আপসহীন এক অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু

263

মো. মোরশেদুল আলম

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বাংলাদেশের মানুষ যখন পাকিস্তান বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল; তখন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ঢাকা রেডিও থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক স্বরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, যার কয়েকটি চরণ দিয়ে আমি নিবন্ধটি শুরু করতে চাই। ‘মুজিবুর রহমান/ ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নিউগারী বান।/ বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে/ জ্বালায় জ্বালিয়ে মহাকালানল ঝঞ্ঝা অশনি বেহে/ জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী তব পাছে/ তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।/ রাজভয় আর কারাশৃঙ্খল হেলায় করেছে জয়/ ফাঁসির মঞ্চে মহত্ত¡ তব কখনো হয় নি ক্ষয়।/ বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ।’
বাঙালির স্বাধীনতা হচ্ছে ইতিহাসের এক মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের মহানায়ক হচ্ছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ, স্বাধীনতা অর্জন প্রভৃতির সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকশিত হয়। তিনি স্কুল ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। গরীব ছাত্রদের খাওয়া ও লেখাপড়ার জন্য মুষ্টি ভিক্ষার চাল সংগ্রহ এবং তাদের থাকার জন্য জায়গিরের ব্যবস্থা করে দিতেন। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জনসভায় অংশ নিতে গোপালগঞ্জ আগমন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। স্কুল পরিদর্শনকালে সোহরাওয়ার্দীর নজরে আসেন বঙ্গবন্ধু। তখন থেকে চিঠির মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ হতো। ১৯৩৯ সালে কলকাতা গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ প্রভৃতি ঘটনাবলির মাধ্যমে তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি ছাত্রজীবনেই পরিদৃষ্ট হয়।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানা খুলে মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা দাঙ্গার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন রক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পর তিনি সমগ্র পূর্ব বাংলায় দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে তাঁকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৫০ সালে ফরিদপুর কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর সহবন্দি চন্দ্রঘোষকে তিনি বলেন, ‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’ দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি যে কোনো প্রকার ত্যাগ শিকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভাল কাজ করতে পারে নাই- এ বিশ্বাস আমার ছিল।’ কর্মীদের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম স্নেহ, মায়া ও ভালবাসা। তাদের সুখ-দুঃখের খবর নিতেন। বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। তবে বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ার ব্যাপারে তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান খুবই অনড় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাবা একদিন তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না। তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।” গোপালগঞ্জ শহরের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমানকে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যা আরম্ভ করেছে তাতে তাঁর জেল খাটতে হবে। তাঁর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাঁকে এখনই বাধা দেন।’ প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধুর বাবা বলেছিলেন, ‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না।’
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এর প্রেক্ষাপটে রচিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের মধ্যে একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার জন্য পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে বিনাবিচারে বঙ্গবন্ধুকে এক নাগাড়ে দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে বন্দি রাখা হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…আমাকে যখন জেল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে তখন আমি বলেছিলাম, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনা বিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব।’ জেলখানায় অনশনে যাওয়া পূর্বে বঙ্গবন্ধু তাঁর মনের অবস্থা এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘…একদিন মরতেই হবে। অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে।’ পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করে ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট এক ভাষণে স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘স্যার আপনি দেখবেন ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটি ঐতিহ্য।’
পাকিস্তানের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শাসনামলে (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রি.) বাঙালির মুক্তি এবং অধিকার আদায়ের জন্য তাঁকে ১৪ বার গ্রেপ্তার, প্রায় ১৩ বছর কারাবরণ এবং দু’বার ফাঁসির মঞ্চেও যেতে হয়েছিল। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বার বার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে। যতটুকু সময় কারাগারের বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছেন তাও হয় হুলিয়া, না হয় গোয়েন্দাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে কাটিয়েছেন। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, জামিনের মাধ্যমে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় জেলগেটে আটক হয়ে কারাগারে গিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কারাগারে বন্দি থাকার পর মুক্তির আদেশ পেয়ে জেলগেট থেকে আবার ফিরে আসা যে কত কষ্টকর এবং কত বড় ব্যথা, তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝা কষ্টকর।’ কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে সেলের মধ্যে রাখা হতো। বঙ্গবন্ধু কারাগারের সেল সম্পর্কে বলেন, ‘জেলের মধ্যে জেল, তাকেই বলে সেল।’ তাই, পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য এক বৃহত্তর কারাগার। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কারাগারের অন্ধকার কামরায় একাকী থাকা যে কী কষ্টকর, ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না।’ পাকিস্তানের ফায়জালাবাদ (লায়ালপুর) জেলে বন্দি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করে মৃত্যুদÐ রায় প্রদান করে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর কারাকক্ষের নিকটেই কবর খোঁড়ে রাখে। এভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্য তিনবার কবর খোঁড়া হয়েছিল। তবুও তিনি কোনো প্রকার আপোস না করে বরং পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল ছিলেন। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অগাধ ও অকৃত্রিম। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘…আপনারা আরও জানেন যে আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেল-এর পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাসিঁর মঞ্চে যাওয়ার সময়ও আমি বলব; আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসীম সাহসী। জেল, জুলুম, নির্যাতন, দীর্ঘ কারাভোগ, জীবননাশের আশঙ্কা কোন কিছুই তাঁকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। একজন কর্মঠ, ত্যাগী, ভাল কর্মী হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। তিনি লিখেছেন, ‘আমাকে যে কাজ দেওয়া হত আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম…ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম।’ বঙ্গবন্ধু তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতির শীর্ষে ওঠে আসেন। এজন্য তাঁকে অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়। ১৯৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘…চোঙ্গা মুখে দিয়ে রাজনীতি করেছি, রাস্তায় হেঁটেছি, পায়ে হেঁটেছি, ফুটপাতে ঘুমিয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে এমন কোন মহকুমা নেই, এমন কোন থানা নেই, যেখানে আমি যাইনি।’ ত্যাগের মহান ব্রত নিয়েই বঙ্গবন্ধু নিজেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেছিলেন। রাজনীতিকে তিনি দেশ ও জনগণের কল্যাণের মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন। জনগণের শোষণ মুক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বঙ্গবন্ধুর একের পর এক কারাভোগের কারণে তাঁর সন্তানরাও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। অসংখ্যবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, তবুও ফাঁসির দড়িকে তিনি ভয় করেন নি। নিজের ও পরিবারের সকল সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। জনগণই ছিল তাঁর প্রাণ। সত্যিকারভাবেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন এক অবিসংবাদিত নেতা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চবি