ওস্তাদ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম এর একক বংশীবাদন সন্ধ্যা

103

শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি আকর্ষণ এবং এর চর্চা সংগীত জগতকে যুগে যুগে সমৃদ্ধ করেছে। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকপ্রাপ্তির পর দেরীতে হলেও নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি), চট্টগ্রাম কেন্দ্রের উদ্যোগে একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখাত বংশীবাদক ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম এর একক বংশীবাদন অনুষ্ঠান গত ২৯ নভেম্বর, রোজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়। আইইবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল আলম এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরিন আখতার।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরিন আখতার বলেন, উপমহাদেশীয় হিন্দুস্থানী সংগীতের পিতৃ-মাতৃভূমি খ্যাত ভারতে এখন যেমন আছে বাঁশিতে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, ঠিক তেমনি আমাদের কাছে আছে ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম যিনি বিশে^র সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সংগীত সম্মেলন ‘ডোবারলেন মিউজিক কনফারেন্স’-এ একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে পারফর্ম করার সুযোগ লাভে ধন্য হন যা শিল্পীর জন্য যেমন গৌরবের তেমনি আমাদের জন্যও অত্যন্ত গৌরবের।” অর্থাৎ ‘যেখানে প্রথাগত শিক্ষা নয়, কেবল আত্ম অনুসন্ধানের ভঙ্গিতেই সত্য ও সুন্দরের সাধনা অবিরাম সেখানে বাঁশির সুরে নিবেদিত একজন শিল্পীসত্তা এবং শিল্পের উৎকর্ষ লাভের আকাঙ্খায় যার শিল্পীজীবন উৎসর্গীকৃত হয়েছে। তিনি এদেশের একজন শিল্প-সম্পদ এ কথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায়। কেবল গুরুমুখী বিদ্যায় কিছু দিনের সাধনায় নয়, প্রায় অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সংগীতে আমাদের মতো রস-গ্রহীতাদের শুদ্ধ সংগীতের অমীয় ধারা ও স্বর্গীয় পুলক অনুভ‚তির মার্গে তথা উচ্চ স্তরে পৌঁছে দেবার নিমিত্ত ক্রমে হয়ে উঠেছেন এক আত্ম-প্রত্যয়ী সুরস্রষ্টা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইইবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের এডমিন, প্রফেশনাল এন্ড এসডব্লিও এর ভাইস-চেয়ারম্যান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার দে। আইইবি, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সম্মানী সম্পাদক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিকের পরিচালনা ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. সরোজ কান্তি সিংহ হাজারী, চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মাহফুজুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের জেনারেল সেক্রেটারি ডা. আঞ্জুমান আরা ইসলাম, স্থপতি জেরিনা খান, নগর পরিকল্পণাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া, স্থপতি সোহেল শাকুর, নজরুল সংগীতজ্ঞ প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া বেলা, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহিত উল আলম, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ, লায়ন এম সামসুল হক, ইঞ্জিনিয়ার জ স ম বখতিয়ার, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হারুন, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নাসির, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল