কর্ণফুলীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়

22

 

কর্ণফুলী নদীকে বলা হয় চট্টগ্রামের প্রাণ। কিন্তু অব্যাহতভাবে অবৈধ দখল-দূষণে এই নদীর প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। ঐতিহাসিক এ নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে উদ্বেগজনকভাবে। যা নদীকে করছে দূষণ ও সঙ্কোচিত। বিপর্যস্ত হচ্ছে চট্টগ্রামের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। শহর চট্টগ্রামে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে যে দুঃসহনীয় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, এর জন্য কর্ণফুলী ও সংযোগ খালগুলোর অবৈধ দখল ও ভরাটই বহুলাংশে দায়ী। এ দায় থেকে মুক্তি এবং কর্ণফুলীর তীরজুড়ে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিয়েও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ ও দখলমুক্ত করতে পারে নি। সর্বশেষ উচ্চ আদালতে নির্দেশনার দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন ঢাকঢোল বাজিয়ে উচ্ছেদ অভিযানে নামলেও রহস্যজনক কারণে অল্পতেই থেমে যায় অভিযান। এরপর ‘যে লাউ সেই কদু’। দখলমুক্ত জায়গা আবারও দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে, আবারও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এবং নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কর্ণফুলী নদী রক্ষার দাবিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। এরপর কমিশন এ নদী শাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট চার সংস্থার কাছে দ্রুত প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। গত মঙ্গলবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক সচিত্র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কমিশন ১৫ দিনের মধ্যে কর্ণফুলী মোহনাসহ নদীর তীরের অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক প্রতিবেদন দিতে বলেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়ে এ প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, সিএস ম্যাপ অনুসারে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনাসহ নদী তীরের অবৈধ দখল উচ্ছেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক প্রতিবেদন কমিশনে প্রেরণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করার কথাও বলা হয়।
উল্লেখ্য যে, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা ২ হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় দিয়ে আদেশ জারি করে। কিন্তু অর্থ সংকটের অজুহাতে যথাসময়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা যায়নি। পরে ভূমিমন্ত্রীর সহযোগিতায় জেলা প্রশাসন ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রæয়ারি কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করে। টানা পাঁচদিনের অভিযানে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ ও ১০ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়। উচ্ছেদ অভিযানের ফলে অবমুক্ত হয় পাঁচটি খালের মুখ। নদীর তীরে গড়ে উঠা লবণ মিলগুলো গুঁিড়য়ে দেয়া হয়। বন্দর এলাকা থেকে শুরু করে বারিক বিল্ডিং মোড়-গোসাইলডাঙ্গা-সদরঘাট-মাঝিরঘাট-শাহ আমানত সেতু হয়ে মোহরা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার নদীর তীর জঞ্জালমুক্ত করা হয়। পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষও অভিযান চালায়। এমনকি করোনা সংক্রমণের মধ্যেও বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়ার চরসহ আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে। কথা ছিল দখলমুক্ত জায়গায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সীমানা প্রাচীর নির্মাণসহ বনায়নের উদ্যোগ নেবে। নদী আর খালগুলো সম্প্রসারণ করবে। কিন্তু অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানের দেড় বছরেও কর্তৃপক্ষগুলোর নিরব ভ‚মিকা নদী ও খাল দখলদাররা সুযোগ গ্রহণ করে।
জেলা প্রশাসন আগে বলেছিল, অর্থ সংকটের কারণে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান করা যাচ্ছেনা, তাই অভিযান বন্ধ রেখেছে যা মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিছুদিন অভিযানের পর একই কারণে অভিযান বন্ধ হল, নাকি কোন রাঘব বোয়ালের ধমকি-হুমকিতে বন্ধ হল, তা জানার সুযোগ না পেলেও নদীর তীরে অবৈধ বাস-ট্রাক টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের উৎসব দেখে সম্যক ধারণা করা যায়, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। অবৈধ দখলের কারণে কর্ণফুলী নদীর আয়তন, গভীরতা ও পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেযেছে মারাত্মকভাবে। এর সাথে সরাসরি যুক্ত নগরীর ২২টি খাল ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় প্রতি বর্ষায় চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা লেগেই আছে।
সুতরাং অবৈধ দখল উচ্ছেদের পর নদীর তীর যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে উচ্ছেদ অভিযান টেকসই হতে পারে। এ ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হওয়া জরুরি।