কবি ওমর কায়সার : দ্বান্দ্বিক জীবনে সত্যের সন্ধানী

366

সৃজনশীল কলারাজ্যে কবিতা শ্রেষ্ঠ শিল্প। স্থাপত্যশিল্প, চারুশিল্প, কারুশিল্প, এমনকি সাহিত্যশিল্পের মধ্যেও কবিতা কঠিন কলা। এ কঠিনেরে ভালোবাসার জন্যে মৌলিক সৃজনশীল যোগ্যতা থাকতে হয়। প্রকৃতি লব্ধ জ্ঞান এবং অলৌকিক প্রজ্ঞা ছাড়া মৌলিক কবিতা লিখা সম্ভব নয়। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন সবাই যা লিখতে পারে এবং যে কেউ সহজেই বুঝতে পারে তাতে কবিত্বের শক্তি নেই। নিরক্ষর মানুষও অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করতে পারে। আবার বড় বড় সার্টিফিকেটধারী মুর্খরাও অনেক নিরক্ষর পÐিতের শিষ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। কবিতা কি এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে কথাকে কবিতা করার জন্য কবিরা নতুনের সন্ধানী। অতি পরিচিত কথাকে যারা নতুন করে, নতুন মূল্যমানে বিচিত্র ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ করে বলতে পারেন, তারা কালের অতীত, শাশ্বত মূল্যমানে অমরত্ব লাভ করেন। কবি চÐীদাসের পংক্তিঃ ‘আমার বধূয়া আন বাড়ি যায়/আমারি আঙ্গিনা দিয়া’। সহজ, সরল, অলঙ্কারের ভার মুক্ত এ পংক্তি যুগে যুগে নতুন কথা হিসেবে মূল্যায়ন পায়। এ জন্যে দুর্বোধ্য শব্দের লকেট তৈরির মধ্যে কবিত্ব আছে তা শতভাগ সত্য নয়। কিন্তু কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ওজস্বী ভাষায় বাংলা কাব্যকে নতুন মাত্র দান করেছেন। তার ভাষার আভিজাত্য কবিতাকে সাধারণের দূর্বোধ্য করেছে কিন্তু দুরূহ করেনি। উন্নত খাবারের জন্য পকেটের শক্তি প্রয়োজন, প্রকৃত কবিতা বোঝার জন্য উন্নত বোধ শক্তি জরুরি। প্রকৃত অর্থে কবিতা ডাল-ভাত নয়। রুচিশীল পাঠকের আরাধ্যশিল্প কবিতা। আমার বধূয়া আন বাড়ি যায়…এ পংক্তিতে বাচ্যার্থের চেয়ে ব্যাঙ্গার্থের শক্তি অনেক গুণ বেশি তাই কবি চন্ডীদাসের সহজ কথা ও শাশ্বত কবিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবিতায় যখন বলেন :-
‘সে-শুদ্ধ, চৈতন্য, হায়, বৃথা তর্কে আজি দিশাহারা,
বন্ধ্যা স্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ সে-গাঢ় চুম্বন;
ভ্রাম্যমাণ আলেয়ারে ভেবেছিল বুঝি ধ্রæবতারা,
অক‚ল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন’
সুধীন দত্ত ভাষাকে অভিজাত করে প্রকাশ করলেও তাঁর কবিতা রসময়, পরিশ্রমি পাঠকের জন্য এক অসাধারণ প্রশান্তির। হৃদয়ের মৌল সত্য আবিস্কারে সুধীন দত্তের বৈদগ্ধ্যের অন্তরালে টানটান বাক্যবন্ধ হৃদয়কে শাশ্বত বোধে ভরিয়ে দেয়। জীবনান্দ দাশের ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ সাদামাটা প্রশ্নের মধ্যে প্রিয়তমার হৃদয়ের সমগ্র তলদেশ ভেসে ওঠে। আসলে কবিতা সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্ব আরোপের মুন্সিয়ানা।
ওমর কায়সার চট্টগ্রাম তথা দেশের প্রেক্ষাপটে একজন উল্লেখযোগ্য কবি। কর্মজীবনে তিনি একজন সাংবাদিক। পত্রিকায় চাকুরীর সুবাদে অনেকেই প্রচারের সুযোগ পেয়ে প্রচার সর্বস্ব কবি হয়ে উঠেছেন। ওমর কায়সার সে শ্রেণির নন। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণকারী এ কবি বাংলা সাহিত্যের এম এ। সাহিত্যে লেখাপড়া লোকের অভাব এ যুগে না থাকলেও সাহিত্য পড়ে সাহিত্যিক হয়ে ওঠার ঘটনা খুব বেশি চোখে পড়ে না। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের শিক্ষক হলেও সাহিত্যে কোন অবদান নেই এরকম লোকের সংখ্যা বর্তমানে বেশি চোখে পড়ে। আর অনেক বড় বড় পÐিতও জীবনে একলাইন স্বার্থক কবিতা লিখতে পারেননি এমন পÐিতের সংখ্যা সাহিত্যে বেশি। কাব্যবোধকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘অলৌকিক আনন্দের ভার’। যার প্রাণ অহোরাত্র এক অলৌকিক শিখায় দগ্ধ হতে থাকে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গীতি কবিতার জনক বিহারী লাল চক্রবর্তী বলেন-
‘সর্বদা হু হু করে মন
বিশ্ব যেন মরার মতন,
চারিদিকে ঝালাপালা
ওহ! কী দূরন্ত জ্বালা
অগ্নিকুÐে পুঙ্গ পুন,’
এমন অগ্নিকুÐে পতঙ্গ পতনের মতো একটি বেদনাবোধ ওমর কায়সারের হৃদয়কে সর্বদা ব্যস্ত করে রাখে। ধ্যানমগ্ন একজন কবি সবসময় ওমর কায়সারের হৃদয়ে বসবাস করে। বিষয়, বোধ ও শব্দে-ছন্দে তিনি নিজস্ব বিশিষ্টতায় ভাস্বর। চট্টগ্রাম শহর তথা এদেশের প্রেক্ষাপটে তার স্বাতন্ত্র ও প্রতিভার দ্যুতি প্রশ্নাতীত। চিন্তায় চেতনায় অনেকের সাথে হয়তো তার মিল থাকবে না। কিন্তু তার কবিতায় সর্বহৃদয় গামীতা প্রখর। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ’ নিয়ে বাংলা কাব্যে তার রাজকীয় যাত্রা শুরু, এরপর ‘প্রতিমা বিজ্ঞান’, ‘বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়’ এবং ‘প্রাচীন প্রার্থনাগুলো’ এ চারটি কাব্যগ্রন্থে তার প্রতিভার বিস্তার। চারটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে আমরা কবির জাত চিন্ততে পেরেছি। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও তার স্বাচ্ছন্দ বিচরণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা তিনি কবি। তার কবিতায় প্রেম, যৌনতা, দেশকাল, ইতিহাস, মিথ, গ্রামীণজীবন ইত্যাদি বিষয় অসাধারণ হৃদয়গ্রাহী হয়ে ফুটে উঠেছে।
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলচলে কবি এক ধরনের প্রাগৈতিহাসিক দু:খ অন্তরে পোষণ করেন। কবির কাছে বিষয়টাকে মেঘ-রোদের লুকুচুরি খেলা মনে হয়। মনের দ্বিধাদ্ব›েদ্বর সাথে চোখের দেখার মধ্যেও এক ধরনের ধোঁয়াশা জীবনের মৌলসত্য হিসেবে ধরা পড়ে। কবি বলেন:
‘এক চোখে ধরে আছো উদাসীন মেঘ
অন্য চোখে রোদে রোদে ভোরের আবেগ
কোন চোখে ফুটে উঠে তোমার হৃদয়?’
