ঘুরে আসলাম কিশোরগঞ্জ থেকে

95

আমার স্বীয় ভাইঝি যার নাম রহীমা বেগম হলেও আমি সোহাগ করে তাকে দোলন ডাকতাম। দোলন চাঁপা দেশীয় পুষ্পের নাম। দোলন নামটি অদ্যাবধি তারও পছন্দের নাম। আমার বড়োভাইকে দোলন খুব সেবা শুশ্রুশা করতো। আমার আদুরের ভাইঝিকে বিয়ের পিড়িতে বসাতে হবে। ওর জন্য প্রস্তাব এসেছে ঢাকা থেকে। ঘটক ছিলো এক মহিলা যার নাম ছিলো কেয়া। পাকা ঘটক বললেও অত্যুক্তি হবে না। আমাদের মতো চাঁটগা অঞ্চলের লোকদের মনে কি সম্মোহনী শক্তির পরশ বুলাতে সক্ষম হয়ে এ ঘটক, তা অজ্ঞাত। ভাইয়ের তিরোভাবের পর গৃহে আমার কর্তৃত্বটা ছিলো প্রবল। ঘটকের আহবানে বর দেখতে এবং তাদের পারিবারিক বিষয়াদি জ্ঞাত হতে ঘটকের আহবানে সাড়া দিয়ে পারিবারিক প্রয়োজনীয় সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় গেলাম। বর পক্ষের সঙ্গে আলাপচারিতায় মনটা ঘেমে গেলো। আমার দিক থেকে আত্মীয়তা করার জন্যে অনুকূল সাড়া। এব্যাপারটা অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে ন্যুনতম সাহস কারো ছিলো না, তাই ঘটা করে বিয়ের কাজ সমাপ্ত হলো। ওরা ভালোপুত্র বধূ অর্থাৎ আমার দোলনকে পেলো। আর আমরা কন্যা লক্ষ পেলাম ভালো একটা বর। যার নাম বুলু, আমার দোলনকে কেউ কেউ দিলু নামে ডাকে। দিলু তে এবং বুলুতে নামগত ছন্ধ। বেশ মানানসই। ওদের ঢাকার পরিবার আর আমাদের চাটগাঁর পরিবারের মধ্যে পথের দূরত্ব যতই থাকুক না কেন মনের দূরত্ব বা আন্তরিকতার কোন দূরত্ব বিদ্যমান ছিলো না। বরের মা অর্থাৎ আমার বেহাইনের সাথে আন্তরিকতা যথেষ্ট সেতুবন্ধন রচিত হয়। বেহাইনের সঙ্গে ঠাট্টা বিদ্রুপের কমতি ছিলোনা কোন অংশে। বেহাইনের দীর্ঘদিনের একটা আবদার ছিলো ওনার বড়ো মেয়ে ফিরোজার শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জে যেতে হবে। অনেকদিনের বায়নাকে বাস্তবতা নিয়ে যেতে অগত্যা রাজী হয়ে গেলাম। কিশোরগঞ্জে যেতে বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের আগাম আসা-যাওয়ার টিকেট সংগৃহিত হয় প্রায় ৫ দিন পূর্বে। গত শুক্রবার ছিলো যাত্রাকালীন দিন। সকাল ৭টা ২০ মিনিটের পূর্বেই স্টেশন পৌঁছে ট্রেনে উঠে ‘ঞ’ বোগিতে আমরা ১৫ জন যাত্রী শিটে বসে পড়ি। বেলা ২টায় গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়। ট্রেনের মধ্যে অবশ্যই নিম্নমানের সেবা। এর পাশাপাশি হিজড়াদের বিরক্তকর আচরণ এবং মাস্তানী চাঁদা। এ যেন রেলভ্রমনের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এ যেন নিরীহ যাত্রীদের সয়ে গেছে। ইতিপূর্বে রেলভ্রমোণে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিতি হয়নি। একসময় কিশোরগঞ্জে একনাগাড়ে ১৫ দিন অবস্থান করেছিলাম তা এক বিশেষ ঠিকাদারী কাজে। ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে দৃষ্টিগোচর হলো নির্বাচনী পোস্টার।
বেশীরভাগ পোস্টার দেখলাম কিশোরগঞ্জ সদর থেকে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার পদপ্রার্থী সৈয়দ আসরাফুল ইসলামের। স্টেশনের বাম দিকে সংযুক্ত সৈয়দ আসরাফুল সাহেবের বিরাটাকার ছবি। সবার কাছে ভদ্র ও নির্লোভ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা পরিলক্ষিত হলো টুকিটাকি আলাপচারিতার মাধ্যমে। এবারে ও তিনি সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু ভোটের পর ফুসফুস ক্যানসারে তিরোহিত হন না ফেরার পথে। একজনের মুখে শোনলাম বর্তমানে ব্যাংকের হিসাবে তার ব্যালেন্স আছে মাত্র ৬০০০/০০ টাকা, বনানীর বাড়িটা বিক্রি করে স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়ে স্ত্রীর জীবন রক্ষা করতে পারে নি তিনি। এর স্বল্প দিনের ব্যবধানে তিনিও প্রয়াত হন। যাক এ ব্যাপারে আর বেশি দূর নাইবা এগুলাম। আমাদের গন্তব্য স্থান বানিয়াগ্রাম। কিশোরগঞ্জে স্টেশন থেকে কম করে হলে ১৫ কিলোমিটার। সিএন্ডজি ট্যাক্সিতে ভাড়া ৩০০ টাকা। চলতি টেক্সিতে রাস্তার দু’দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট। রাস্তাঘাট অবিশ্বাস্য রকমের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং পরিবহনের ঝঞ্ছাট নেই। সামান্য একটুকু রাস্তার পিচ উঠে গেছে, বাকী রাস্তা নখের পিটের মতো মসৃন। রাস্তার ‘দু’ পাশে ইটের বৃহৎকার ভাটা। আশেপাশে ছায়াঘেরা গ্রাম। গ্রামের মধ্যে গড়ে উঠেছে হাটবাজার ও হরেক রকম বিপনীকেন্দ্র। এক বাজার পরিলক্ষিত হলো এরই ভেতর দিয়ে সরু মেটো পথ। আমাদের সিএনজি চালিত টেক্সি সে সে পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। মেটো পথের সর্বত্র সমতল মাঝেমধ্যে একআধটু এ্যাবড়োথেবড়ো। যার জন্যে একটু একটু ঝাঁকুনী। তাও আবার সহনীয়। হঠাৎ টেক্সি ব্রেক করলো টিটুকের বাড়ির পেছনের পথে। আমার গাড়ির শব্দ শ্রবণে ঘরের নারী পুরুষরা জড়ো হয়ে ছিলো একটু আগে। টেক্সি থেকে মামার সাথে উঞ্চ আলিঙ্গন। সালাম ও ছোটদের কদমবুচি। উপচেপড়া আনন্দ। আমাদেরকে ঘরে বসিয়ে হাত বানানো বিভিন্ন প্রকারের নায়নাস্তা। নকশা সমৃদ্ধ পিঠা পুলির মুখরোচক অপূর্ব সমারোহ। খালি পেটে এসব কিছু যেন এনে দিলো। অমৃতের সুধা। খাওয়ার ক্ষেত্রে কারো লাজলজ্জা বা জড়োতা নেই। কারণ তখন তো খালি পেট। ভুরি পূর্তির প্রতিযোগিতায় নিমিষে নিশ্বেষ হলো পরিবেশিত নায়নাস্তা। দূর থেকে আসা আমাদের কেউ এক আধটু ফ্রেশ হবার চিন্তা মাথায় আনেনি। ক্ষণিকের জন্য যেন নিয়মনীতি বিসর্জন দিয়ে রাক্ষুসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপরই উল্টো রীতি অনুসরণ করে হাত মুখ ধোয়ার হিড়িক পড়ে গেলো আমাদের মাঝে। নিমিষে পরিবেশিত হলো ভাত তরকারী। ক্ষুধার্ত মুরগী ধানের মধ্যখানে নিত হলে যেমনটা হয় আমাদের মাঝে তেমন অবস্থা সৃজন হয়।
‘ডাইবেটিক‘ রোগী হিসেবে ডাক্তারের নির্দেশিকা লংঘন করে কয়েক টুকরা গোমাংস নিমিষে ভক্ষণ করলাম। আমার নিত্যদিনের কড়া গার্ডদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে। এটা সম্ভব হয়েছিলো তারা ধুমচে খাওয়াতে ব্যতিব্যস্ত ছিলো তাই। গৃহস্থের পাক করা খাদ্যসামগ্রীর হাড়ির মজুদের তলা শূন্য করতে আমরা বিলম্ব করিনি। আঙ্গিনার উত্তরে বরই গাছের বরই এবং জামবুরা গাছের গুটিকয়েক জামবুরা আমার নাতি-নাতনির দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। সহসা বানরের ভূমিকায় গাছের শাখা বেয়ে নঈম, নকিব উপরে উঠে বরই পেরে আনলো এক পর্যায়ে টিটু জামবুরা পেড়ে দিলো গাছ থেকে। নিমিষে লালগুড়ি মরিচ আর লবণ মিশিয়ে বরই খাওয়ার ধুম পড়ে যায় এরপর জামবুরার ভর্ত্তা। গাছ থেকে পাড়া হলো নারিকেল। টিটু আমার নাতি নারিকেলের পানি পরিবেশন করলো। এরপর নারিকেল পরিবেশন। পেটটা যেন অতল অঠাঁই সাগরে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে ধারণক্ষমতা বেড়ে গেলো বহুগুনে। বানিয়ো গ্রাম বা বানিয়া গাঁওকে আমি মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। অত্যন্ত গোছালো একটি গ্রাম। গ্রামে গড়ে ওঠা পাড়া। পাড়াতে প্রত্যেকটা পরিবারকে মনে করা যেতে পারে সচ্ছলতায় পরিপূর্ণ। এখানে কোন খড়খুটা, খড়ের ছাউনীমুক্ত দরিদ্রে পরিবারের ঘরদুয়ার দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রত্যেক