অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবে ন্যাশনাল ব্যাংক

0
অচিরেই ঘুরে দাঁড়াবে ন্যাশনাল ব্যাংক

ফারুক আবদুল্লাহ

নতুন পর্ষদ নেতৃত্বে এসেই ন্যাশনাল ব্যাংকের নানাবিধ সংকট নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা খেলাপি ঋণ পুনঃরুদ্ধারে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান ও ব্যাংকের সুনাম ফিরিয়ে এনে গ্রাহকদের আস্থার সংকট নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ন্যাশনাল ব্যাংকের ৪ ১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্বদেশের সঙ্গে কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল আলম খান।

পূর্বদেশ : ন্যাশনাল ব্যাংকের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছু বলুন।

মো. তৌহিদুল আলম খান : ১৯৮৩ সালে প্রথম দেশীয় মালিকানায় বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। বর্তমানে ২২১টি শাখা, ৬৫টি উপ-শাখা, দেশের ভিতর ২টি ও দেশের বাইরে ৪টি সাবসিডিয়ারি, জিসিসি অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রে ২টি মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা চুক্তি সহ দেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) এবং রেটিং প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকটি ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে ব্যাংকটিতে ২০ লক্ষের অধিক আমানতকারী ও প্রায় ১ লক্ষ ঋণগ্রহীতা আছেন। বিদেশ থেকে বৈধ পথে ও নিরাপদে টাকা প্রেরণের লক্ষ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকই সর্বপ্রথম ১৯৯৪ সালে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। এছাড়া কৃষিখাতের উন্নয়নেও ন্যাশনাল ব্যাংকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। দেশের প্রান্তিক কৃষিনির্ভর মানুষের পাশে দাঁড়াতে ব্যাংকটি বাংলাদেশ সরকারের ‘বরেন্দ্র’ নামক সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নে একসাথে কাজ করে। কৃষিখাতে নিজস্ব সক্ষমতায় বিতরণকৃত মোট ঋণগ্রহীতার সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংক প্রথমবারের মতো ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ডকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবসার প্রচলন ঘটায়। রেমিট্যান্স সংগ্রহে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, ওমান, গ্রিসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

পূর্বদেশ : নতুন পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাসমূহ সম্পর্কে জানতে চাই।

মো. তৌহিদুল আলম খান : বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠিত করে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গঠিত পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র প্রাক্তন পরিচালক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। শিক্ষকতার পাশাপাশি ড. ফারহাত শিক্ষা, ফার্মাসিউটিক্যালস, পোশাক, আইসিটি, রিয়েল এস্টেট এবং কৃষি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপণন, সামাজিক উদ্যোগ এবং ব্যবসায়িক কর্মকৌশলগত এডভাইজারি দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া পরিচালক যারা রয়েছেন তারা হলেন, কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও উদ্যোক্তা পরিচালক আলহাজ খলিলুর রহমান, হোসাফ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান পারভীন হক সিকদার, এসআইসিএল এর পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. শফিকুর রহমান, ওএসপি (বার), এসপিপি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি (অবসরপ্রাপ্ত), বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন।
নতুন পর্ষদ নেতৃত্বে এসেই ন্যাশনাল ব্যাংকের নানাবিধ সংকট নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা খেলাপি ঋণ পুনঃরুদ্ধারে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান ও ব্যাংকের সুনাম ফিরিয়ে এনে গ্রাহকদের আস্থার সংকট নিরসনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাদের পাশাপাশি বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে সরাসরি ও ভার্চুয়ালি বৈঠক করে তাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করছে। বিশেষ করে নতুন নতুন গ্রাহক সৃষ্টির পাশাপাশি আমানত সংগ্রহ করা ও খেলাপি ঋণ আদায়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখছে।

পূর্বদেশ : আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে ন্যাশনাল ব্যাংকের ভূমিকা কিরূপ?