আনন্দের সাথে মলিনতাও বর্তমান। দুঃখের পর সুখ এবং সুখের পরে দুঃখ থাকবেই। দু’টো নিয়েই জীবন। কবি বলেন : ‘এক হাতে ধরে আছো মেহেদীর রঙে নিটোল বিশ্বাস
অন্য হাতে অবিশ্বাস মলিন কালিমা’(প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ)
এ দ্বৈত অবস্থান কোনটা নিজের, কোনটা স্থায়ী তা-ই কবির প্রশ্ন। জীবনের সবপথ এভাবে অস্পষ্ট এক সত্য নিয়ে অতিবাহিত হয়। কবি যাকে বলেন ‘প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ’। মানব হৃদয়ের ‘রতি’ নামক স্থায়ী ভাবের পাশাপাশি ‘শোক’ও অবস্থান করে তার স্থায়ীত্ব নিয়ে। যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তি মানবজাতির হৃদয় কন্দরে সহ অবস্থান করে। পরিবেশ ভেদে তা প্রকাশ পায়। কবির বাউল মনকে সবসময় দ্বা›িদ্বক ‘প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ’ ‘শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলেও তার স্থায়ী রূপ স্পর্শাতীত। কবির জীবনবোধের একটা দ্বা›িদ্বক মতবাদ তার কবিতায় জীবনের রহস্য আবিষ্কারে উন্মুখ।
কারো কারো কন্ঠের গরিমা অন্তর ছুঁয়ে যায়। লিলি গাংগুলি পাখি নয়’ শীর্ষক কবিতায় কবি ওমর কায়সার বনের পাখি আর মনের পাখির অস্তিত্বের পার্থক্য সন্ধান করেন। প্রসঙ্গক্রমে কবি বলেন:
‘লিলি গাংগুলি পাখি নয়
পাখিদের পালক থাকে
লিলির শরীর ছিল পালকের মতো নরম
চিন্তায় চর্চায় যতœ দিয়ে গড়া’ (লিলি গাংগুলি পাখি নয়)।
কবি সাময়িক যাপনসাথী হিসেবে লিলি গাংগুলিকে পেয়েছিলেন। কবি জানেন লিলি পাখি নয়। কিন্তু বনের পাখির গান আমরা শোনার পর তা পরে আর মনে রাখি না। কিন্তু লিলিরও মুক্ত পাখি। এক্ষেত্রে সে মৌসুমকে ধারণ করলেও বনের পাখির মৌসুমী গান গর মৌসুমে শোনা যায় না, অথচ লিলি গাংগুলির গান কবি মনের সোনার পিঞ্জরে ‘মধ্যরাতে উদাস দুপুরে/ডানা ঝাপটায়/শুধু ডানা ঝাপটায়/’মানব মনে ক্ষণিকের কেউ কেউ চিরকালীন হয়ে বিরাজে। লিলি গাংগুলির কন্ঠের গরিমা এভাবে কবির হৃদয়ে একটি স্থায়ী প্রাগৈতিহাসিক সুর তোলে, বুকের পিঞ্জরে ফুড়ৎ ফুড়–ৎ করে উড়তে বার বার ডানা ঝাপটায়। ‘অচর্তা রহস্য’ কবিতায় অচর্তা কবির মানসপ্রিয়া।
‘চাঁদ লক্ষ টুকরো হয়ে ভাসছে জলের শরীরে
অচর্তা চাঁদ হলে আমি তার প্রতি অংশে প্রভেদ পেতাম।’
কবির কাছে মানসপ্রিয় অচর্তা চাঁদের চেয়ে বেশি কিছু। অর্চণা কবির কাছে গলায় বিধা টেংরা মাছের কাটার মতো। যাকে গেলাও যায় না, ফেলাও যায় না-এমন অবস্থা। কবি বলেন :