পরিবারের ঘর ইটের পাকা গাঁথুনিতে দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। উপরে টিনের চৌচাল, নিচে একচালা এটা ঘরের পাকা বারান্দা, পাকা সিঁড়ি উঠান থেকে ৩ ধাপ উঁচুতে। আলো-বাতাস প্রবেশের জন্যে কক্ষে কক্ষে জানালার ব্যবস্থা। ঘরের সম্মুখে প্রশস্থ উঠোন। উঠোনে চারিদিক জুড়ে আম, কাঁঠাল, জামবুরা, বরই, লেবু গাছের পত্রে পল্লবে সবুজের সামিয়ানায় বেষ্টিত। সার্বক্ষণিক ছায়া বিদ্যমান, প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতে ৩-৪ টা গরু, আবার কোন কোন গৃহস্থের ঘরে ছাগল পালনের ব্যবস্থাও আছে। টিপুদের বাড়িতে টার্কিস মোরগ-মুরগি ছাড়াও আছে দেশি জাতের মোরগ মুরগি। ঘরের এ কোণে কবুতরের টংঘর। পাশে মসজিদ মাদ্রাসা, প্রাইমারি স্কুল দৃশ্যমান, সীমানা প্রাচীরের পর পর প্রত্যেক পরিবারের আলাদা আলাদা আলিশান পুকুর তথায় মাছ চাষের ব্যবস্থা চোখে পড়লো। সকাল হতে হতেই আযান ধ্বনিতে মুখরিত। এর সাথে মোরগের ডাক, হাঁসগুলো নেমে পড়েছে পুকুরে। ঘুমের আলো এবং গাছের ছায়ার প্রতিযোগিতা উত্তাপকে অনেক সহনীয় করে তুলেছে। তাই দীর্ঘ ২-৩ মাইল পথ পাড়ি দিতে কোথা ও ক্লান্তি অনুভব করিনি। রিক্সার ব্যবহার নেই মাঝেমধ্যে দু-একটা সাইকেল দৃশ্যমান। এখানকার ছেলে মেয়েরা দল-বেঁধে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে অভ্যস্থ।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক পথ অতিক্রম করেছি। হঠাৎ একটা পাকা দালান দেখে থমকে দাঁড়াই আঁচ করতে পারলাম নিশ্চয় কোন পুরানো জমিদার বাড়ি। তোমার ভাইজি জামাই কুলু বললো এটা বাবুল ভাইদের বাড়ি। ক্ষীনকায় এক লোক দেখা গেলো ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি বাবুল ভাই আছেন ও বললো আমিইতো বাবু আবার প্রশ্ন করি এ বাড়ি কি আপনাদের? ও বললো এ বাড়ি আমার দাদা জমিদার ননী গোপালের। ঘরটির আস্তরণ কোথাও কোথাও ঝরে পড়েছে। দরজা-জানালাগুলোর দৈন্য অবস্থা। ঘরে আপন চুন কখন যে করা হয়েছে জানা নেই। তারপরও জমিদার বাড়ি। জমিদারির জৌলুস নেই আঁচ পরিমাণ ও পোড়াবাড়ির মতো মনে হলো।
আর সামান্য কতদূর যেতেই চোখে চৌচালা আধাপাকা গৃহ। প্রশস্থ আঙ্গিানা। এক কোণে গোয়ালঘর-অদূরে সীমের গাছের লতা। ঘর থেকে বেরুতে সামনে প্রশস্থ পুকুর। ও বাড়িতে বাস করে আমার বেহাইনের দেবর। ডুবাই থাকেন। ঘরটিতে সৌকিনতার চাপ। আমরা ঢুকতে হরেক পদের নাস্তা পরিবেশিত হলো। আতিথিয়তার ঘাটতি নেই কোনদিক থেকে। এরপর বেহাইয়ের ছোটবোনের বাড়ি। অসচ্ছল পরিবার হলেও ওখানেও আতিথিয়তা দিয়ে আমাদেরকে বরণ করে নেয়া হয়। আমার পদচারণা ছিলো অত্যন্ত ধীর গতিতে, গ্রামীণ দৃশ্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছিলাম। গ্রামও এবং গ্রামীণ জীবন যাত্রা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এবং সারল্যতায় পরিপূর্ণ। স্রষ্টা শৈল্পিকতায় এ গ্রামটি সাজাতে কার্পণ্যতা করেনি কোনদিক থেকে। এ গ্রাম খানা ছবির মতো। লতাপাতা, ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে ঘুঘু পাখির ডাক, কিচিরমিচির শব্দ। রূপলাবণ্যে অনন্য। যাদের লেখার হাত আছে, যারা প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যেতে চায় তাদের জন্য সঠিক স্থান বলা যায় বানিয়াগ্রাম বা বানিয়া গাঁও। ফেরবার পালা। ফিরতি টিকেটে চট্টগ্রামে যেতে হয়। বিজয় এক্সপ্রেস করে রাত সাড়ে দশটার ট্রেনে চেপে ফিরে আসতে সময়ের ঘড়িতে ছয়টা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক, কলামিস্ট