বাকী, ইঞ্জিনিয়ার মোজাহের হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার এম. নাসিরুল হক, চট্টগ্রাম ওয়াসার বাণিজ্যিক মহাব্যবস্থাপক ড. পীযুষ দত্ত, মেরিন একাডেমীর কমান্ডেন্ট ড. সাজিদ হোসেন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, চট্টগ্রাম এর উপ পরিচালক নার্গিস সুলতানা, ছড়াকার সংগঠক গবেষক আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলো সরকারি-বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ নগরীর সর্বস্তরের সংস্কৃতি প্রেমিক মানুষ।
একসময়কার সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক উপমহাদেশের খ্যাতিমান ধ্রউঃপদী বাশিঁ শিল্পী প্রায় অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সংগীতের সাধনায় নিমগ্ন। তিনি তার নাবিক জীবনের নিঃসঙ্গ প্রহরগুলো অতিবাহিত করতেন বাঁশিবাদনের রেওয়াজে ও সেসময়কার ক্লাসিক্যাল পণ্ডিতদের বাজানো দুর্লভ রেকর্ড শুনে।
শিল্পীর প্রথম পরিবেশনায় ছিলো রাগ- ‘শ্রী’। ‘শ্রী’ মানেই সুন্দর, আর এই সুন্দরের পূজারী হন শিল্পী-সাধক কবিগণ। কেননা এই সুন্দরের সাধনা করতে গিয়েই পরম সুন্দরের নৈকট্য লাভ করার দূর্লভ সুযোগ পায়। কারণ সৃষ্টিকর্তা নিজে সুন্দর তাই তিনি সুন্দরকেই পছন্দ করেন। এতে করে ¯্রষ্টার কাছে যাওয়া ও তাঁকে আপন করে পাওয়া সম্ভবপর হয়। উপমহাদেশের কিংবদন্তী তবলাবাদক পন্ডিত সমর সাহার তবলার তালের চমৎকারিত্বে ওস্তাদ আজিজুল ইসলামের বাঁশীর মোহনীয় সুরের ঝংকারে বিমোহিত উপস্থিত হাজার শ্রোতার মুহুর্মুহু করতালিতে নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন এর অডিটোরিয়াম হল ছিলো বিপুল সংখ্যক শিল্পী, সংগীতবোদ্ধা ও সংগীত প্রিয় সমজদার শ্রোতামন্ডলীর উপস্থিতিতে মুখরিত। ধ্রুপদী বাঁশি শিল্পী তাঁর সুরের ইন্দ্রজাল বিস্তার করে রাগ- হংস ধ্বনি ও চন্দ্রকোষ বাজানোর অব্যবহিত পর ঝিঞ্ঝটি রাগে ভাটিয়ালি ধুনে বাশিঁতে অপূর্ব সুরের ছোঁয়ায় উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করে।
আরো যা বলার তা হলো, ভাটির টানে বাঁশীর সুরের মোহনীয় তানে উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের যখন চিত্ত আন্দোলিত হতে থাকে ঠিক তখনি ধ্রুপদী বাঁশি শিল্পীর পরিবেশনার ইতি অতৃপ্ত এক সুরের রেশ রেখে যায়। আর তা সকলকে প্রীতিধন্য করে এই ভেবে যে, আবার কখন জানি এরুপ সুর সায়রে সংগীতের রসগ্রহীতাদের ভাসিয়ে রাখে। সত্যি এতে অবগাহন করার যে মননশীল আবেগ তার অতলস্পর্শী সুরেলা গুঞ্জন একদিন শ্রোতার মনে দাগ কাটবে। দাগ কাটবে হয়ত কোন এক নস্টালজিক আবহে তথা স্মৃতি রোমন্থনের উপলক্ষ হয়ে। তারই প্রাসঙ্গিকতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-‘ অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ সাঙ্গ করি মনে হবে… শেষ হইয়াও হইলনা শেষ।’
প্রকৃতপক্ষে, এভাবেই স্বর্গীয় পীযূষ ধারায় বাঁশির সুরের যে সমাপনী তান তার আশ্চর্য মোহন বাঁশির রেশ রেখে শেষ করার মধ্য দিয়ে সংগীতপ্রেমীদের মনে বিদ্যুৎ চোম্বকীয় আবেশ তৈরি করে। অদূর ভবিষ্যতে তা উদীয়মান শিল্পীদের জন্য অবিরাম অনুপ্রেরণা যোগাবে ও নান্দনিক শিল্পকলার চর্চাকে করবে উচ্চকিত। সভাপতির সমাপনী বক্তব্য প্রদান ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি), চট্টগ্রাম কেন্দ্রের একাডেমিক এন্ড এইচআরডির ভাইস-চেয়ারম্যান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন।