‘গরু পাচারে’ বিএসএফ’র যোগসাজশ প্রমাণ মিলছে!

17

ভারতের সীমান্ত দিয়ে গরুপাচার চক্রে বিএসএফ কর্মকর্তারা কীভাবে ও কতটা জড়িত ছিলেন, তা নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই -এর তদন্ত ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। ওই পাচার চক্রে বাহিনীর বেশ কয়েকজন পদস্থ প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, কাস্টমস ও পুলিশের একাংশের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। গোটা চক্রটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ-মালদা দিয়ে চালানো হলেও কলকাতায় বিএসএফের কয়েকজন প্রাক্তন কর্তাও জড়িত ছিলেন বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তদন্তকারীরা। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআইয়ের দেশব্যাপী তল্লাশি অভিযান দিয়ে ২৩ সেপ্টেম্বর গরু পাচার চক্রের সঙ্গে বিএসএফ অফিসারদের যোগসাজশের যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, তা থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে।
একদিকে যেমন পাচার চক্রের মাথা বলে পরিচিত এনামুল শেখের বিপুল সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা, অন্যদিকে বিএসএফের যে কমান্ডান্টের বেশ কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে, তারও বিপুল সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে।
২০১৮ সালে কেরালায় বিএসএফের একজন কমান্ডান্ট নগদে প্রায় ৪৭ লক্ষ টাকাসহ ধরা পড়ার পরেই ওই চক্রটির কথা সামনে আসে। তখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এনামুল শেখও। যদিও এখন তিনি জামিনে আছেন। তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন এরা চুনোপুটি। এই গরু পাচার চক্রের পিছনে বিএসএসফ-এর আরও কয়েকজন সিনিয়ার অফিসার জড়িত ছিলেন। এদের কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন, কেউ অন্য নিরাপত্তা বাহিনীতে আছেন। তদন্তকারীরা বলছেন শুধু বিএসএফ নয়, পাচার চক্রে জড়িয়ে ছিলেন কাস্টমস, পুলিশ এবং রাজনৈতিক নেতারাও।
দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং নিরাপত্তাবাহিনীগুলির খবরাখবর দীর্ঘদিন ধরেই রাখছেন দিল্লির প্রবীণ সাংবাদিক চন্দন নন্দী। তিনি বলছিলেন, পাচার চক্রের শিকড় বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএফ কর্মকর্তারা বলছেন, এই পাচার চক্রটা কাজ শুরু করেছিল ২০১৫ সালে। আর ২০১৮ সালে কেরালায় বাহিনীর এক কমান্ডান্ট ধরা পড়ার পরে চক্রটির ব্যাপারে জানা যায়। কিন্তু বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে ২০১৬ সালেই বাহিনীর এক অফিসার বিএসএফের মহাপরিচালককে চিঠি লিখে এই পাচার চক্র সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন। বিএসএফের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা যে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, সেটাও জানিয়েছিলেন তিনি।
ওই চিঠিটিতে লেখা হয়েছিল, ফারাক্কায় অবস্থিত ২০ নম্বর ব্যাটালিয়নের অফিসারদের কলকাতায় দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তের সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে যাতে পাচারকারীদের কথা শুনে চলা হয়। চোরাচালান করতে দিতে নির্দেশ আসছে। আবার বাহিনী সরিয়ে নিয়ে পাচারের কাজে সুবিধা করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তদন্তকারীদের নজরে প্রাক্তন ডিআইজি, কমান্ডান্ট, সেকেন্ড-ইন-কমান্ড- নানা পদমর্যাদার অফিসাররাই আছেন বলে তারা জানাচ্ছেন।
সীমান্তে অবস্থিত অফিসারাও যেমন ছিলেন ওই চক্রে, তেমনই এমন বেশ কয়েকজন জড়িত থাকার কথা জানা যাচ্ছে, যাদের দায়িত্বে ছিল ভিজিল্যান্স, অর্থাৎ কর্মীরা কেউ ঘুষ নিচ্ছেন কি না, তার ওপরে নজর রাখা।
বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল সমীর কুমার মিত্র বলছিলেন পদস্থ কর্মকর্তারা গরু পাচার চক্রে জড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে ওঠে তখন আর সুরক্ষা বলে কিছু থাকে না।
যে তিন বছর পাচার চক্রটি কাজ করেছে, তার মধ্যেই কোনও সিনিয়ার অফিসার প্রায় ২০০ কোটি টাকা, কেউ ৩০০ কোটি টাকা রোজগার করেছেন চক্রের মাধ্যমে- এমনটাই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। তারা কে কোথায় জমি-বাড়ি বা সম্পত্তি কিনেছেন, সেই তথ্যও যোগাড় করেছেন তদন্তকারীরা।
এছাড়াও পাচারের রোজগারের ভাগ নিয়মিত গেছে কাস্টমস, পুলিশের একাংশ আর রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এবং মূলত মুর্শিদাবাদ আর কলকাতা থেকেই চক্রটি কাজ চালাত বলে বিএসএফ-এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এছাড়া গরু প্রতি প্রায় ৪০ হাজার টাকা করে লাভ ঘরে তুলত পাচারচক্র। যে প্রাথমিক হিসাব তদন্তকারীরা করেছেন, তাতে শুধু দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চল দিয়েই প্রতিরাতে ১৩-১৪ কোটি টাকা মূল্যের গরু পাচার চলত বছর তিনেক ধরে।
ঘটনাচক্রে ২০১৮ সালে একজন কমান্ডান্ট এবং পাচার চক্রের মাথা ধরা পড়ার পরে কয়েকজন অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া হয় আর তারপরেই সীমান্তে গরু পাচার অনেকটা কমে যায়।
সীমান্তে দায়িত্বে বিএসএফ আছে ঠিকই, কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি কর্মচারী নন এমন ব্যক্তিদের নামও হয়ত তদন্তে উঠে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।