ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

298

বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন পÐিত ছিলেন তাঁর মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম। তাঁর হাত ধরে ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নব যুগের সূচনা ঘটে। বাংলা গদ্যে প্রথম ‘বিরাম চিহ্ন’ বা ‘যতি চিহ্ন’ ব্যবহার করেন তিনি। বাংলা সাধু রীতির প্রবর্তক ও বাংলা গদ্যের জনকের মুকুট তাঁরই দখলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন একাধারে সমাজচিন্তক, কুসংস্কার প্রথাবিরোধী আন্দোলনের কাÐারি ও হিন্দু বিধবা বিবাহের প্রবর্তক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাটকের গদ্য অনুবাদ হল ‘কমেডি অব এররস’। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটকের বাংলা গদ্যরূপ দিয়েছেন তিনি। ১৮৩৯ সালে সংস্কৃত কলেজ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। প্রাতিষ্ঠানিক উপাধি কীভাবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ তিনি। ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণ পরিচয়’ ক্ল্যাসিক লেখার মর্যাদা লাভ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ, শিশুবিবাহের বিরোধিতা ও বিধবা পুনর্বিবাহ এবং নারীশিক্ষার প্রতি লড়াই করতে মানুষকে সাহস দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাব্রতী ও সমাজ সংস্কারক ব্যক্তি। বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ছিল তাঁর বিশেষ কীর্তি। এছাড়া কৌলীন্য প্রথা এবং বহুবিবাহে বিদ্যাসাগর ছিলেন ঘোরতর বিরোধী।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র (১৮৬৬) দু’টি সনেট ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে লেখা। প্রথমটিতে (‘বঙ্গদেশে এক মান্য বন্ধুর উপলক্ষে’) যাও-বা উহ্য ছিল, পরেরটিতে (‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’) তা শিরোনামে প্রকট হয়ে উঠেছে। কবি মধুসূদন দত্তের মূল্যায়নেই ঈশ্বরচন্দ্রের বহুমুখী পরিচয়ের নিদান বর্তমান। ‘সমকালের সেরা ব্যক্তি’, ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘প্রাচীন মুনিঋষির মতো প্রজ্ঞা ও জ্ঞান’, ‘ইংরেজের মননশক্তি ও বাঙালি নারীর হৃদয়ের সমন্বয়’ প্রভৃতির মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের বহুধা ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্বের পরিচয় উঠে এসেছে।
অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পরে ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ নামেই যে দু’টি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্রের মধ্যে ‘অজেয় পৌরুষ’ ও ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’কে প্রধান গৌরব বলে অভিহিত করেছেন।
১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বীরশালিঙ্গম পান্তলু ‘সোসাইটি ফর সোশ্যাল রিফর্ম’ গড়ে তুলে তেলুগুভাষী অঞ্চলে বিধবা বিবাহের জন্য আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে ‘দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর’ বলে অভিহিত করা হয়। এছাড়া তাঁর সহযোগিতায় কলকাতায় নারী শিক্ষামন্দির ‘বেথুন কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তনে (১৮৫৬) সমাজ সংস্কারকের ভ‚মিকায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাফল্য তাঁকে যে বিপুল জনপ্রিয়তা প্রদান করে। ঈশ্বরচন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য সর্ব ভারতীয় পরিচিতি লাভ করেন। ঊনিশ শতকে তাঁকে নিয়ে গান রচিত হয়েছিল। শান্তিপুরের তাঁতিদের কাপড়ে বিদ্যাসাগরের নাম উঠে এসেছে।
রাজা রামমোহন রায় ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রদ করে যে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র তার পরিসমাপ্তির দায়ভার নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন। সতীদাহ রোধে জীবন বাঁচলেও মনে আর মানে বাঁচা দায় হয়ে উঠেছিল বিধবাদের। সে ক্ষেত্রে, ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে সেই বিধবাদের চোখের জল মোচনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাঁদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বহুবিবাহ রোধ থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধেও শামিল হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, নারীশিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলা ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ঈশ্বরচন্দ্রের লক্ষ্য ছিল দেশের মানুষের সার্বিক প্রগতি। বিদ্যাশিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিতের অবিকল্প প্রতিভ‚, তা তাঁর বিদ্যাসাগরেই প্রতীয়মান।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম পশ্চিমবাংলায় মেদিনীপুর জেলায় বীরসিংহ নামক গ্রামে। ১৮২০ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর একটি দরিদ্র বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পারিবারিক নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামে স্বাক্ষর করতেন। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ভগবতী দেবী। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই এই মহাপুরুষের প্রয়াণ ঘটে।