কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হলো রুদ্ধদ্বার বৈঠক

15

বান্দরবান প্রতিনিধি

বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে গত ২৪ এপ্রিল ম্রো ও ত্রিপুরা দুই জনগোষ্ঠীর তিনটি পাড়ার প্রায় ৪০০ একর জুম ভূমি পুড়িয়ে দেয়া হয়। অভিযোগ উঠে, ইজারা নেয়া হয়েছে দাবি করে জমিতে আগুন দেয় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের প্রতিষ্ঠান। ওই ঘটনার সাড়ে তিন মাস পর গত মঙ্গলবার বান্দরবান জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে রুদ্ধদ্বার মতবিনিমিয় সভার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় এ সভা।
সভার ব্যানারে লেখা ছিল ‘লামা উপজেলার ৩০৩ নং ডলুছড়ি মৌজার লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পাড়াবাসীর মধ্যে জমির দখল নিয়ে অসন্তোষ ও দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা’। সভাপতিত্ব করেন পাবর্ত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।
সভায় ভুক্তভোগী লাংকমপাড়া, রেংয়ানপাড়া ও জয়চন্দ্রপাড়ার ২৬ জন নারী-পুরুষ এবং লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৩টার দিকে সভা শেষ হয়। সভা চলাকালীন সময় দুপুর ১টার পর নয় উপজাতি নারী-পুরুষ সভাস্থল থেকে বের হয়ে আসেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মুল বক্তা জয়চন্দ্র কারবারিকে বক্তব্য শুরু করার পরপরই থামিয়ে দেয়া হয়। তিন পাড়াবাসীর মধ্যে তিনিই সব চেয়ে ভালো বাংলা বলতে পারেন। তাকে বলতে না দেয়ায় আমাদের সমস্যার কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারি নাই। পরে তিন পাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে পাঁচ একর করে জুম ভূমি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য দুই একর ও শ্মশানের জন্য দুই একর ভূমি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। আমরা এ প্রস্তাব মানি না।
পাড়াবাসীরা আরো বলছেন, এক হাজার ছয়শত একর লিজের কথা বলে এ পর্যন্ত তিন হাজার একর বেশি দখল করে বাগান করেছে লামা রাবার কোম্পানি। সভায় আমাদের মুল দাবি হলো, আগে তাদের বাগানে মাপ নেয়া হোক। তাহলে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। তারা বলেন, ২০১৬ সালে এসে ডলুছড়ি মৌজার লাংকমপাড়া, রেংয়ানপাড়া ও জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়াবাসীর প্রায় ৪০০ একর প্রথাগত জুম ভূমিকে লামা রাবার কোম্পানির লিজের জমি দাবি করে জবরদখলের উদ্দেশ্যে কোম্পানির প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কামাল উদ্দিন পাড়াবাসীদের নানা ভয় ভীতি-হুমকি ও মিথ্যা মামলা দিয়ে নানাবিধ অপচেষ্টা করে আসছিল। সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে ১৫-২০ জন লোক তিন পাড়াবাসীর প্রথাগত জুম ভূমির প্রায় ৪০০ একর ভূমি পুড়িয়ে দেয়।
একইসঙ্গে তিন পাড়াবাসীর কবরস্থানসহ জুম ভূমিতে সৃজিত ফলজ বাগান, বনজ গাছ, বাঁশ সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। বুনো মুরগি, সাপ, কাঁকড়া, নানা প্রজাতির পাখির ছানা, মুরগি ও পাখির ডিম, ছোট-বড় নানা প্রজাতির অগণিত বণ্যপ্রাণীরও মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর তিন পাড়ার মানুষ ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়ে। এসব বিষয় সভায় ঠিক মতো স্থান পায়নি, আলোচনা হয়নি- উল্লেখ করেন তারা।
এ ছাড়া গত ১০ আগস্ট লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লোকজন রেংয়ানপাড়ায় একটি বৌদ্ধবিহার ভাঙচুর করে। বিষয়টি সভায় উত্থাপন করা হলে লামা রাবারের উপস্থিত লোকজন মাথা নিচু করে রাখে বলে জানান পাড়াবাসী।
এ দিকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের হয়ে বক্তব্য রাখায় সভায় এক কারবারির বক্তব্য থামিয়ে দেয়া হয়। এককভাবে বাগান সৃজন করতে না পারায় ৬৪টি জন শেয়ারহোল্ডার নিয়ে কোম্পানি করা হয়েছে। এ জন্য লিজের সব ভূমিতে বাগান সৃজন করতে দেরি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
একাধিক সুত্রে জানা গেছে, জুম ভূমি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনার পর বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসন পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি করে। তদন্ত কমিটি পৃথকভাবে তদন্ত প্রতিবেদনও যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দিয়েছে। এর মধ্যে জেলা পরিষদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শর্তানুযায়ী লিজ পাওয়ার দশ বছরের মধ্যে সুনির্দিষ্ট বাগান সৃজনে ব্যর্থ হলে কিংবা লিজ চুক্তির যে কোনো শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিজ বাতিল হয়ে যাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিন পাড়ার জুম ভূমিকে লিজের অংশ বলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দাবি অযৌক্তিক।
সভা শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর ঊশৈসিং সাংবাদিকদের বলেন, উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনেছি। পাড়াবাসীদের বক্তব্য অস্পষ্ট। পাড়াবাসীদের চিন্তা করার জন্য সময় দিয়েছি। এ জন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। পরবর্তী সভায় সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিবেচনা করবো।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজী, পুলিশ সুপার জেরিন আখতার প্রমুখ।