কমে গেছে মানুষের সঞ্চয়

15

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে সীমিত আয়ের মানুষেরা। তাই খরচ বাড়লে সঞ্চয়ে টান পড়ে। আর বাড়তি বা বিকল্প আয়ের উৎসগুলো সংকুচিত হলে বিপদ আরও বাড়ে। সরকারি হিসাবে দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে জাতীয় মজুরির হার এখন কম। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে মানুষের নিট বিনিয়োগও অর্ধেক হয়ে গেছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সংসারের খরচ সামলান অনেকেই। আবার শেয়ারবাজারের পতন হচ্ছে দিন দিন। ফলে বিনিয়োগকারীরা আছেন লোকসানে। এদিকে ব্যাংক খাতে আমানতও সেভাবে বাড়ছে না। এ শ্রেণিকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনো উপায় সরকারের তরফ থেকে নেওয়া হচ্ছে না।
সব মিলিয়েই করোনার সময় থেকেই মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। আর এ অবস্থা শুধু ব্যক্তিপর্যায়ের নয়, জাতীয়ভাবেও একই সমস্যা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘সারা বিশ্বের মানুষই যেমন কষ্টে আছে, আমরাও আছি। আমাদের কষ্টটা সাময়িক। আশার কথা যে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেলসহ সব খাদ্যপণ্যের দামই কমতির দিকে।’
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা।
ছয় মাসের চিত্র বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয় ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার। জুন মাসে মূল জমা হয় ১০ হাজার ৭১২ কোটি টাকার, আর মুনাফা পরিশোধ হয় ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার। অর্থাৎ জুনে যারা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আর নতুন করে বিনিয়োগ করেননি। সে হিসাবে জুনে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ছয় মাস আগের সময়কে ভিত্তি ধরলে জুনে কম বিক্রি ৮৩৬ কোটি টাকা।
তার এক মাস আগে অর্থাৎ মে মাসে মোট জমা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এ সময়ে মূল অর্থ ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৭ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে ওই মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩৮ কোটি টাকা। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় ব্যাংক খাতে আমানতও সেভাবে বাড়ছে না। কারণ, ব্যাংকে আমানত রেখে যে সুদ মিলছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মে মাস শেষে ব্যাংক খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা, এপ্রিলে যা ছিল ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। আপাতদৃষ্টে আমানত বাড়ছে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেভাবে বাড়ছে না। কারণ, আমানতের সুদ যুক্ত হচ্ছে এতে। ব্যাংকগুলোর আমানতে যে টান পড়েছে, কয়েকটি ব্যাংকের চিত্র দেখলেই তা বোঝা যায়। যেমন ২০২১ সালের শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। গত ২৬ জুলাই তা কমে হয়েছে ৯৭ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
একই সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের আমানতও ছিল ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। গত জুলাই শেষে তা ৯৪ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। একই অবস্থা সোনালী ও রূপালী ব্যাংকেরও। বেসরকারি ব্যাংকের অবস্থাও প্রায়ই একই।
কারণ হিসেবে সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সুদ কম হওয়ায় নতুন আমানত মিলছে না। আবার প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। এ জন্য আমানত কমছে। গত ফেব্রæয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা দেয়। ওই যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজার ও দেশের বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ডলার-সংকট দেখা দিলে তাতে বাজারে পতন আরও ঘনীভূত হয়। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) শেয়ার ব্যবসা করা একজন বিনিয়োগকারী বলেন, গত নভেম্বরের পর থেকে ধ্বংস হয়ে গেছি।