আবৃত্তিকে মননে বুনেন একজন রাশেদ মুহাম্মদ

73

সাহিত্যের ব্যাপ্তি ব্যপক, বিস্তৃত। আবৃত্তি সে বিস্তৃত ব্যাপ্তিকালের বিশাল অংশ জুড়েই দিব্যমান? হাজার বছরের আবৃত্তি ঐতিহ্য সাহিত্যধারায় সৃষ্টি করতে পেরেছে দ্যোতনা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর জাপানে আবৃত্তি সাহিত্যে স্রোতস্বিনী প্রবাহ হতে হতে নিজস্ব অবয়বকে রূপান্তরিত করেছে স্বকীয় শিল্প হিসেবে। তাই আবৃত্তিকার মাত্রই ‘সর্ব শাসত্রানাং বোধাদপি গরীয়সী আপ্তবাক্যটিকে সর্ব প্রণিধান হিসেবে অগ্রে রেখে এগিয়েছে আবহমানকাল ধরে।
রাশেদ মুহাম্মদ। সমৃদ্ধ স্বকীয়তার শৈল্পীকতা দেখেই মূলত আবৃত্তির প্রেমে পড়া। চট্টগ্রামে আবৃত্তির ব্যাপকতা ঢাকা বা কোলকাতার মত বিশদ পরিসরে চর্চিত না হলেও কোনাংশে পিছিয়ে নেই। আরো অনেকের মতই আবৃত্তির প্রবাদ পুরুষ, সংগঠক ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক মোসতাক খন্দকারের হাত ধরেই রাশেদ মুহাম্মদের এই অঙ্গনে পদচারণ। চট্টগ্রামের শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গন নামে দারুণ সমাদৃত ‘ক্বণন’ আবৃত্তি পরিবারের যাত্রা আরো তেত্রিশ বছর আগে শুরু হলেও ২০০৯ সালে রাশেদ প্রথমবার সে যাত্রায় সারথি হতে নাম লেখান। তাঁর পাঠের বিষয়টিও ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। সে বিষয়ে অর্জন করেছেন স্নাতক ও স্নাতোকত্তর ডিগ্রী। পড়াচ্ছেন নগরীর নাম করা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আবৃত্তি মূলত তার মননে জিইয়ে থাকা জলাশয়ে বুদবুদের মত ধীরালয়ের নেশা। শুদ্ধস্বরের পরিশীলিত আবহ বারবার টানে বলেই এই অঙ্গনে নিজেকে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন বলে বলতে ভালোবাসেন। তাই গান, সংবাদ পরিবেশন, লেখালেখিতে পারঙ্গমতা থাকলেও নিজেকে বাচিকশিল্পী হিসেবে জানান দিতে ভালোবাসেন। রাশেদ বলেন, আবৃত্তি হৃদয়ের অতি গভীরে পুঁতে থাকা পুঁজি, পূজনীয় প্রেম আর আবেশের নাম। আবৃত্তির অবগাহনে জিইয়ে থাকতে তাই ভালো লাগে। তার আবৃত্তিগুরু মোসতাক খন্দকার ও ভারতের নামজাদা বাচিকশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে ব্রত মানেন এই শিল্পে। তাঁদের মোহময় আবৃত্তিতে বারবার আপ�ুত হোন।
প্রমিত উচ্চারণ, লয়, শ্বাসাঘাত, স্বর প্রক্ষেপণ, বিরতি, ভাব, অনুভূতি, আবেগকে আবৃত্তিতে সঞ্চালনা করেন খুব মেপে মেপে। বিষয়বস্তুর আহবান বিচারে অণুরণন তুলেন প্রতিটি বাক্য-শ্লোকে। রাশেদ মনে করেন কবিতা বা গদ্যে একজন বাচিকশিল্পী মাত্রই শ্রোতা মুখে নগদে শৈল্পিক মোহতায় প্রাণের সঞ্চার করেন। তাই উপাত্ত গুলোর কোনোটার যাতে কমতি না ঘটে সেদিকে বেশ মনোযোগী হতে হয়।
এই অঙ্গনের পুরোধা গোলাম সরওয়ার, কাজী আরিফ, হাসান ইমাম, রবিশঙ্কর মৈত্রী একই সাথে কোলকাতায় প্রদীপ ঘোষ, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সহ যারাই আলো বিলিয়েছেন তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার প্রয়াস আজন্ম লালিত এই শিল্পীর মননে। আবৃত্তিশিল্পকে প্রতিষ্ঠানিক রুপ দিতে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয়ের কথাও বলেন। সে স্বপ্নে আবৃত্তি চর্চার আতুড়ঘর ক্বণনেই কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর। ক্বণনের কার্যকরী পরিষদ সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্বে আছেন। নুতন পুরনো সব আবৃত্তি প্রেমীদের প্রাণোদনা দিতে ক্বণনের সামিয়ানায় অসংখ্য কর্মশালায় কাজ করেন প্রতিনিয়ত। সেখানে সময় দিতে ভালোবাসেন সতত। নিজেই ‘অনুস্বার’ নামে শুদ্ধ উচ্চারণ স্কুল গড়ে তুলেছেন বন্ধুদের সহযোগিতায়। যেখানে কোমল শিশু-কিশোররা শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তির নিয়মিত তালিম নিচ্ছে। এভাবেই শিগগির আবৃত্তিশিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপে দেখা যাবে সাহিত্যাঙ্গনে এমন স্বপ্নের অন্তর্জালে বুনন দেন রাশেদ।
আবৃত্তি নিয়ে ভবিষ্যত প্ল্যান বলতে গিয়ে রাশেদ বলেন, ‘আবৃত্তি নিয়েই বাকী সময় থাকতে চাই’। স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করার চলনটি পোক্ত করতে চেষ্টা করেন নিজের মধ্যে। আশেপাশের যারা আবৃত্তিকে ভালোবাসেন তাদের মধ্যেও স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করার ব্যাপারে তাগাদা দেন। স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করার। এক নাগাড় শুদ্ধতায় আবৃত্তি শ্রোতাদের মধ্যেও শোনায় ব্যাঞ্জনা আনে নিমিষে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম আর আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা গুলোই বেশি মঞ্চে আবৃত্তি করতে মন টানে। একইসাথে তরুণ লিখিয়েদের কবিতা আবৃত্তি করতেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মঞ্চে নিজের বাচিকগুণের মুগ্ধতা ছড়ানোর প্রয়াস পেয়েছেন বারবার। আবৃত্তিকে ভালোবাসার জায়গায় রেখে অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার। মন ও মননের গহীনে জিইয়ে রাখতে চান বহুকাল, ছড়াতেও চান এধারওধার সবখানে।
একজন বাচিকশিল্পী রাশেদের জন্যে শুভ কামনা নিরন্তর।