অপুর ভাবনা

31

 

স্টেশনের কাছেই অপুদের লাল রঙের ইটের বাড়িটা। অনেকদিনের পুরোনো। রং চটে গেছে। জায়গায় জায়গায় ইট খসে গেছে। কতো আগে শেষ রং করা হয়েছিল কে জানে? হয়তো বানাবার পর আর করাই হয়নি। এখন আর করার প্রশ্নই আসে না। অপুদের যা আর্থিক অবস্থা! কোনমতে বেঁচে আছে। একে বেঁচে থাকা বলে না। অপুর বাবা বড় একটা দোকানে ক্যাশে বসে। মাস মাইনে যা পায় তাতে টেনেটুনে বিশ তারিখ পর্যন্ত যাওয়ার পর ধার করে চলতে হয়। সে সময় খুব কষ্ট ওদের। কোন কোনদিন অপুর মা একবেলা খেয়ে অন্যবেলায় একমুঠো চালভাজা খেয়ে দুগ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ে।অপুর তখন ভীষণ কষ্ট হয়। নিজেদের অবস্থার সাথে সহপাঠী বন্ধুদের অবস্থার তুলনা করে ভাবে আল্লাহর এ কেমন সৃষ্টি! কাউকে করেছেন ধনী আর কাউকে এমন দরিদ্র! এ কেমন লীলা তাঁর। অথচ অপুর বাবার মতো সৎ আর নির্বিরোধী মানুষ এ-যুগে নেই বললেই চলে। খালেদ মুন্সির মতো শয়তান লোক কি আর এমনি এমনি ক্যাশে বসায়?
এনিয়ে তার মাকে বলতে গেলে মা বলে, এসব নিয়ে ভাববার বয়স তোমার হয়নি। তুমি তোমার কাজ করো। তার বিচার আল্লাহ করবেন।
অপুর তখন ভীষণ রাগ হয় মায়ের ওপর। কন সব আল্লার উপর ছেড়ে দিয়ে অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেবে? আর মৃত্যুর পর বিচার হয়ে লাভ কি?
এই যে তার আব্বা জীবিত অবস্থায় এতো দুঃখ, কষ্ট সয়ে যাচ্ছে তারই বা প্রাপ্তি কি?
এসব অপু ভাবতে চায়না। সে জানে তার এখন একমাত্র পথ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের শুধু ভালোভাবে লেখাপড়া করা। কিন্তু সেখানেও তো কতো বাধা। সব বই কেনার সামর্থ্য নাই, টিউশন নেওয়ার ক্ষমতা নাই। এখন লেখাপড়া করাও টাকা পয়সার উপর নির্ভর করে। আগের সেদিন নেই ভালো ছাত্রদের শিক্ষক টাকা ছাড়া পড়াবেন। ক্লাশেই ভালো করে পড়ান না যাতে কোচিং এ পড়তে আসে। অপু এসব মা-বাবার সাথে শেয়ার করতে পারে না। নিজের মনেই নিজে ভেবে কষ্ট পায়। আজও তাকে ভাবনাতে পেয়েছে।
গতকাল ক্লাস টেস্টে সে দ্বিতীয় হয়েছে। অপু বরাবর ফার্স্ট হয়ে আসছে। শত দুঃখ, কষ্টের মধ্যেও। সে পড়ার জন্য কোন কিছুর সাথে আপোষ করেনি। অথচ সেতো জানে তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে দ্বিতীয় করা হয়েছে। মুনীর বড়লোকের ছেলে। যে স্যার রসায়ন পড়ান উনি নতুন এসেছেন। অপুকে অনেকবার বলেছে উনার কাছে পড়তে। স্যার তো জানেনা অপুদের অবস্থার কথা। যার ভাত খাওয়ার পয়সা নেই সে করবে কোচিং!
ভাবতে ভাবতে অপু বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে হাঁটতে সে কখন স্টেশনের পাশের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। রাস্তার পাশে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বস্তি। অপু দাঁড়িয়ে দেখে তারই বয়সী একটি ছেলে। তার একটি হাত আর একটি পা নেই। তবুও সে ক্রাচ হাতে খেলা দেখিয়ে মানুষের মনোরঞ্জন করে অর্থ উপার্জন করছে। নিজের দুঃখ চেপে অপরের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে।
ভীষণ ধাক্কা খেল অপু। সাথে লজ্জাও। তার তো হাত পা সব আছে। তাকে টাকার জন্য কাজও করতে হচ্ছে না। নিজের কষ্টটাই বড় করে দেখছে। তার পকেটে দশ টাকা ছিল। সে টাকাটা সে ছেলেটার হাতে দিয়ে বাড়ি ফিরে চললো নতুন ভাবনায় দৃপ্ত পদক্ষেপ নিয়ে।