‘আস্ত একটা বদমাশ অর্চণা
আমি অর্চনাকে ভালবাসতে চাই-কিন্তু পারি না
অর্চনা ভীষণ বদমেজাজী
আমি তাকে ভালো নাও বাসতে চাই-কিন্তু পারি না।’
অবচেতনের দ্বিধা থরো-থরো টানাপোড়েন ছাড়া কি কবি হওয়া যায়? ওমর কায়সারের কবিতায় বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারত বর্ষের ঐতিহ্য ঘুরে ফিরে এসেছে। প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ আমাদের সাংস্কৃতিক মূল্যমানে জড়িয়ে মড়িয়ে আছে। যা কবির কবিতায় চমৎকার কাব্যিক কথনে উঠে এসেছে। প্রাতিমা বিজ্ঞানের প্রতিমা, পূজারীর কাছে যাই হোক, কবির কাছে প্রিয়তমা হয়ে ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়- কবি ‘দেবতারে প্রিয়া > ৪র্থ পৃষ্ঠায় দেখুন
> ৩য় পৃষ্ঠার পর
করেন, প্রিয়ারে দেবতা।’
ওমর কায়সার বলেন:
‘তুমি তো সুভদ্রা ছিলে, আর আমি প্রথম নৃপতি
প্রতেœর খনন শেষে পেয়ে গেছি তোমাকে, আমাকে।’-
-(প্রতিমা বিজ্ঞান)
এজন্যে কবিকে প্রবারণার ঊর্ধ্বগামী মলিন ফানুস বলে যায় ‘তুমিও আমার মতো যাযাবর মেঘের সারথী :/বলে গেল/তুমি আমি প্রগৈতিহাসিক সন্ধ্যাতারা, আমরা সবাই একা/হাজার বছর ধরে একা।’ মানব সত্ত¡ার একাকিত্বই কবির কাব্যবোধকে শানিত করে। মানব জীবন ফানুষের মতো-‘কিছু দূর উড়ে যায়, তারপর পুড়ে যায়, পড়ে যায়, দীপ্তি হারায়।’ পৃথিবীতে মানুষের আগমনে যেমন একাকিত্ব আছে, তেমনি গমনেও একাকিত্ব অবধারিত। জীবনের খেলা ঘরে শৈশবের বউ বউ খেলা কিংবা মিছা-মিছি সংসারকর্মের মতো সব ফেলে ধীরে জীবন সন্ধ্যায় অন্ধকার কবর কিংবা শ্মশানের ছাই হতে হয়। তাই তীব্রবোধ সম্পন্ন এলহাম আসে কবির অন্তরে, জীবন ও জগতের নশ্বরতাকে অবিনশ্বরতা দানের। এরই নাম কবির বেদনা বিদ্ধ হৃদয়ের অকারণ পুলক। যা লিখনির মাধ্যমে শাশ্বত কাব্যশিল্পে রূপান্তরিত হয়। কবি এবং ওমর কায়সার সেখানে আপন স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। কবি মনের ব্যাপক বাউলিয়াপনা ধরা পড়েছে তার ‘বাস্তুসাপ ও পালিয়ে বেড়ায়’ কাব্যগ্রন্থের ‘বাউল’ কবিতায়-
‘তবু দেখি অন্ধ এক বাউল ঘুমন্ত নদীটির তীরে দূর দিগন্তে ডাক দেয়।
স্বপ্নহীন চোখে সে তো দেখেনি নীরব ক্ষমাহীন আগুনে সূর্যরা জ্বলে যায়।
অবাধ কন্ঠের সুর আঙিনায় বেদনার ঘোর-মোহপানে।
এখনে কখনো কি একবার আনন্দিত সন্ধ্যা নেমেছিল?
ডেকেছিল ভোর উচ্ছ¡াসিত ডানার আমেজে?