মো. তৌহিদুল আলম খান : আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশ জাতি হিসেবে অনেক বড়। এই জাতির দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। বিশেষত দেশের অধিকাংশ মানুষই এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়েছে। বলা হয়ে থাকে আমাদের দেশে ব্যাংক বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু ১৮ কোটি মানুষের দেশে এখনো অধিকাংশ মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতাবহির্ভূত। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা প্রদানে আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে ৬৫টি উপ-শাখার মাধ্যমে আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছি। মোবাইল অ্যাপস ও কিউআর কোড এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষদেরকে ব্যাংকিং কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমে রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকিং কার্যক্রমকে আরো সহজতর করে সাধারণ মানুষদের দোরগড়ায় পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করে চলেছি।
পূর্বদেশ : আগামীতে ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মপরিকল্পনা কি?

মো. তৌহিদুল আলম খান : ন্যাশনাল ব্যাংকের অগ্রযাত্রায় কিছু যুগান্তকারী ও অভ‚তপূর্ব সাফল্য অর্জন করা হয়েছিল যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি দেশে প্রথমবারের মতো আমরা মাস্টারকার্ডের মাধ্যমে ওমরাহ কার্ড চালু করেছি। ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সিএমএসএমই খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করছে। পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষে সরাসরি নজরদারির ফলে এ খাতে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকের বিগত বছর সমূহের বিবরণী পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী, বাস্তবসম্মত, টেকসই ও কৌশলগত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিএমএসএমই খাতে উন্নয়নের হার ক্রমান্বয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে। এছাড়া নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কৃষি ঋণ প্রদানে ন্যাশনাল ব্যাংক অগ্রণী ভ‚মিকা রাখছে। প্রায় ৩৫ হাজার গ্রাহককে ৪৮০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। শস্য, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে কৃষি ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। কৃষি ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এছাড়া গ্রাহকদের জন্য নিত্যনতুন সার্ভিস প্রচলনের পাশাপাশি আগামীতে আমরা রপ্তানি বাড়ানোর দিকেও নজর দিয়েছি। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতিতে রপ্তানি নিঃসন্দেহে অন্যতম প্রধান ভ‚মিকা পালন করে। রপ্তানি খাতের উদীয়মান ইউনিটসমূহকে অর্থায়ন করতে হবে। তৈরি পোশাক অথবা অপ্রচলিত পণ্যের দিকেও আমরা নজর দিচ্ছি। বড় বড় ঋণ দিয়ে অনেক বেশি মুনাফা করা গেলেও ছোট ঋণ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে আরও বেশি এগিয়ে নেওয়া যায়। আমরা বিশ্বাস করি যে, অতীতের ঐতিহ্যকে লালন করেই ন্যাশনাল ব্যাংক আগামী দিনগুলোতে দৃপ্ত পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে যাবে।

পূর্বদেশ : এই কর্মপরিকল্পনা অর্জনে কি কি বাধা অতিক্রম করতে হবে বলে মনে করেন?

মো. তৌহিদুল আলম খান : যে কোনো কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সবার আগে প্রয়োজন সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সঠিক দিকনির্দেশনা। ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যে কোনো কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যে কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সেই ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেজন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত সজাগ। আমরা আশা করছি, অচিরেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে পারবো। এছাড়া গণমাধ্যমে মাঝে-মধ্যে ব্যাংকিং সংক্রান্ত কিছু ঋণাত্মক প্রতিবেদন গ্রাহকদেরকে বিভ্রান্ত করে। আমি মনে করি, এই প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম আরো সচেতন হলে সাধারণ গ্রাহকগণ বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা পাবেন।

পূর্বদেশ : ন্যাশনাল ব্যাংককে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে কিভাবে কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছেন?

মো. তৌহিদুল আলম খান : একটি দক্ষ টিম আছে ন্যাশনাল ব্যাংকের। ইতিমধ্যে এই টিমকে আরো উদ্যোমী করতে ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি বিভাগে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও আঞ্চলিক কার্যালয় প্রধানদের সঙ্গে করে বেশ কয়েকটি কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে। নিয়মিত ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমেও তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে। ফলে আমি বিশ্বাস করি এই দক্ষ টিমের উদ্যোগী ভ‚মিকায় অচিরেই ন্যাশনাল ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে ইনশাআল্লাহ।