমনটি ছিল না বললেই চলে। কারণ ঈদ উপলক্ষে সাধারণ মানুষকে বড় একটি খরচ সামলাতে হয়েছে। এরপরও নগরীর গৃহিনীদের ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারসামগ্রী কেনার সুযোগটি হাতছাড়া করবে না আশা করা যায়। আমরা জানি গতবছর অতিমারি করোনার পর বলীখেলার আয়োজন নিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন কমিটি। এরপর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম. রেজাউর করিম চৌধুরী বলীখেলা আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে নেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় এবছরও এ ঐতহ্যবাহী বলীখেলা ও মেলার আয়োজন হয়েছে। এজন্য মেয়রসহ আয়োজকরা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। চট্টগ্রামের এ বলীখেলা নিছক কোন খেলা বা মেলা নয়, এটি এক ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে ১৯০৯ সালে ২৫ এপ্রিল বাংলা ১২ বৈশাখ তারিখে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে এই বলী খেলার আয়োজন করেন। পরবর্তীকালে এই বলী খেলা আবদুল জব্বারের নামে পরিচিতি লাভ করে। আদুল জব্বার একজন দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ও আন্দোলনের অংশ হিসেবে এ বলী খেলার আয়োজন করেন। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, খেলাধুলার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি এই খেলার সূচনা করেছিলেন। সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের জন্য অংশ নয়, লড়াই-সংগ্রামেরও অংশ, এ কথা সচেতন মানুষ মাত্রেই জেনে আসছেন। কিন্তু সংস্কৃতির পাশাপাশি ক্রীড়াও যে লড়াই-সংগ্রামের অংশ, তা ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার বাঙালির বোধের মধ্যে নিয়ে আসেন। তারই প্রকাশ আমরা আবার খুঁজে পাই, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মাধ্যমে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অচিরেই ব্রিটিশবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণে তাদের তৎপরতায় ব্রিটিশের সার্বক্ষণিক নজর ছিল। সে জন্য বিকল্প পন্থা হিসেবে খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীরা এবং তাদের সমর্থকরা। তরুণ-যুবাদের শুষ্ক, শঙ্কিত মনে নতুন আশা, নতুন সাহস পল্লবিত হয়ে ওঠে। তারা ক্লাবে যায়, শরীর চর্চা করে। ছেলেদের প্রতিদিনের অভ্যস্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের অন্তরালে বাড়িতে, স্কুলে, মাঠে, ক্লাবে, ভাবি ডেথ প্রোগ্রামের সোপান চাকা ক্রমশ দ্রæততর গতিতে আবর্তিত হতে আরম্ভ করে, যার পরিণতিতে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় জালালাবাদ যুদ্ধ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ।
আবদুল জব্বারের বলী খেলাও খেলাধুলার আড়ালে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিতসারা করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার যে বার্তা ব্রিটিশ এবং বাঙালি জাতিকে দিয়েছিলেন তা ছিল- এ বলী খেলার মাধ্যমে জাতির মানস গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনো পুরস্কারের লোভে লালায়িত হয়ে বাংলার দামাল ছেলেদের এ পথে আসার আহŸান জানাননি।
বলী খেলার আভিধানিক বা সমার্থক শব্দ কুস্তি খেলা হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু বলী খেলা আর কুস্তি খেলা এক নয়। আবদুল জব্বারের বলী খেলা নিছক কুস্তি খেলা নয়। আবদুল জব্বারের বলী খেলাকে কুস্তি খেলা হিসেবে ভাবতে চাইলে এর অনন্য ঐতিহাসিক বিশেষত্ব হারিয়ে যাবে। এর পরিধিটুকু সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার বাংলাদেশের খেলাধুলা গ্রন্থে এ কারণে এটাকে কুস্তি খেলা বলেননি। তিনি লিখেছেন, ‘জব্বারের বলী খেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতিবছরের ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়।’ অর্থাৎ বলী খেলা ঠিক কুস্তি খেলা নয়, কুস্তি খেলার মতো। কুস্তি খেলা আর ‘এক ধরনের কুস্তি খেলা’ সমার্থক নয়। কিছু ভিন্নতা আছে। এই ভিন্নতা হতে পারে এর ইতিহাস, ঐতিহ্যে কিংবা আয়োজনের বৈশিষ্ট্যে। এছাড়া এর একটা নিপাট রাজনৈতিক সত্তা বিরাজমান। আছে মহান রাজনৈতিক দর্শন। আবদুল জব্বারের বলী খেলা চট্টগ্রামবাসীর আবেগ, ঐতিহ্যের শুধু অংশ মাত্র নয়, পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য জব্বারের বলী খেলাকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহত্ত¡ম আয়োজন হিসেবেও বিবেচনায় নিতে হবে। আবদুল জব্বারের বলী খেলা এ বছর আয়োজনের ১১৪ বছর অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের সময়ে এবং অতিমারির কারণে দুই বছর ছাড়া আর কখনো জব্বারের বলী খেলা বন্ধ থাকেনি। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, আবদুল জব্বারের বলী খেলা ধারাবাহিকতার দিক থেকে সবচেয়ে প্রাচীন একটি খেলা। আবদুল জব্বারের বলী খেলা আজ বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতির ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। আমাদের সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ বলীখেলা ও মেলা অব্যাহত থাকবে, সযতেœ লালিত হবে অনন্তকাল-এ প্রত্যাশা সকলের।