তবু গান হয় বাউলের-
ঘুমন্ত শঙ্খের তীরে
অজাত ভোরের আর্তনাদে, যেখানে মানুষ পোড়ে
আর সভ্যতার ধুলোভস্ম ওড়ে।’- (বাউল-বাস্তসাপও পালিয়ে বেড়ায়)
আমরা জানি- কবি, বাউল, আধ্যাত্মিকতায় মগ্নরা খুব খুব অনুভব করে মাটি হয়ে যাওয়া কিংবা ভস্মতার অমোঘ বিজ্ঞান।
‘প্রাচীন প্রার্থনাগুলো’ কবি ওমর কায়সারের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। নাম কবিতাটি মাত্র পাঁচল পক্তির গদ্য কবিতা। এতে ধরা পড়েছে মানুষের আধ্যাত্মিক বোধ ও জৈবিক চাহিদার চিরদ্ব›দ্ব। ভোগ মানুষের অপরিহার্য বিষয়। ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যভোগ, তো সম্ভোগে তৃপ্ত নয়। প্রার্থনা সম্ভোগ কিংবা ত্যাগের উদাহারণ। জীবনকে বাচিয়ে রাখার জন্য মানুষকে ওদেরপূর্তি করতে হয়। ক্ষুধা ও রিরংসার ঊর্ধ্বে কেউ নয়। কবি সুকান্ত যথার্থই বলেছেন- ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। এ গদ্যময়তা স্বপ্নীল মানুষের ওড়াউড়িতে বিগ্নঘটায়। যদিও মহাকবি ইকবাল বলেছেন-‘আই তায়েরে লাহুতি/উছ রিজকাছে মাওতো আচ্ছি/জিস রিজকছে হোতাহে/পরওয়াজমে কোথাহি/’ অনুবাদ ‘হে উড়ন্ত পাখি/ওই খাদ্যের চেয়ে মৃত্যু তোমার জন্য শ্রেয়।/ যে খাদ্য তোমার উড্ডীন স্বভাবে বিগ্নতা ঘটায়। পৃথিবীতে, তবু মানুষ রুটি-রুজির সংগ্রামে সদা ব্যস্ত। রুজি রোজগার যে মানুষের সাক্ষাৎ প্রার্থনা, -এ কথাও অস্বীকার করার জো নেই।
‘বিকল্প নদীর ¯্রােতে যেতে যেতে আমাদের প্রাচীন প্রার্থনাগুলো
কোথাও বনের ধারে পাতার মর্মর শুনে বাঁক নেয়
তারপর হাওয়ার দোর্দÐ দাপটে
আরো বহুদূর যেতে যেতে শীর্ণ উপক‚লে
ভাতের গন্ধ পেয়ে সমুদ্রে যাবার কথা ভুলে যায়।’
মানুষ একধরনের নদী। মানুষের শরীরে নিরন্তর বয়ে চলেছে রক্তের ধারা। নদীর তাবৎ জল সমুদ্রে একসময় বিলীন হয়ে যায়। সে আর নদী থাকে না। হারিয়ে ফেলে নদী তার অস্তিত্ব। যতক্ষণ সে তার সীমার মধ্যে অবস্থান করে ততক্ষণ সে শতঝর্ণার জলে তার ওদরপূর্তি করে যায়। নিজস্ব স্বভাবে মানুষ স্বীকার করুক বা না করুক তাকে সমুদ্র তথা আলমে বরজখ এ পাড়ি দিতে হয়। তবু মানুষ ভাত তথা জৈবিক চাহিদার কাছে মাথা নত করে। কিন্তু কবি জানেন ভাত ছাড়া মানুষের পৃথিবীতে চাহিবার আরো অনেক কিছু আছে। কিন্তু দুর্বল মানব ক্ষুধায় বড্ড কাতর। ভোগ ও সুখের লোভে আর লাভে মানুষ ব্যস্ত পৃথিবীর জঞ্জালময় প্রেক্ষাপটে। অনেকে তা জানেন কিন্তু মানতে ভুলে যান। ক্ষুধার মতো মানুষের আদিম প্রার্থনা একদিন হারিয়ে যাবে জীবন থেকে। ওমর কায়সার কবি, জীবনের কবি। রক্তমাংসময় মানজবীনের কবি। বাস্তুতান্ত্রিক বাস্তবতায় তার সরব বিচরণ। তবু ব্যাপ্ত দেখি ব্যক্তি মানুষের ভেতর একজন কবি পুরুষ। জীবন-জগৎ ও শিল্পের দায়বদ্ধতায় সবসময় দূরন্ত বাউলিয়া পনায় তার যাপন।
