ইসলামের এক চতুর্থাংশ জ্ঞানের ধারক হযরত আয়েশা (রাদি.)

26

 

হযরত মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। অতি শৈশবে তিনি যখন খেলা করতেন তখনই তাঁর যুক্তিপূর্ণ কথা-বার্তা, বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং খেলনাগুলো সাজানোয় পরিপাট্য ও কর্মকুশলতা দেখে বোঝা যেতো তিনি ভবিষ্যতে প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানী এবং বহুদর্শী হয়ে উঠবেন। সত্যিই হয়েওছিলো তাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবার জন্যই নবী ছিলেন। সবার কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া ছিলো তাঁর কর্তব্য। নারী-বিষয়ক অনেক বিধি-বিধান আছে, যা কেবল স্ত্রীর নিকট খোলামেলাভাবে বলা যায়, অন্য কারো কাছে বলা যায়। এজন্য হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার মত ধীমান, মেধাবী ও বিচক্ষণ নারীরই প্রয়োজন ছিলো। এ-ব্যাপারে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্ন দেখলেন, একজন ফেরেশতা হযরত মা আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা’কে কাপড় দিয়ে আবৃত করে তাঁর সামনে উপস্থিত করেছেন। এই স্বপ্ন তিনি একবার নয়, তিনবার দেখলেন। নবীগণের স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন নয়; তাঁদের স্বপ্ন আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারলেন, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা’কে বিবাহ করার জন্য নির্দেশ এসেছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে-নির্দেশ আসে নবীগণ তা দ্বিধাহীনভাবে পালন করেন। তাই পৌঢ়ত্বে উপনীত হওয়ার পরও আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা’কে বিবাহ করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপত্তি করার কোনো কারণ থাকলো না। অতঃপর মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা’কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ স্ত্রী হিসেবে কবুল করলেন।
হয়রত মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা বলেন দাম্পত্য জীবনে আমি ছিলাম সবার চেয়ে সুখী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আয়েশার মাঝে যে-ভালোবাসা ছিলো তা অবর্ণনীয়। জীবনের শেষকালে তিনি বলেছেন, বিশ্বজগতে আয়েশা আমার কাছে সবেচেয়ে প্রিয়। আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা বলেন, শুধু আমার ঘরে আমার চাদরের নিচে থাকাকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ওহি নাযিল হয়েছে; অন্যকোনো স্ত্রীর ঘরে এমন হয়নি। একটি পাত্র থেকে পানি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সঙ্গে গোসল করেছেন; অন্য স্ত্রীর সঙ্গে এভাবে গোসল করেন নি। আমার ঘরে আমার বুকের ওপর মাথা রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত বরণ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইন্তেকাল করেন তখন হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার বয়স আঠারো বছর। তাঁর দাম্পত্য জীবন ছিলো মাত্র নয় বছরের। এই নয় বছরে তিনি উচ্চ শিক্ষা ও অগাধ জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কুরআন, হাদিস, তাফসির ফিকাহ ও ফতোয়া তথা ইসলামি শিক্ষার সব বিভাগেই তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিলো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু, হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু এবং হযরত উসমান রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু’র খেলাফতকালে তিনি ফতোয়া প্রদান করতেন। নামকরা সাহাবিগণ যাঁরা দীর্ঘদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তাঁরাও ভুল-ভ্রান্তির শিকার হলে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার কাছে এসে সংশোধন করে নিতেন।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা কর্তৃক সংশোধিত বিষয়গুলো একত্র করে হযরত ইমাম আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। শরিয়ত-সংক্রান্ত কোনো সূ² ও জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব না হলে তৎকালীন বড় বড় আলেমগণ হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহার শরণাপন্ন হতেন। হযরত আবু মুসা আশআরি রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু বলেন, কোনো জটিল সমস্যা নিয়ে আলেমগণ হযরত আয়েশার কাছে উপস্থিত হলে সমাধানের যথার্থ জ্ঞান তাঁর কাছে পেতেন। হাদিসের গ্রন্থগুলোতে হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা থেকে ২২১০ টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো আলেমের মতে শরিয়তের বিধানাবলির এক-চতুর্থাংশ হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। যাঁরা শরিয়তের বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন তাঁদের সংখ্যা হাজার হাজার। যদি একা হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা থেকেই দীনের এক-চতুর্থাংশ বিধান বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও প্রাচুর্য সহজেই উপলব্ধি করা যায়। তিনি যে কেবল ধর্মজ্ঞানে অতুলনীয় ছিলেন, তা নয়। সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস, বংশ-তালিকার সূত্রপরম্পরা সম্পর্কেও তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিলো। অন্ধকার-যুগের কবিদের সুদীর্ঘ কবিতাবলি তিনি মুখস্থ করে রেখেছিলেন। তৎকালীন বিশ্বে নারীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বিদুষী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর তিনি আটচল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন। এই দীর্ঘসময় তিনি দ্বীন প্রচার ও জ্ঞানচর্চায় অতিবাহিত করেছেন। তাঁর মত নারী জ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত না রাখলে মুসলিম জগতের একাংশ অন্ধকারে ডুবে থাকতো। ছেষট্টি বছর বয়সে ৫৭ হিজরিতে ১৭ রমযান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা ইন্তেকাল করেন। কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানচর্চা, দীনপ্রচার, চারিত্রিক গুণাবলি, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় হযরত মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহা ছিলেন অনন্য; তাঁর মত আর কেউ ছিলেন না। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে জ্ঞানচর্চা ও দীনের কল্যাণে কাজে লাগিয়ে আজো মুসলমানদেন হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে আছেন। মুসলিম নারীদের জন্য তিনি চির অনুসরণীয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী