সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১১১টি সুপারিশ প্রস্তুত

46

প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে রোড সেফটি অথরিটি গঠনের প্রস্তাব করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে গঠিত কমিটি ১১১টি সুপারিশ প্রস্তুত করেছে। চার মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য এসব সুপারিশ আরও পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। আগামী ৪ এপ্রিলের মধ্যে কমিটি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। কমিটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সুপারিশগুলোকে চার মেয়াদে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- আশু করণীয় যা বর্তমান সময় থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি যা ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি যা ২০১৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং অন্যটি হচ্ছে- চলমান প্রক্রিয়া। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভায় সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
কমিটি একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে দুর্ঘটনা ও শৃঙ্খলার বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা এবং বাস্তব অবস্থার সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা ও ২০১১ সালে গঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশগুলোও আমলে নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুপারিশগুলো দিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে- সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন নাটিকা ও বিজ্ঞাপন বিলবোর্ড, স্ক্রিন, বাসের টিকেট ও গণমাধ্যমে বিনামূল্যে প্রচার বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেক্ষেত্রে দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনও নেতিবাচক বা বিভ্রান্তিকর তথ্য থেকে মিডিয়াকে বিরত থাকতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক আইন, রাস্তা পারাপার ও গাড়িতে উঠানামা মনিটরিং করার ব্যবস্থা করতে হবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) আগের মতো সরকারি খরচে ইন্সট্রাক্টর তৈরির কার্যক্রম গ্রহণ করবে। দক্ষ ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে এবং ইন্সট্রাক্টরবিহীন কোনও ব্যক্তি যেন গাড়ি চালানো শিখতে না পারে সেই নির্দেশনা দিতে হবে। ২০২০ সালের মধ্যে এক হাজার ইন্সট্রাক্টর তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে- পেশাদার চালকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। যুব উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ড্রাইভিং ট্রেড কোর্স চালু করা দরকার। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। যানবাহনের মালিকদের বৈধ ও প্রশিক্ষিত চালক নিয়োগ, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও ফিটনেসসহ সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও করণীয় বিষয়ে সচেতন করতে হবে। মোটরসাইকেল আরোহীদের মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বিআরটিএ স্বীকৃত ড্রাইভিং স্কুল ও ইন্সট্রাক্টরের মাধ্যমে গাড়ি চালনা শিখে ওই সার্টিফিকেট লাইসেন্সের আবেদনের সময় দেখাতে হবে। ২০২০ সালের মধ্যে এটি কার্যকর করতে হবে। অনিবন্ধিত ড্রাইভিং স্কুলকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে বলা হচ্ছে। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে দুইদিনের নবায়ন প্রশিক্ষণ করতে হবে। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। অবৈধ চালকদের শনাক্ত করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হালকা শ্রেণির লাইসেন্স দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে নারী চালকদের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। বলা হয়েছে, নারী চালকরা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি নেয়। সেজন্য এ পেশায় তাদের আলাদা সুযোগ দিতে হবে। চাকরিতে নারী চালকদের অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া শিক্ষিত বেকারদেরও এ পেশায় উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ট্রাফিক পুলিশের জন্য সড়ক নিরাপত্তা, দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ, দুর্ঘটনার তদন্ত ও ট্রাফিক ব্যবস্থার ওপর উন্নত প্রশিক্ষণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। বলা হয়েছে- ফুটপাত দখলমুক্ত করে রেলিং তৈরি, ফুটপাতহীন স্থানে ফুটপাত নির্মাণ ও রাস্তা থেকে ফুটপাত ৮ ইঞ্চি উুঁচু রাখতে হবে। স্কুল, কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সামনে উঁচু করে জেব্রাক্রসিং নির্মাণ করতে হবে। রোড ডিভাইডারে পথচারী প্রতিবন্ধক দিতে হবে। রাস্তায় কোনও ধরনের ম্যানহোল ও ডাস্টবিন রাখা যাবে না। ম্যানহোল সরানো না গেলে সমতলে রাখতে হবে। যেসব স্থানে সাইকেল বেশি সেসব রাস্তায় সাইকেল লেন করে দিতে হবে।
দেশের সব সড়কে প্রয়োজনীয় সাইন, মার্কিং ও স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনও প্রকার গতিরোধক স্থাপন করা যাবে না। মহাসড়কের দুই পাশে ২০ মিটার জায়গায় কোনও ধরনের স্থাপনা রাখা যাবে না। রাস্তার সংযোগস্থলগুলোর ১৫০ ফুট পর্যন্ত কোনও ধরনের গাছপালা থাকতে পারবে না। রাস্তায় টিকিট বিক্রি ও বাস থামার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন যেকোনও রাস্তা নির্মাণের সময় সড়ক নিরাপত্তার সবকিছু আছে কিনা তা বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করে দেখার সুপারিশ করা হচ্ছে। মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গায় গতিবেগ নির্ধারণ ও ১০০ মিটারের মধ্যে গাছপালা কেটে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সার্ভে করে কিছু কিছু রাস্তার সংযোগস্থল উঁচু করে দিতে হবে। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় নজরদারির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। নতুন মহাসড়ক নির্মাণের সময় সার্ভিস রোডের ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব মহাসড়কের লেন সংখ্যা বাড়াতে হবে। কমগতির গাড়ির জন্য আলাদা সার্ভিস রোড বা ভিন্ন একটি লেনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। লেনভিত্তিক গতিসীমা নির্ধারণ করতে হবে। নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ট্রমা সেন্টার ও ফায়ার স্টেশন স্থাপন করতে হবে।
শহরের ভেতর আন্তজেলা বাস টার্মিনাল নির্মাণ না করে বাইরে করতে হবে। সিটি বাসের জন্য টার্মিনাল নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ মতামত নিতে হবে। টার্মিনালে বহুতল পার্কিংসহ চালকদের বিশ্রামাগার রাখতে হবে। রাস্তার চাপ কমাতে ঢাকার চারদিকে নদীর নাব্য সংকট দূর করে পাড় বরাবর রিংরোড নির্মাণ করতে হবে।
গণপরিবহনে পরস্পর প্রতিযোগিতা রোধে বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজি, ত্রæটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ, বাসের ইন্ডিকেটর নিচে রাখা, চালক ও সামনের সারির যাত্রীদের সিটবেল্ট নিশ্চিত করতে হবে। রিকশাকে এলাকাভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে প্রধান সড়ক থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। রাজধানী থেকে রিকশা মুক্ত করতে বিষদ পরিকল্পনা নিতে হবে।
রাইড শেয়ারিং কোম্পানিতে কত গাড়ি চলতে পারবে তার সীমা নির্ধারণ ও চালকদের নির্ধারিত পোশাক থাকতে হবে। প্রত্যেক গাড়িতে আরএফআইডি ট্যাগ লাগাতে হবে এবং ট্রাফিক পুলিশকে উপযুক্ত সংখ্যক ডিভাইস দিতে হবে যাতে গাড়ি না থামিয়েও সব তথ্য পরীক্ষা করতে পারে। শিক্ষানবিশ বা হালকা গাড়ির লাইসেন্স দিয়ে ভারী বা মাঝারি গাড়ি চালনা বন্ধ, পার্কিংয়ের স্থান নির্ধারিত, মার্কেট বা বহুতল ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে ডিজিটাল মনিটরিংয়ের জন্য সিসি টিভি বা স্পিড রাডার গান বা গাড়ির গতি ও ছবি সংরক্ষণ উপযোগী ডিভাইস স্থাপন করতে হবে। গাড়িতে মোবাইল ট্র্যাকার লাগানো যেতে পারে। বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের আগে ট্রাফিক ক্লিয়ারেন্স নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে রোড সেফটি অথরিটি গঠন করতে হবে। অথরিটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করবে এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাজের মনিটরিং করবে।
সড়ক, নৌ ও রেল এ তিনটি মাধ্যমের একটি বহুমুখী সমন্বিত পরিবহন নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ সংক্রান্ত যেকোনও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সড়কে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ট্রাফিক বিভাগের মতামত নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান শাজাহান খান বলেন, কমিটি বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের আশু করণীয় কিছু আছে কিনা সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত ১১১টি সুপারিশ পেয়েছি। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। আগামী ৪ এপ্রিলের মধ্যেই এসব সুপারিশ জমা দেওয়া হবে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।