সহজ সরল সুন্দর জানে না, সে কতো আরাধ্য হৃদয় সংবেদির। পবিত্র, নির্মোহ নারী দেহ প্রকৃতির মতো বেড়ে ওঠে। সময়ের সাথে ফুলকলির মতো ফোটে নিজস্ব মহিমায়। এখানে তার ভ‚মিকা নেই, সময় তাকে সব দান করে। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে একটি মেয়ে যৌবনে উপনীত হয়। তার বৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের বিকাশ, রূপ, প্রকৃতি অংশ মানুষসহ প্রকৃতির উপকরণকে সুন্দরের চাতালে আহŸান করে। অথচ ‘মেয়েটি’ পাখির ভাষা আর মানুষের ঘৃণা/ কখনো বোঝে না’। প্রতিমা বিজ্ঞানের ‘মেয়েটি শিরোনামের কবিতায় কবি সুন্দরের মধ্যে সবার জন্য যে একটা আকর্ষণ বিরাজে তা বোঝাতে চেয়েছেন। ফুল তো জানে না সে কত সুন্দর। সুন্দরের কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। ঘৃণা ও ভালোবাসা বোঝারও প্রয়োজন নেই। জীবন চলার পথে কেউ তা নিয়ে গবেষণা করে না। কিন্তু সহৃদয় সংবেদি কবির এখানে আগ্রহ চিরায়ত, প্রকৃতির সৌন্দর্য উদ্ধারে কবি ওমর কায়সার ‘মেয়েটি’র বৃদ্ধির মধ্যে প্রকৃতির তাবৎ সৌন্দর্যের স্বরূপ আবিষ্কার করেন শাশ্বত সুন্দর, প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণের জাত শৈল্পিক চিন্তা তার কবিত্বকে অসাধারণ মহিমা দান করে। প্রেম, প্রকৃতি, জীবন-যাপনের জটিলতা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা এবং চেতনায় কবি ওমর কায়সার যথার্থই কবি ও দার্শনিক। তার কাব্যিক কয়টি পংক্তি পাঠকের জন্য এখানে আমরা উদ্ধৃত করছি :
১) তুমি এলে-/আমি গোধূলির সাথে মিশে যাব।’
২) ঈষাণে তারার বুকে হেমলক বিষ
নীল হয়ে জ্বলে যাচ্ছে বুড়ো সক্রেটিস
৩) পাহাড়ে পাহাড়ে জুম বিরান কান্তার
জোনাকি আঁধারে কাটে আলোর সাঁতার।
৪) একটি পাতায় শ্যামল মেয়ে কী যেন কী বাঁধছে।
বৃষ্টি নয় তো, টাপুর টুপুর ওই মেয়েটি কাঁদছে।
৫) টোনার প্রতিটি পালক-ভস্ম ভাসমান নদী জলে,
টুনিহীন তার অরণ্যদিন জ্বলে যায় দাবানলে।
৬) বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
উঠোন জুড়ো বান
শঙ্খ নদীর বিয়ে হবে
ঘরবাড়ি সব দান।
কবি ওমর কায়সার সমসায়িকতা, চিরায়ত ভালোবাসা, দ্রোহ, প্রকৃতি ও নিজস্ব দর্শনকে কবিতায় সেলাই করে দিয়েছেন আপন স্বাতন্ত্র্যে। সহজ-সরল বাক্যবন্ধ, উপমার নতুনত্ব, ছন্দের নিখুঁত প্রয়োগে তার কবিতা সহজেই পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দেয়। ব্যক্তিগত-চরিত্রের সরল বিন্যাসের মতো তার ভাষার সরলতায় তার কবিতা সবধরনের পাঠককে আকৃষ্ট করে। বাংলা কাব্যে ওমর কায়সারের জন্য একটি স্থায়ী আসন অপেক্ষমান। কবি সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে কবিতা শিল্পকে আরো গুরুত্ব সহকারে জায়গা দান করলে আমাদের কাব্যশিল্প উপকৃত হবে।