ইসরায়েলের মূল টার্গেট কিন্তু ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা

4

আকতার কামাল চৌধুরী

হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য এমনিতেই জ্বলন্ত বারুদ হয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও আরব আমিরাতের মধ্যস্থতায় তখন যুদ্ধবিরতি নিয়ে বৈঠক চলছে কাতারে। আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছিল না। কারণ, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি আর গাজা থেকে ইসরাইলি সৈন্যদের প্রত্যাহার ছাড়া হামাস কোনো কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। এরমধ্যে ১০ই এপ্রিল মধ্যপ্রাচ্যে ঈদুল ফিতর। সেদিনই আরেক অমানবিক, জঘন্য কাÐ ঘটায় ইসরায়েল। সেই ঈদের দিন-ই ইসরায়েল সুনিপুণ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার তিন পুত্র ও তিন নাতি-নাতনিকে হত্যা করে। সেদিন তাঁরা বাসা থেকে অন্য যায়গায় যাচ্ছিলেন। অথচ,ইসমাইল হানিয়া তখন কাতারে, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য ব্যস্ত সময় পাড় করছেন।
হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ইসরায়েল তাঁর বাড়িতে ভয়াবহ হামলা চালায়। এই হামলায় ইসমাইল হানিয়ার পরিবারের ১৪ জন সদস্য নিহত হন। নিহতদের মধ্যে তাঁর এক ভাই ও এক নাতিও ছিলেন। জীবনের পদে পদে ইসরায়েলী হামলায় সর্বস্ব হারানো ও ‘বিপর্যস্ত ব্যক্তি ইসমাইল হানিয়ার’ পক্ষে এই শোকের ধকল সামলানো কি খুব সহজ ছিল? ইতিপূর্বে তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইরানী জেনারেল ও আল্ কুদস ফোর্সের প্রধান কাশেম সুলেমানিকে হত্যা করে।
গত ১লা এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। এই হামলায় ইরানের তিন উর্ধতন জেনারেলসহ ১২ জন নিহত হন। আর এই হত্যাকাÐই ইরানকে বলতে গেলে ইসরায়েল আক্রমণে বাধ্য করে। বলতে গেলে উপরিউক্ত ঘটনাবলী ইরানকে প্ররোচিত করে ইসরায়েল আক্রমণে। এভাবে ইরানকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে নিয়ে আসে ইসরায়েল। যদিও শত প্ররোচনায়ও ইরান কখনো জাতশত্রু ইসরায়েলের সাথে কখনো সরাসরি সংঘাতে জড়ায়নি। কিন্তু ইসরায়েলের এবারের জিঘাংসা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ইরানেরও আর পেছনে ফেরার পথ নেই। বিশ্বে নিজের অস্তিত্ব আর সামরিক সক্ষমতার জানান দেওয়ারও গরজবোধ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দেশটিকে। বস্ততপক্ষে সিরিয়ার দূতাবাসের হামলা ইরানকে ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দেয়। তাই প্রতি আক্রমণ ছাড়া কোনো পথ-ই খোলা নেই ইরানের সামনে। ৩৬০টি ক্ষেপনাস্ত্র-ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় ইসরায়েলে। ইরানের এই আক্রমণ ইসরায়েলের যে মোটাদাগে ক্ষতি করতে পারবে সেটাও বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, উপরিউক্ত ঘটনা পরিক্রমায় ইরান যে প্রতি-আক্রমন করবে তা অনেকটা নিশ্চিত ছিল বিশ্ব। তাই এই প্রতি-আক্রমণ ঠেকাতে সময় পেয়েছে ইসরায়েল। তারা পশ্চিমাদের সহায়তায় অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যুহ বসায়। ইসরায়েলের ভাষ্যমতে,ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোনের ৯৯ শতাংশ আকাশেই ধ্বংস করে ফেলেছে তারা। যেহেতু ইসরায়েলের এই দাবি একতরফা, যা নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করা যায়নি, তাই ইরানি আক্রমণে মোটাদাগে নাহলেও ক্ষয়ক্ষতি যে হয়নি তা-ও বলা দুস্কর। মোদ্দকথা, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলার অজুহাত খুঁজছে, বলতে গেলে ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। যেভাবে হোক ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া চাই। ইসরায়েল-মার্কিনসহ পশ্চিমাদের একমাত্র মাথাব্যথার কারণ ইরানের এই পারমাণবিক স্থাপনা। তাদের আশংকা ইরান কোনোভাবে পারমাণবিক বোমার অধিকারী হতে পারলে ইসরায়েলকে একটা ভীতি ও দৌঁড়ের উপর থাকতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে। যা তাদো অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। তাই ইরানকে এই শক্তি থেকে বিরত রাখতে মরিয়া তারা। পশ্চিমাদের পাশাপাশি সৌদি আরবও এককাট্টা ইরানের বিরুদ্ধে। ইরান সবসময় দাবি করে আসছে, তাদের পরামাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু পশ্চিমারা এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের আশংক,এই কর্মসূচির আড়ালে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তারা।
একসময় জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানিকে নিয়ে ইরানের এক সমঝোতা চুক্তি হয়। শুরু থেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছিল সৌদি আরব। তাদের প্রত্যাশা ছিল পশ্চিমারা সামরিক হামলা করে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা যেন গুঁড়িয়ে দেয়। ১৯৭৯ সালের ইরানী বিল্পবকে সৌদি আরব কখনো ভালো চোখে দেখেনি। নিজেদের রাজতক্ত হারানোর ভয়ে সৌদি আরব এই বিপ্লব নিয়ে সবসময় আতংকগ্রস্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে সরকার পরিবর্তন হলে ইসরায়েলের প্রবল চাপ আর সৌদি আরবের পরোক্ষ প্ররোচনায় ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে বেড়িয়ে আসে ট্রাম্প প্রশাসন। আবার শুরু হয় রশি টানাটানী। চীনের দুতিয়ালিতে সৌদি আরব-ইরান ক‚টনীতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হলেও মন থেকে ইরানকে শত্রু তালিকা থেকে হয়তো বাদ দেয়নি সৌদি আরব। তাই ইরানের এমন উত্তেজনাকর দিনে সৌদি আরবকে খুব অখুশি বলার সুযোগ নাই। ইরানও বিষয়টি যে অনুধাবন করে না তা-কিন্তু নয়। বলাই বাহুল্য, ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরবের যে বন্ধুত্বের হাতছানি তার মর্মার্থ এই- ‘খামোশ ইরান! দেখো, আমরা তোমার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ’।
সামরিক বিশ্লেষকদের ধারণা,হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ, ইরান-ইসরায়েল আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে মধপ্রাচ্য এখন এক জলন্ত অগ্নিকুন্ড। এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়তে পারে যেকোনো অঞ্চলে, যেকোনো মুহূর্তে। ঠিক এটাই চাচ্ছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র। যাতে কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখধাঁধানো আক্রমণে ইরানের স্বপ্নের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়া যায়। সর্বশেষ ইসরায়েলী মন্ত্রসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা ইরানী আক্রমনের জবাব দেবে। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা শেষ মানে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের মিশনও শেষ। সৌদি আরবের শাসকদেরও তখন শান্তির ঘুম নেমে আসবে দুচোখ ভরে।
লেখক: প্রাবন্ধিক