কর্ণফুলীর ৪ ইউনিয়নে এবার সম্ভাব্য ৪ বিদ্রোহী প্রার্থী

103

আবেদ আমিরী, কর্ণফুলী

কর্ণফুলী উপজেলায় ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন ৫ জন। এর মধ্যে শিকলবাহা ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, জুলধা ইউনিয়নে রফিক আহমদ, চরলক্ষ্যা ইউনিয়নে নাজিম উদ্দিন হায়দার, বড়উঠান ইউনিয়নে আবদুল মন্নান খান ও মোহাম্মদ শাহজাহান। গতবারের মত এবারো শিকলবাহা, জুলধা, চরলক্ষ্যা ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ৪ জন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন না পেলে দলের সাথে বিদ্রোহ করে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। স্ব স্ব এলাকায় এসব প্রার্থীরা দল থেকে মনোনয়ন দিক বা না দিক তারা নির্বাচনের মাঠে থাকবেন এমন ঘোষণা দিয়ে এলাকা চষে বেড়ানোয় এ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, ২০১৬ সালে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করার দায়ে সে সময় দল থেকে ৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে দলের মধ্যে তাদের ৩ জনের রাজনৈতিক পদে পদোন্নতি হয়।
এ কারণে তৃণমূল কর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, বিদ্রোহ করে নির্বাচিতরা দলের কোন কাজে আসেনি। এ সকল প্রার্থীদের দলীয় পদোন্নতি বাতিল ও মনোনয়ন না দেয়ার আহবান জানান তৃণমূলের কর্মীরা। অন্যদিকে আইনি জটিলতার কারণে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে মেয়াদ পূর্তি না হওয়ায় এবছর নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৬ সালে নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নেয়া বিদ্রোহী প্রার্থীরা দলের মাঝে বিভাজন তৈরি করে আলাদা একটি বলয় তৈরি করেন। এরপর কেউ কেউ নির্বাচিত হওয়ার পর দলের বাইরে একেবারে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করে এলাকা ভিত্তিক নানাবিধ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন। গত ৫ বছরে তাদের বলয়ে থাকা কর্মীদের দলীয় কর্মকান্ডে সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যায় নি। দলের টিকেটে নির্বাচিত না হওয়ায় দল ও দলেল কর্মীদের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিলো না তাদের। এর ফলে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে ইউনিয়ন পরিষদ ও এলাকায় নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন কয়েকজন চেয়ারম্যান।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, জুলধা ইউনিয়নে সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল হক আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে ২০১৬ সালে নির্বাচনে অংশ নেন। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান রফিক আহমদ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় পান।
স্থানীয় অনুসন্ধানে জানা যায়, রফিক আহমদ জাতীয় পার্টির আমলে দলীয়ভাবে প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ১৯৯২ সালে দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
উপজেলার প্রবীণ ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এন ইসলাম জানান, পরবর্তীতে ২০০০ সালে কুসুমপুরা স্কুল মাঠে এক জনসভায় রফিক আহমদ তারই মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে পুনরায় বিএনপিতে যোগ দিয়ে ২০০২ সালে আবারও বিএনপির দলীয় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি কার মাধ্যমে এবং কিভাবে আওয়ামী লীগে আবার যোগদেন তা তিনি জানেন না উল্লেখ করে বলেন, ২০১৬ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি বর্তমান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে বিএনপির সমর্থক আর আওয়ামী লীগের একাংশের ভোটে তাকে জয় এনে দেয়।
স্থানীয়রা জানান, আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দিলেও তিনি মাঠ ছাড়বেন না বলে জানিয়ে দিচ্ছেন প্রতিটি পাড়া মহল্লায়।
এ বিষয়ে জুলধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহমদ বলেন, যে কোন মূল্যে আসন্ন ইউপি নির্বাচনে অংশ নেবেন।
সরেজমিন শিকলবাহা ইউনিয়ন ঘুরে জানা যায়, বর্তমান চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এস আলম স্টিল মিলে কর্মরত অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রথম ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর জড়িয়ে পড়েন নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে। অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে দলীয় প্রার্থী আবুল কালাম বকুলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নেন। সে সময় তাকে দলের একটি অংশ জোরালো সমর্থন দেয়ায় নির্বাচনে জয়লাভ করেন। পরবর্তীতে নানা বিতর্কিত কর্মকাÐের ফলে দলের নেতাকর্মীরা তাকে ছেড়ে যায়। কিন্তু তার নিজস্ব একটি বলয় মাঠে রয়েছে। আসন্ন ইউপি নির্বাচনে তাকে দল থেকে মনোনয়ন দিক আর না দিক তিনি নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত জানিয়ে আগাম প্রচার করছেন প্রতিটি এলাকায়।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম চেয়ারম্যান বলেন, দল থেকে মনোনয়ন চাইব। গত ২০১৬ সালে আমি দল থেকে ফরম নেইনি এবং মনোনয়নও চাইনি। কিন্তু চেয়ারম্যান হয়েছি। এবারও দলীয় মনোনয়ন না পেলে সময় বলে দেবে কি করব।
শিকলবাহা ইউনিয়নে দল থেকে আরো যারা দলীয় মনোনয়ন চান তাদের মধ্যে প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা বিকম সিদ্দিক, উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান দিদারুল ইসলাম চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল করিম ফোরকান, প্রয়াত চেয়ারম্যান আবুল কালাম বকুলের পুত্র সাহাদাৎ হোসেন রানার নাম জানা গেছে।
চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী দলীয় মনোনয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে নির্বাচনের আগে ও পরে কখনো তাকে দলীয় কর্মসূচিতে দেখা যায় নি। তিনি কোন দল করেন বা আওয়ামী লীগ করেন কিনা তা নিয়েও অনেকের মাঝে প্রশ্ন দেখা যায়। গত নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনে অংশ নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ওই ইউনিয়নে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নাজিম উদ্দিন হায়দার।
এ বিষয়ে নাজিম উদ্দিন হায়দার বলেন, দলীয় মনোনয়ন পেয়ে চেয়ারম্যান হলেও বর্তমান চেয়ারম্যান কখনো আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাকে মনোনয়ন দেয়ায় নিরব প্রতিবাদ স্বরুপ নির্বাচনে প্রতীকী প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। তাতে তিনি কোন প্রচার প্রচারণা এমনকি পোস্টার পর্যন্ত ছাপান নি। নির্বাচনে তিনি নিজের ভোটটি প্রর্যন্ত প্রদান করেন নি। এবার তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন বলে জানান।
এ বিষয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, আসন্ন নির্বাচনে তার নেতাকর্মীরা দলের কাছ থেকে মনোনয়ন চাইলে চাইতে পারেন। দল থেকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করবেন। দল যদি মনোনয়ন না দেয় সে ক্ষেত্রে কি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নেতাকর্মী ও তার সমর্থকরা যদি তার নামে নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচনের ফরম কিনে নিয়ে আসেন এবং নিজেদের দায়িত্বে ফরম জমা দেন সেক্ষেত্রে তিনি নির্বাচন করবেন।
চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের উপজেলা যুবলীগের বর্তমান সভাপতি সোলাইমান তালুকদারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
বড়উঠান ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান দিদারুল আলম আবারো নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত নির্বাচনে নির্বাচনে সহিংসতায় বড়উঠান ইউনিয়নে একজন ইউপি সদস্য প্রার্থীসহ দুইজন নিহত হয়েছিলেন। গত ২০১৬ সালে নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবদুল মন্নান খান ও মোহাম্মদ শাহজাহান দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তারা এখনো দলে থাকলেও এবার নির্বাচনে মনোনয়ন চান না বলে জানা গেছে। তবে বড়উঠান ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রফিক উল্লাহ এবার দলীয় মনোনয়ন দাবি করেন।
চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ছাবের আহমদ ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার ওই ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ছাবের আহমদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার ইসলাম আহমদ, উপজেলা সেচ্ছ¡াসেবকলীগের সভাপতি শাহেদুর রহমান শাহেদ ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম হক, নুর মোহাম্মদ ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ আহমদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার ইসলাম আহমদ জানান, সেলিম হক বর্তমানে উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদটিও তার জন্য বেশি হয়ে গেছে। তিনি জানান, সেলিম হক কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। গত ২০০৭ সালে তার আকুতির কারণে তাকে প্রথম শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের সদস্য ও পরে সভাপতি করা হয়। এরপর তাকে দলের অন্যান্য নেতাকর্মীদের সাথে যুক্ত করে সর্বশেষ ২০১৭ সালে উপজেলা যুবলীগের তার কৌটায় সেলিম হককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কিন্তু তার হাত ধরে যুবলীগ আর এগুতে পারেনি। এরপর সেলিম হক বিতর্কিতদের প্রতিষ্ঠিত করে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দিদারুল ইসলাম জানান, ২০০১ সাল থেকে আহবায়ক ও সভাপতি মিলিয়ে তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর উপজেলা যুবলীগের দায়িত্বে ছিলেন। ওই সময়ে তিনি কখনো সেলিম হককে দলের কোন কর্মকান্ড বা সদস্য হতে দেখেন নি। ২০১৭ সালে তিনি কিভাবে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়েছেন তাও তার বোধগম্য নয়।
ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ছাবের আহমদ জানান, তিনি নৌকা প্রতীক পেয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান হয়েছেন। আবারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন জানিয়ে বলেন, তবে আইনি জটিলতার কারণে আগামী এক বছরের আগে এ ইউনিয়নে নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। কারণ মামলার কারণে তিনি প্রায় ৯ মাস বিলম্বে ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর শপথ নেন এবং ২০ ডিসেম্বর প্রথম সভা করেন। সে হিসেবে এখনো মেয়াদ পূর্ণ হয়নি পরিষদের।
উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম হক জানান, তিনি ২০০৭ সালে নয় ২০০০ সালে প্রথমে শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ ও পরে যুবলীগে যুক্ত হন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী জানান, গতবার ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন আর বিদ্রোহী প্রার্থীর সংজ্ঞা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। সে সময় তৃণমূলের মনোনয়ন প্রাপ্তদের তালিকা জেলা আওয়ামী লীগের কাছে না দিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে দেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়। এ বিষয়টি কিভাবে উত্তরণ করা যায় আমরা সে বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।