ফাতেমা পারুল পাহাড়ে পিছিয়ে পড়া নারীদের অনুপ্রেরণা

61

নারী মানে কেনা গোলাম। নারী যেন অন্যের করুনার পাত্র। নারীর প্রতি সমাজের এমন দৃষ্টভঙ্গি বদলাতে নিরলসভাবে কাজ করছেন ফাতেমা পারুল। অসহায়, দরিদ্র, পিঁছিয়ে পড়া, স্বামী পরিত্যক্ত, বিধবা, অস্বচ্ছল পরিবারের নারীদের স্বপ্ন দেখান তিনি। আর এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতির মাধ্যমে নিরলস কাজও করে যাচ্ছেন এ নারী উদ্যোক্তা। সেলাই কাজ, পুতির তৈরি টিস্যু বক্স, নকশি কাঁথা, বল্ক-বাটিক ও বিভিন্ন ফুলের টপ তৈরী নারীর ভাগ্য বদলের হাতিয়ার তার। ফাতেমা পারুল ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারী বান্দরবানের লামা পৌরসভার চাম্পাতলী গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক ও মা আনোয়ারা বেগম। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৯০ সালে লামা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা পাশের পর আর পড়ালেখা করার সৌভাগ্য হয়নি ফাতেমা পারুলের। ২০ বছর বয়সে পশ্চিম রাজবাড়ী আবদুল আজিজের সঙ্গে তাকে বিয়ে দেন মা-বাবা। স্বামী আবদুল আজিজ বাংলাদেশ আনসার ব্যাটালিয়নের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বর্তমানে স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ২০০১ সালে লামা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন ফাতেমা পারুল। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর অবহেলিত নারীদের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ আরো প্রসারিত হয়। তিনি অবহেলিত দরিদ্র নারীদের আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারী নিজের বাড়ীর উঠানে প্রতিষ্ঠা করেন নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মাত্র ১৫ জন নারী নিয়ে শুরু করেন সংগঠনের কার্যক্রম। বর্তমানে ১০০ জন নারী এ সংগঠনের সদস্য রয়েছেন। জানা যায়, নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতির উদ্যোগে শুরু থেকে বাল্য বিবাহ রোধ, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, শিশু পাচার রোধে সচেতনতা মূলক সভা সেমিনারসহ জাতীয় দিবসের মধ্যে নারী দিবসসহ বিভিন্ন দিবস পালন করে আসছে। এছাড়া এলাকার অবহেলিত দরিদ্র নারীদের আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে এ সমিতির মাধ্যমে বেশ কয়েক ধাপে দু শতাধিক বেকার নারীকে সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারীই সেলাইকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে সেলাই কাজ করে এখন সংসার চালায়। স্বামীর পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের পড়া লেখার খরচও যোগান দেন প্রশিক্ষিত এ নারীরা। লামা পৌর এলাকার কলিঙ্গাবিলের কামাল উদ্দিনের স্ত্রী মুক্তা বেগম, কাটা পাহাড়ের মোশারফের স্ত্রী রোকসানা বেগম, চরোয়া বিলের রাশেদা বেগম, পশ্চিম রাজবাড়ীর শাহেনা বেগম উল্লেখযোগ্য। এ সমিতির মাধ্যমে চলতি বছরের জানুয়ারী মাসব্যাপী ৪০ জন নারী এ সমিতির উদ্যোগে নকশি কাঁথা সেলাই প্রশিক্ষন গ্রহণ করেছেন। তার মাধ্যমে এসব কাজে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছেন নারীরা। পাশাপাশি নারীদের কারিগরিভাবে দক্ষ করে তুলতে পাপস বুনন, অ্যামব্রয়ডারি, বাটিক, বুটিকসহ মোট ৯টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা নিজেদের দক্ষ করে এসব কাজের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন। প্রতিভাবান এ ফাতেমা পারুলের অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার সমন্বয়ে ২০০০ সালে সমিতিটি মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন লাভ করে আরো একধাপ এগিয়ে যায়। শুরুতে বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনির ঘর দিয়ে সমিতির কার্যক্রম শুরু করা হয়। বহু আবেদন নিবেদনের পর ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সরকারী ভাবে এডিবি’র অর্থায়নে একটি টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়া ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে কার্যক্রমের অগ্রগতি দেখে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ একটি তিন তলা বিশিষ্ট পাঁকা ঘর নির্মাণ করে দেন। তবে সমিতির ঘর থাকলেও নেই পর্যাপ্ত আসবাবপত্র ও প্রশিক্ষনের সরঞ্জমাদি। আসবাবপত্র না থাকার কারনে যেমন সমিতির দৈনন্দিন কাজে দারুন ব্যাঘাত ঘটছে, তেমনি প্রশিক্ষন সরঞ্জাম না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী এলাকার অবহেলিত বেকার নারীদেরকে প্রশিক্ষন প্রদান করা সম্ভব হয়না। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ নারীকে আতœকর্মসংস্থান মূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সমিতির পক্ষ থেকে। সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধ ভাবে বসে ১৫-২০ জন নারী। পেশায় তারা গৃহবধূ। আর সমিতির সভানেত্রী ফাতেমা পারুল তাদেরকে বাল্য বিবাহ রোধ, নারী পাচার রোধ, নারী নির্যাতন ও যৌতুক প্রথা রোধসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর সচেতনতা বিষয়ক ধারনা দিচ্ছেন। আবার বেশ কয়েকজনকে কর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিচেছন।