এবার ঘরফেরা মানুষের স্রোত করোনার ঝুঁকি কমাতে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই

16

কঠোর লকডাউনের মধ্যেও ঈদে ঘরমুখো মানুষের স্রোত যেমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, অনুরূপ ঘরফেরা মানুষের স্রোতকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেননা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ঈদের আগে ১২ দিনে ঢাকা থেকে এক কোটির মতো মানুষ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে গেছে। আবার ঈদের একদিন পর ১৫ মে, মাত্র একদিনে ৪ লাখ লোক ঢাকায় ফিরে এসেছে। মোবাইল ফোনের সিমের হিসাবে এ তথ্য জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। এ তথ্যটি শুধু রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। এর বাইরে চট্টগ্রামে কোটি না হলেও অনুমান করা যায়, অর্ধলক্ষের অধিক মানুষ নগরের বাইরে গিয়ে ঈদ করেছে, আর রবিবার খোলার দিন কমপক্ষে লক্ষাধিক মানুষ শহরে ঢুকেছে। মানুষের এ আসা যাওয়ার পথ মোটেই মসৃণ ছিল না, অনেক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তাদের গন্তব্যে ছুটতে হয়েছে এবং ফিরতে হচ্ছে। এসময় স্বাস্থ্যবিধির কোন বালাই ছিলনা, অধিকাংশ যাত্রীর মুখে মাস্কও দেখা যায়নি। ঈদ উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের এমন অবিবেচক আচরণ দেশের জন্য আরো একটু বড় বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক কমিটির সদস্যরা।
আমরা জানি, সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শে মহামারি করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে লকডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। লকডাউনের লক্ষ্যই হলো- মানুষকে ঘরে রাখা এবং জরুরি প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হতে না দেয়া। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে এটাই সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। অথচ, করোনার দ্বিতীয় অভিঘাত শুরুর পর কঠোর-শিথিল লকডাউন ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে তা কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়নি। স্বাস্থ্যবিধিও সেভাবে কেউ মানেনি এবং মান্য করতে বাধ্যও করা হয়নি। এতে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই’ই বেড়েছে। সম্প্রতি ভারতে করোনা মহামারির সংক্রমণে যে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে, তা দেখে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের সচেতন করার চেষ্টা করলেও তা কোন কাজে আসছেনা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট-এ আক্রান্ত রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছে। এ অবস্থায় লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন হওয়ার কোন বিকল্প নেই। আমরা লক্ষ্য করেছি, মধ্যখানে সরকার লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়ার পর সুফল পাওয়া গেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমেছে। আইসিইউ বেড ও অক্সিজেনের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এর মধ্যেই ঈদ এসেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, রাস্তাঘাটে ও যানবাহনে ব্যাপক জনসমাবেশ এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিথিলতার কারণে করোনার তৃতীয় অভিঘাত দেখা দিতে পারে, যাতে সংক্রমণ ও প্রাণহানি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ইতোমধ্যে লকডাউন আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। ১৭ মে থেকে ২৩ মে পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। যথারীতি এ সময়ে শিল্প-কারখানা, শপিংমল, দোকানপাট, হাটবাজার খোলা রয়েছে। জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও ব্যাংকে সীমিত পরিসরে লেনদেন চলছে। অন্যদিকে আগের মতোই গণপরিবহন, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ থাকবে। শুধুমাত্র অফিস-আদালত, গণপরিবহন, ট্রেন ও লঞ্চ বন্ধ থাকার ফায়দা আসলে কী হবে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। দেখা গেছে, অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় অনেকেই কর্মস্থল ছেড়েছে সপরিবারে। যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা তাদের ও অন্যদের ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। তার চেয়ে গণপরিবহন, ট্রেন-লঞ্চ চালু থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের চলাচল করা সহজ ও সম্ভবপর হতো। সেটা হতো মন্দের ভালো। যারা ঈদ উপলক্ষে শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছে, এর মধ্যে তাদের অনেকেই ফিরে এসেছে। বাকীরাও ফিরছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে এভাবে দেশের সর্বত্র মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়ায় দেশজুড়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। সরকারের সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ শঙ্কা বাড়ছে বলে তারা মনে করেন। ঈদের আগে জেলার ভেতর গণপরিবহন চলাচল শিথিল না করে ঈদের পরে করলে এ ঝুঁকি এড়ানো যেত। ফেরিঘাটগুলোয় যা হলো, এটা এড়ানো যেত। হঠাৎ ফেরি বন্ধ না করে চলাচল অব্যাহত রাখলে যাত্রীর চাপ বাড়ত না। অথবা দূরপাল্লার বাস চালু থাকলে যাত্রীরা ঢাকা থেকে সোজা গন্তব্যে পৌঁছাত। ভাবনার বিষয়। করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও ঢুকে পড়েছে, এটির সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি; তাই প্রথমত নিজের সুরক্ষার স্বার্থেই স্বাস্থ্যবিধির সব নিয়ম অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলা জরুরি। সংক্রমণ রোধে চলমান লকডাউনের (বিধিনিষেধ) মেয়াদ আরো সাত দিন অর্থাৎ ১৭ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত আরেক দফা বাড়াল সরকার। শুধু সরকার নয়, আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। যার যার অবস্থান থেকে সচেতন থাকতে হবে। বিশেষ করে কর্মস্থলে ফেরা যাত্রীদের বিষয়ে এই মুহূর্তে সরকারকে মনোযোগ দেয়া দরকার। যাত্রীদের পথে পথে ভোগান্তি, ভাড়া নৈরাজ্য ও গাদাগাদি করে যাতায়াতের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ সাপেক্ষে গণপরিবহন চালু করা যেতে পারে। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক-পিকআপে, ফেরিতে করে মানুষ ঢাকায় আসছে। দূরপাল্লার বাস সার্ভিস চালু করলে যাত্রীদের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে আসবে বলে আমরা মনে করি।